সোনালি কাবিন

আল মাহমুদ
আল মাহমুদ

কীভাবে জন্ম হয় একটি কবিতার, আশ্চর্য সফল পঙিক্তর? কবিতা জন্ম নেওয়ার সেই উত্তুঙ্গ মুহূর্তে কবির অনুভবে খেলা করে কোন আলোছায়ার মগ্নতা? এই বিভাগে কবিরা লিখছেন তাঁদের লেখা প্রিয় কবিতা নিয়েএকদা প্রেমের কবিতা লেখার ইচ্ছাতেই আমি ‘সোনালি কাবিন’-এর সনেটগুলো লিখে ফেলি। এ বছর এই সনেট ও সোনালি কাবিন নামের বইটির প্রকাশের ৪০ বছর পূর্ণ হলো। এ উপলক্ষে বাংলাবাজারের প্রকাশকেরা সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠান করেছেন। আমাকে দাওয়াত দিয়েছিলেন, কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার কারণে যেতে পারিনি। একটা বই ৪০ বছর ধরে সমাদৃত হচ্ছে, এর সনেটগুলো পড়ে আজও পাঠক আপ্লুত হচ্ছেন— একজন কবির জন্য এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কী হতে পারে! মাঝেমধ্যে বিষয়টি আমার নিজের কাছেও অবাক লাগে। ভাবি, এই বুঝি তবে কবির প্রাপ্তি!আমি কবি—আর কোনো পরিচয় নেই। কবিতার জন্য ছুটে বেড়িয়েছি কত-না চরাচর, এঘাট-ওঘাট। ‘সোনালি কাবিন’ নামে সনেটগুলো যখন লিখি, তখন প্রবল এক ঘোরের মধ্যে ছিলাম। থাকতাম চট্টগ্রামের গোর্খা ডাক্তার লেনের একটি বাড়ির চারতলায়। একাই থাকতাম। আমার প্রতিবেশী ছিলেন বিখ্যাত গায়ক শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব। আমার ডেরার পাশেই থাকত অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মেয়েরা। তাদের কালচারটাই ছিল আলাদা। চলাফেরা, পোশাক-আশাক—সবই আলাদা রকমের। নিজেদের বাইরে সাধারণত তারা কারও সঙ্গে মিশত না, কিন্তু আমার সঙ্গে বেশ ভাব ছিল। মাঝেমধ্যে তাদের অনুষ্ঠানে আমাকে দাওয়াত করত, খাওয়াতে চেষ্টা করত এটা-সেটা। তারা ‘মাহমুদ’ উচ্চারণ করতে পারত না। তাই আমাকে ডাকত ‘মেহমুদ’ নামে। তারা বলত, ‘মেহমুদ ইজ অ্যা পয়েট—গ্রেট পয়েট।’ এই অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মেয়েরা দেখা হলেই আমাকে বলত, ‘পোয়েট, ওহ পোয়েট!’ জবাবে আমি বলতাম, ‘ইয়েস মাদাম...।’ আসলে তারা আমাকে পছন্দ করত। আমিও যেতাম তাদের কাছে।মনে আছে, প্রথমে এক টানে আমি সাতটি সনেট লিখে ফেলি। এরপর লিখি আরও সাত—মোট ১৪টি। কিন্তু পরে অনেক চেষ্টা করেও ‘সোনালি কাবিন’ সিরিজে এই ১৪টির বেশি সনেট লিখতে পারিনি। তখন আমার মনে হয়েছিল, এটা হয়তো কোনো দৈব ব্যাপার। সে সময় চট্টগ্রামে যাঁরা আমাকে থাকতে দিয়েছিলেন, তাঁদের ছিল বইয়ের ব্যবসা। ফলে আমার ঘরটি ছিল বইপত্রে ঠাসা। ঘরের একটু খালি জায়গায় ছিল একটা চেয়ার ও একটা টেবিল।

সোনালি কাবিন
সোনালি কাবিন

ওখানে বসেই লিখতাম। ওই চেয়ার-টেবিলেই লিখেছিলাম সনেটগুলো। একদিন হঠাৎই লিখে ফেললাম ‘সোনার দিনার নেই, দেনমোহর চেয়ো না হরিণী/ যদি নাও, দিতে পারি কাবিনবিহীন হাত দু’টি’—এক নম্বর সনেটটি। লেখার পর আমার সে কী উত্তেজনা—ঘরের ভেতরে পায়চারি শুরু করি, নিজের কবিতা নিজেই মুগ্ধ হয়ে পড়ি! একেকটি সনেট লিখতাম আর ঘরের ভেতর পায়চারি করতাম। সেসব মুহূর্তের কথা বর্ণনা করা যাবে না। আর এখন তো বয়সের ভারে আমার স্মৃতি-বিস্মৃতি সবই একাকার। তাই অনেক কিছু এখন আর মনে করতে পারি না। তবে সনেট আঙ্গিকে আমি প্রেমের কবিতাই লিখতে চেয়েছিলাম। এ জন্য আগেই এ বিষয়ে পড়াশোনা করেছি—প্রথমে আট, পরে ছয় লাইন; সনেটের এই যে ফর্ম—একসময় ইতালিয়ান বেদেরা এভাবে গান গাইতেন। তাঁদের বলা হতো ত্রোবাদুর। তাঁরা যাযাবর ছিলেন। বেদেদের গানকে কবিতার ফর্মে প্রথম রূপ দিলেন পেত্রার্ক। এরপর অনেকেই এ ধারায় লিখছেন। কিটসও লিখেছেন এই ধারায়। বাংলা ভাষায়ও অনেকে লিখেছেন, সার্থক হয়েছেন। মাইকেল মধুসূদন দত্তের সনেট ১৪ মাত্রার। এর অনেক পরে আমি লিখলাম ‘সোনালি কাবিন’। লেখার পরই মনে হয়েছিল, সনেটগুলো বাংলা সাহিত্যে আমাকে অমরতা এনে দেবে। আজ দেখি, আমার ধারণা বেঠিক নয়, আশ্চর্যজনকভাবে সফল হয়েছে সনেটগুলো! ‘সোনালি কাবিন’-এ তখন আমি খুব সাহসের সঙ্গে ‘কাবিন’ শব্দটি ব্যবহার করেছি। আমার আগে বাংলা কাব্যে এ শব্দের ব্যবহার হয়নি।

প্রথমে কলকাতা থেকে ‘সোনালি কাবিন’-এর ১৪টি সনেট নিয়ে একটি ছোট পকেট বই বের হয়। এটা আমাকে খুব আনন্দ দিয়েছিল।

পরে ওই ১৪টি সনেট এবং আরও কিছু কবিতা দিয়ে সোনালি কাবিন নামেই আমার তৃতীয় বই বের হয় ১৯৭৩ সালে। বইটি প্রকাশ করেছিল নওরোজ সাহিত্য সম্ভার। তবে সনেটগুলো প্রকাশ হওয়ার পরই যে আলোড়ন তুলেছিল তা নয়, কিছু দিন পর শুরু হলো আলোচনা। তখনকার সেরা পত্রপত্রিকায় এ সনেট নিয়ে আলোচনা হতে লাগল, পাঠকমহলে বিস্ময় সৃষ্টি করল, যা এই ৪০ বছর পর্যন্ত বিরামহীনভাবে চলছে।

মনে হয়, আমার সবচেয়ে জনপ্রিয় কবিতা হলো ‘সোনালি কাবিন’।

কাব্য সৃষ্টিই কবির কাজ। অবিরাম কবিতা লিখেছি, কিন্তু প্রকাশের ৪০ বছর পর সোনালি কাবিন-এর সনেটগুচ্ছ আমার দেশের মানুষ এখনো বয়ে নিয়ে যাচ্ছে, এটা কয়জন কবির ভাগ্যে জোটে!

সোনার দিনার নেই, দেনেমাহর চেয়ো না হরিণী

যদি নাও, দিতে পারি কাবিনবিহীন হাত দু’টি,

আত্মবিক্রয়ের স্বর্ণ কোনোকালে সঞ্চয় করিনি

আহত বিক্ষত করে চারদিকে চতুর ভ্রুকুটি;

ভালোবাসা দাও যদি আমি দেব আমার চুম্বন,

ছলনা জানি না বলে আর কোনো ব্যবসা শিখিনি;

দেহ দিলে দেহ পাবে, দেহের অধিক মূলধন

আমার তো নেই সখী, যেই পণ্যে অলংকার কিনি।

বিবসন হও যদি দেখতে পাবে আমাকে সরল

পৌরুষ আবৃত করে জলপাইয়ের পাতাও থাকবে না;

তুমি যদি খাও তবে আমাকেও দিয়ো সেই ফল

জ্ঞানে ও অজ্ঞানে দোঁহে পরস্পর হব চিরচেনা

পরাজিত নই নারী, পরাজিত হয় না কবিরা;

দারুণ আহত বটে আর্ত আজ শিরা-উপশিরা।

l সোনালি কাবিনের ১ নম্বর সনেট