ক্রাচের রেহেনা

রেহেনা আক্তার
রেহেনা আক্তার

ক্রাচে ভর করে এক পায়ে তড়িঘড়ি করে হাঁটছে মেয়েটি। কাঁধে ব্যাগ। ভিড় ঠেলে বাসে উঠল। এভাবে প্রতিদিন তিন কিলোমিটার হেঁটে কলেজে যাওয়ার বাস ধরতে হয় তাকে। মেয়েটির নাম রেহেনা আক্তার।
রেহেনার বাড়ি পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার পশ্চিম শাকারিকাঠি গ্রামে। স্থানীয় সাফা ডিগ্রি কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী সে।
তিন বছর বয়সে ট্রেনে কাটা পড়ে ডান পা হারায় রেহেনা। শুরু হয় জীবনসংগ্রাম। দুর্ঘটনাটি ২০০১ সালের। মা-বাবার সঙ্গে ট্রেনে নানা বাড়ি যশোরের বেনাপোলে যাচ্ছিল রেহেনা। চলন্ত ট্রেন থেকে পড়ে গিয়ে ঊরু থেকে ডান পা হারায়। যশোর হাসপাতালে চিকিৎসার পর রেহেনাকে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। এক পা হারিয়ে নানা প্রতিকূলতার মধ্যে বেড়ে উঠতে থাকে। ২০০৩ সালে রেহেনাকে ভর্তি করা হয় স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।
এক পায়ের মেয়েটি ক্রাচে ভর দিয়ে দারিদ্র্য ও প্রতিবন্ধী জীবনের সব বাধা উপেক্ষা করে নিজের স্বপ্ন জয়ের পথে চলছে।
রেহেনা বলে, ‘একটি পা না থাকায় ছোটবেলা থেকে মনে কষ্ট ছিল। একটু বড় হওয়ার পর বুঝতে পারলাম, আমার পঙ্গুজীবনে উন্নতির জন্য লেখাপড়া ছাড়া আর কোনো পথ নেই। আমি শিক্ষক হতে চাই। তাই প্রতিদিন ক্রাচে ভর করে দুই কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে বিদ্যালয়ে যেতাম। বর্ষার সময় কাদায় ভরা সড়ক দিয়ে বিদ্যালয়ে যেতে কষ্ট হতো।’ এ পর্যন্ত আসতে পরিবারের সহযোগিতা যেমন পেয়েছে, রেহেনা তেমনি পেয়েছে শিক্ষক ও সহপাঠীদের সহমর্মিতা। লেখাপড়ার ব্যাপারে তাদের উৎসাহ রেহেনার মনে শক্তি জুগিয়েছে।

রেহেনা আক্তার
রেহেনা আক্তার

রেহেনার দুরবস্থার কথা জেনে এনডোলাইট বাংলাদেশ নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ২০১১ সালে কৃত্রিম একটি পা দেয়। তবে কৃত্রিম পাটি কয়েক মাস আগে ভেঙে গেছে। তাই এখন আবার আগের মতো প্রতিদিন তিন কিলোমিটার পথ ক্রাচে ভর করে হেঁটে গুদিঘাটা বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে বাসে কলেজে যেতে হয় তাকে। এরপর বাসে ১০ কিলোমিটার গিয়ে কলেজে পড়তে হচ্ছে। অনেক সময় বাসে বসার জায়গা পাওয়া যায় না। তখন পুরো সময় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।
রেহেনার মা নাসিমা বেগম জানান, সমবয়সীদের সঙ্গে খেলাধুলার ইচ্ছা থাকলেও মেয়েটি এক পা হারানোর কারণে খেলতে পারত না। লেখাপড়ার প্রতি মেয়ের আগ্রহ দেখে ওর বাবা আবুল কালাম আজাদ পশ্চিম শাকারিকাঠি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেন। কাঠ দিয়ে তৈরি করে দেওয়া হয় একটি ক্রাচ। শিশু রেহেনা ক্রাচে ভর করে বিদ্যালয় যেত।
২০০৭ সালে পঞ্চম শ্রেণির প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় রেহেনা। এরপর দেখা দেয় নতুন বিপত্তি। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হলে দুই কিলোমিটার দূরে হেঁটে যেতে হবে। মেয়ের শারীরিক অক্ষমতা আর অভাবের সংসারে রেহেনার পড়াশোনা বন্ধের উপক্রম হয়। তবে রেহেনা লেখাপড়া ছাড়তে নারাজ। ২০০৮ সালে তুষখালী ইউনিয়ন তোফেল আকন মেমোরিয়াল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয় রেহেনা।
রেহেনার বাবা আবুল কালাম আজাদ বললেন তাঁর পাঁচ ছেলেমেয়ের সবাই লেখা পড়া করছে। বড় মেয়ে রেকসোনা বরিশাল বিএম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে স্নাতক (সম্মান) তৃতীয় বর্ষে পড়ছে। বাকি তিন ছেলে মেয়ে স্কুল ও মাদ্রাসায় পড়ছে। সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ চালাতে তিনি গ্রামীণ ব্যাংক ও আশা থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন। দিনমজুর হিসেবে যে মজুরি পান, ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে গিয়ে তার অর্ধেকের বেশি টাকা শেষ হয়ে যায়। বাকি টাকায় সংসার আর ছেলেমেয়ের লেখাপড়া চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
তোফেল আকন মেমোরিয়াল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মনীন্দ্র নাথ শিকদার বলেন, ‘রেহেনার লেখাপড়ার প্রতি অদম্য আগ্রহ তাকে এ পর্যন্ত নিয়ে এসেছে। ঝড়-বৃষ্টির মধ্যেও মেয়েটি বিদ্যালয়ে কোনো দিন অনুপস্থিত থাকেনি।’ এমন কথা বললেন সাফা ডিগ্রি কলেজের প্রভাষক শাকিল আহমেদও। শিক্ষকদের আশা, রেহেনা একদিন সফল হবেই। এমন প্রত্যাশা তো আমাদেরও।