বাংলাদেশি নৌকার প্রেমে এক ফরাসি

ইভস মারে
ইভস মারে

ফ্রান্সের ইভস মারে অভিযানের নেশায় এসেছিলেন বাংলাদেশে। তারপর বাংলাদেশের নৌকা ও ভালোবাসার টানে থিতু হয়েছেন এ দেশেই।
প্যারিসের রাস্তায় একদিন অবাক করা দৃশ্য। পিকআপ গাড়ি ট্রলিসমেত টেনে নিয়ে যাচ্ছে একটি কাঠের নৌকা। থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন পথচারীরা। কেউ কেউ সেলফিও তুললেন এই জলযানের সঙ্গে। সবাইকে অবাক করে দিয়ে অবশেষে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী চন্দ্রনৌকার (স্থানীয় নাম চান নৌকা) ঠাঁই হলো ফ্রান্সের আন্তর্জাতিক নৌকা প্রদর্শনীতে। সন্তুষ্টির হাসি ফুটল ইভস মারের মুখে। ইভস বলছিলেন গত ডিসেম্বর মাসের কথা, ‘প্যারিসে আন্তর্জাতিক নৌকা প্রদর্শনী উদ্বোধনের সময় তখন ঘনিয়ে এসেছে। কিন্তু জাহাজ আর আসে না। টেনশনে মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড় আমার।’
প্রদর্শনী শুরুর ঠিক আগের দিন গত বছরের ৫ ডিসেম্বর জাহাজ পৌঁছায় প্যারিসে। এরপর আরেক যুদ্ধ।
জাহাজ থেকে খালাস করে ১০ কিলোমিটার দূরের মেলাস্থলে নিয়ে যেতে হবে নৌকাটি। পরে একটি ট্রলিতে তুলে গাড়ি দিয়ে টানতে টানতে প্রদর্শনীস্থলে নেওয়া হলো আট মিটার দীর্ঘ জলযান।
পুরো নাম ইভস মাইকেল রবার্ট মারে। মাতৃভূমি ফ্রান্স। বাংলাদেশের নৌকা নিয়েই এখন তাঁর যত কাজ। নৌকার টানে এ দেশে এসে ভালোবেসেছেন এক বাঙালি নারীকে। সংসারও পেতেছেন এ দেশে।
১৯৯৪ সালে বাংলাদেশে আসা এই ফরাসি নাগরিকের স্থায়ী ঠিকানা এখন চট্টগ্রাম। বাংলাদেশের নাগরিকত্বও পেয়েছেন তিনি। এখানকার উপকূলীয় এলাকায় চলাচলকারী জলযান, বিশেষ করে নৌকাকে নিরাপদ বাহন হিসেবে গড়ে তোলা তাঁর স্বপ্ন। এ লক্ষ্যে তিনি স্থানীয় সাম্পানের আদলে নিত্যনতুন নৌকা বানিয়ে যাচ্ছেন তাঁর কালুরঘাটস্থ কর্ণফুলী তীরের কারখানায়। এসব নৌকা চলাচল করছে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। পাশাপাশি জেলেদের নিরাপদ নৌকা তৈরির প্রশিক্ষণও দিচ্ছেন ইভস।

১৯৯৪ সালের মে মাস: ইভস যেদিন নাও ভেড়ালেন বাংলাদেশে
১৯৯৪ সালের মে মাস: ইভস যেদিন নাও ভেড়ালেন বাংলাদেশে

আকাশ থেকে নৌপথে
প্রথম যৌবনে ইভসের বিচরণ ছিল আকাশপথে। ১৯৭৩ সালে এয়ার ফ্রান্সে বৈমানিক হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি। অনেক দেশে গিয়েছেন বিমান নিয়ে। পাশাপাশি ঝোঁক ছিল নৌকা চালানোর। সেই ইচ্ছা থেকেই ১৯৯০ সালে নিজের ফ্ল্যাট বিক্রি করে কিনে ফেললেন একটি ছোট ইঞ্জিন নৌকা। এরপর অসীম সাহসিকতায় আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে চলে যান যুক্তরাষ্ট্রের মিয়ামিতে।
৩৬ দিনের একাকী সেই অভিযাত্রার কথা শোনা যাক ইভসের মুখে: ‘আমি নৌকা চালনা নিয়ে বই পড়েছি। ১৫ দিন প্রশিক্ষণ নিয়েছি। সঙ্গে ছিল খাবার আর দিকনির্দেশক বই। কিছুক্ষণ চালাই কিছুক্ষণ পড়ি। এভাবে চলে গেলাম মিয়ামিতে। এটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ একটি অভিযাত্রা ছিল।’
সেই থেকে নৌপথ জয়ের নেশা পেয়ে বসে ইভসকে। ১৯৯৩ সালের প্রথম দিকে ফ্রান্সে একটি ইঞ্জিনচালিত হাসপাতাল নৌকা বাতিল ঘোষণা করে বিক্রি করে দেওয়ার কথা উঠল। ইভস ভাবলেন, নৌকাটির এখনো চলনশক্তি রয়েছে। এটি অন্য অনেক দেশে কাজে লাগবে। গড়ে তুললেন ফ্রেন্ডশিপ নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। এরপর নামমাত্র মূল্যে ওই নৌকাটি কিনে নিলেন তিনি। ইভস মারে নদীমাতৃক বাংলাদেশের প্রেমে পড়েন ফ্রান্সে থাকতেই। ওই নৌকা নিয়ে ছুটলেন বাংলাদেশের উদ্দেশে।

ইভস ও রুনা: সেই সব প্রেমময় দিন
ইভস ও রুনা: সেই সব প্রেমময় দিন

বাংলাদেশ প্রেম
২০০ টনের নৌকাটি নিয়ে তিনজন ক্রুসহ ইভসের বাংলাদেশে আসতে সময় লাগে সাড়ে তিন মাস। ‘সাত সমুদ্র’ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে ওই ফ্রেন্ডশিপ নৌকাটি এসে পৌঁছায় ১৯৯৪ সালের মে মাসে। কিন্তু চট্টগ্রামে ভিড়তে গিয়েও পারেনি খারাপ আবহাওয়ার কারণে।
এরপর ইভস নৌকাটি নিয়ে গেলেন খুলনার মংলা বন্দরে। সেখানে প্রথম অভিজ্ঞতাটি সুখকর ছিল না। প্রথম রাতেই তাঁদের জাহাজ থেকে চুরি হয়ে গেল সহযোগী নাবিকের পাসপোর্ট ও ডলার।
‘মানুষকে সাহায্য করার জন্য আমি এসেছি। প্রথম অভিজ্ঞতা খারাপ ছিল। এর পর থেকে অবশ্য সবকিছুই ভালো। ওই নৌকাটি (লাইফবয় হসপিটাল বোট) এখনো উপকূলীয় অঞ্চলে চিকিত্সাসেবা দিয়ে যাচ্ছে।’
এ দেশে আসার পর তিনি নৌকার পাশাপাশি প্রেমে পড়েন এক বাঙালি নারীর। কাজের সুবিধার্থে ঢাকায় রোটারিয়ান আলিমুর রহমান খানের বাসায় থাকতেন তিনি। সেখানে আলিমুরের মেয়ে রুনা খানের সঙ্গে পরিচয়। পরিচয় গড়ায় প্রেমে। রুনাকে নিয়ে পুরোদমে শুরু করেন বেসরকারি সংস্থা ফ্রেন্ডশিপের কাজ।
সব মিলিয়ে এ দেশেই স্থায়ী হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। ১৯৯৬ সালে বিয়ে করেন তাঁরা। রুনা খান এখন ফ্রেন্ডশিপের নির্বাহী পরিচালক। ইভস বলেন, ‘দুজন একসঙ্গে কাজ করতে গিয়ে প্রেমে পড়ি। বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিই। সে (রুনা) আমার কাজে খুব সহযোগিতা করে।’

ফ্রান্সের ইভস মারে থিতু হয়েছেন বাংলাদেশে। ছবি: জুয়েল শীল ও ইভস মারের ব্যক্তিগত সংগ্রহ
ফ্রান্সের ইভস মারে থিতু হয়েছেন বাংলাদেশে। ছবি: জুয়েল শীল ও ইভস মারের ব্যক্তিগত সংগ্রহ

নৌকার নেশা
বিয়ের পর স্ত্রীকে নিয়ে ইভস গড়ে তোলেন একটি নদীভ্রমণ কোম্পানি। ইভস এ জন্য নির্মাণ করেন একটি বড় আকৃতির নৌকা। ওই নৌকার নাম বি ৬১৩। এটি নিয়ে উপকূলের মানুষের বিশেষ করে মত্স্যজীবীদের ব্যবহৃত নৌকা নিয়ে কাজ শুরু করেন।
২০০৪ সালে স্থায়ীভাবে নারায়ণগঞ্জে তিনি গড়ে তোলেন ‘তাড়াতাড়ি শিপইয়ার্ড’ নামে নৌকা নির্মাণকারী একটি প্রতিষ্ঠান। ওখানে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চলাচলকারী নৌকা প্রস্তুত করতে থাকেন ইভস। তিন বছর আগে সেখান থেকে গুটিয়ে ইভস প্রতিষ্ঠানটি স্থানান্তর করেন চট্টগ্রামের কালুরঘাটে। ফাইবার, কাঠ ও স্টিল দিয়ে এসব নৌকা তৈরি করা হয়।
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ইভসের তৈরি করা শতাধিক নৌকা এখন চলাচল করছে। তাঁর মধ্যে রাঙামাটিতে স্কুলশিক্ষার্থীদের আনা-নেওয়ার জন্য ইউনিসেফ কিনে নিয়েছে ১০টি নৌকা। ওই নৌকাগুলো চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সাম্পানের আদলে তৈরি। এ ছাড়া বরিশাল উপকূলে চলছে ৬০টি ছোট-বড় নৌকা। তৈরি করা হয়েছে একটি সি অ্যাম্বুলেন্সও। কুড়িগ্রাম অঞ্চলে আছে ফ্রেন্ডশিপের দুটি ভাসমান হাসপাতাল।
ইভস জানান, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তাঁর তৈরি শতাধিক নৌকা চলাচল করছে। এর বেশির ভাগই ফাইবারের। ‘ঝুঁকিমুক্ত নিরাপদ বাহন তৈরিই আমার লক্ষ্য। কারণ, উপকূলের মানুষ তাদের বাহনের কারণে ঝুঁকিতে পড়ে। আমার ফাইবারের নৌকাগুলো ডোবার সম্ভাবনা খুব কম।’

স্ত্রী রুনা খান ও ছেলে সালমানের সঙ্গে ইভস মারে
স্ত্রী রুনা খান ও ছেলে সালমানের সঙ্গে ইভস মারে

তারাতারিতে একদিন
কর্ণফুলীর তীরে তারাতারি ইয়ার্ড। মাসখানেক আগের এক শীতের সকাল। ইয়ার্ডে গিয়ে দেখা গেল, বিভিন্ন আকৃতির নৌকা তৈরিতে ব্যস্ত শ্রমিকেরা। কেউ ফাইবার গলাচ্ছেন, কেউবা মডিউলের ওপর গলানো ফাইবার ঢালছেন আবার কেউবা রং করছেন তৈরি নৌকায়। মাঝেমধ্যে নির্দেশনা দিচ্ছেন ইভস মারে। রয়েছেন ৩০ জনের বেশি কর্মী। এ ছাড়া এক প্রকৌশলীসহ দুই ফরাসি নারীও কাজ করছেন এখানে। সাড়ে সাত মিটারের একটি নৌকা বানানোর কাজ চলছে সেখানে। নিজ কার্যালয়ে বসে ইভস তাঁর জীবনের গল্প বলছিলেন। তাঁর মন্তব্য, ‘হারিয়ে যাওয়া প্রথাগত নৌকাগুলো সংরক্ষণের চেষ্টা করছি। এ ছাড়া নৌকা নিয়ে গবেষণার পাশাপাশি কাঠের বদলে ফাইবারের ব্যবহারে সবাইকে আগ্রহী করে তোলাই আমার লক্ষ্য। কারণ, এতে ঝুঁকি কমে যায়। এ ছাড়া কারিতাসের সহযোগিতায় মত্স্যজীবীদের নৌকা চালানোর প্রশিক্ষণও দিচ্ছি। যাতে দুর্যোগকালীন সময়ে তাঁরা নিজেদের রক্ষা করতে পারেন।’
বলতে বলতে কর্ণফুলীর শান্ত জলরাশির দিকে তাকালেন ইভস।
ইভস এখন বাংলাদেশ মেরিটাইম নিরাপত্তা ও উদ্ধার সংস্থার প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। ফ্রান্সকে বহির্বিশ্বে উপস্থাপনের জন্য ২০০৮ সালে তিনি ফ্রান্স সিনেটের পুরস্কারে ভূষিত হন। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে তাঁর কাছে বড় পাওয়া বাংলাদেশের নাগরিকত্ব। ২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইভসের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ এই নাগরিকত্ব প্রদান করেন। ‘বাংলাদেশের নাগরিকত্ব আমার সবচেয়ে বড় পাওয়া,’ বললেন ইভস।

প্যারিসের প্রদর্শনীতে বাংলাদেশের নৌকা
প্যারিসের প্রদর্শনীতে বাংলাদেশের নৌকা

ফ্রান্সে চন্দ্রনৌকা
দুই দিকে বাঁকানো দেখতে অনেকটা অর্ধচন্দ্রের মতো করে নৌকাটি বানানো হয়। সে কারণেই নাম সম্ভবত চন্দ্রনৌকা বা চান নৌকা। বিভিন্ন আকারের হয় এই নৌকা। সাধারণত কাঠ দিয়ে এগুলো তৈরি করা হয়। এই নৌকা সাধারণত জেলেরা মাছ ধরার কাজে ব্যবহার করে থাকেন। কক্সবাজারের টেকনাফ, চকরিয়া এবং চট্টগ্রামেও এ ধরনের নৌকা প্রচলিত। প্যারিসের প্রদর্শনীতে স্থান পায় এরকম একটি নৌকা।
‘স্যালন নটিক ইন্টারন্যাশনাল দে প্যারিস’ শিরোনামের এই প্রদর্শনীতে নৌকাটি দেখতে আসেন ফ্রান্সে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শহীদুল ইসলাম। ছিলেন ফ্রান্সপ্রবাসী বাংলাদেশি শিল্পী শাহাবুদ্দীনও। প্রদর্শনীতে ৩০টি দেশের ৪৫০টি নৌকা স্থান পায়। গত বছরের ৬ থেকে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলা ওই প্রদর্শনী এসেছিলেন হাজারও দর্শক। যাঁদের অনেকে নামও জানতেন না বাংলাদেশের। ইভসের নৌকা দেখে তাঁরা জানলেন একটি নতুন দেশের নাম—বাংলাদেশ।