স্পর্শে আমার আলো

ওঁদের চোখের আলো নেই, কিন্তু মনের জানালা ঠিকই খোলা। অমর একুশে গ্রন্থমেলায় স্পর্শ ব্রেইল প্রকাশনার স্টলে। ছবি: আবদুস সালাম
ওঁদের চোখের আলো নেই, কিন্তু মনের জানালা ঠিকই খোলা। অমর একুশে গ্রন্থমেলায় স্পর্শ ব্রেইল প্রকাশনার স্টলে। ছবি: আবদুস সালাম

সকালটা একটু অন্য রকম। চারদিকে ফাল্গুনের হইহুল্লোড় আর রংবেরঙের মলাটের হাতছানি। বাহারি হলদে ছটায় মানুষের ছুটোছুটি। তাঁদের কেউ দল বেঁধে সেলফি তুলছেন, কেউবা বই বগলদাবা করে বের হচ্ছেন। 
উচ্ছ্বাসের অংশ হয়েই বইমেলার এক কোনায় বাংলা একাডেমি ভবনের পাশে ছোট্ট স্টলটিতে বসে বই পড়ছিলেন একজন। পায়ে পায়ে এগিয়ে জানতে চাই, কী বই পড়ছেন—ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে জানালেন হেলেন কেলারের আত্মজীবনী। সেই হেলেন, যাঁর আছে আত্মপ্রত্যয়ের ইতিহাস। মিলন হোসেনের জীবনটাও তেমনি। হেলেনের মতো তাঁরও চোখের আলো নেই, কিন্তু মনের জানালা ঠিকই খোলা। আঙুলের স্পর্শেই তাই নিজের কল্পনাকে রাঙিয়ে নিচ্ছেন।
বাঙলা কলেজের মাস্টার্সের এই ছাত্র স্পর্শ ব্রেইল প্রকাশনার স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছেন। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য ২০১১ সাল থেকে এই প্রকাশনা বইমেলায় তাঁদের স্টল দিচ্ছে। এর মধ্যেই এলেন এই প্রকাশনার আরেকজন স্বেচ্ছাসেবক তাসনিমা আক্তার। কথা বলতে বলতেই জানালেন, এই উদ্যোগ মূলত সবার মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা আর দশটা মানুষের মতোই বই পড়তে চান এবং সেই বই তাঁরা কীভাবে পাচ্ছেন, কোন পদ্ধতিতে পড়ছেন, সেগুলো জানানোও স্পর্শ ব্রেইল প্রকাশনার একটি উদ্দেশ্য।
শিশুতোষ সাহিত্যিক নাজিয়া জাবীনের হাত ধরেই গড়ে উঠেছে এই প্রকাশনা। তাঁর মতে, পাঠ্যপুস্তক হিসেবে বই থাকলেও ভালো লাগা কিংবা মনের খোরাক মেটানোর মতো ব্রেইল পদ্ধতিতে কোনো বই-ই আগে ছিল না।
২০০৯ সালে শিশুদের জন্য একটি ছড়ার বই বের করেছিলেন তিনি। সে সময় বইটির প্রকাশনা উত্সবে যোগ দেন কয়েকজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। নাজিয়া জাবীন বলেন, ‘আমি দেখছিলাম, ওনারা বইয়ের মলাট ছুঁয়ে দেখছেন। কেউ কেউ পাতা গুনছেন। বইটাকে তাঁরা অনুভব করতে চাইছিলেন, কিন্তু পড়তে পারার ক্ষমতা ছিল না। তখন থেকেই মনে হলো, ওনাদের জন্য কিছু একটা করি।’
এই উদ্যোগের শুরুতে তাঁর সঙ্গে ছিলেন সাহিত্য প্রকাশের স্বত্বাধিকারী মফিদুল হক। তিনি সে সময় ব্রেইল পদ্ধতিতে প্রকাশের জন্য তাঁর প্রকাশনীর সাতটি বই দিয়েছিলেন। গত পাঁচ বছরে স্পর্শ ২৪টি বই প্রকাশ করেছে। ছড়া, কবিতা, আত্মজীবনী, ইতিহাস, গল্প—সবই আছে তাতে। এ বছর বইমেলায় বের হচ্ছে আরও ছয়টি বই। যার মধ্যে আছে কাজী নজরুল ইসলাম, বেগম রোকেয়াসহ অন্যান্য মনীষীর জীবনী, লুত্ফর রহমান লিটনের ছড়া ইত্যাদি। আর এখান থেকে প্রতিবছর বইগুলো বিনা মূল্যে দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, সিলেটসহ নানা জায়গার বিভিন্ন স্কুলে বইগুলো পাঠানো হচ্ছে।
ইডেন কলেজের দর্শন বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্রী রিবিকা মুন্সী এসেছেন আলোর অংশীদার হতে। ভালোবাসেন হুমায়ূন আহমেদের গল্প। ওনার কোন বইটা আপনার সবচেয়ে ভালো লাগে জানতে চাইলাম। কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে জবাব দিলেন, হুমায়ূন আহমেদের কোনো বই পড়ার সুযোগ হয়নি তাঁর। কিন্তু ওনার কিছু নাটক শুনেছেন। তার পর থেকেই তিনি হুমায়ূন আহমেদের ভক্ত। এ ছাড়া গল্পে গল্পে শেখা, আকাশে অনেক লেখা বই দুটিও তাঁর অনেক পছন্দের।
রিবিকা বলেন, ‘আমরা যে এখানে আসতে পারছি, অন্যদের দেখাতে পারছি—এটাই অনেক বড় ব্যাপার। আমরা চাই, এই উদ্যোগ দেখে আরও অনেকে এ ধরনের বই প্রকাশে উদ্বুদ্ধ হোক।’
নাজিয়া জাবীনের আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও তাঁর নিজস্ব অর্থায়নে কাজ করছে প্রকাশনাটি। অনেক সময় যাঁরা বইগুলো তৈরি করছেন, তাঁরা বিনা মূল্যেই সেগুলো দিয়ে দিচ্ছেন। ব্যয়বহুল এই কাজ এভাবে চালিয়ে নেওয়া কিছুটা কঠিন—বলছিলেন নাজিয়া। কিন্তু তার পরও স্বপ্ন দেখেন, একদিন বইমেলার সব প্রকাশক দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য অন্তত একটি বই অবশ্যই প্রকাশ করবেন।