নারী ক্রিকেটের কান্ডারি

জাতীয় নারী ক্রিকেট দল; বাংলাদেশের স্বপ্ন সারথিরা। ছবি: শামসুল হক
জাতীয় নারী ক্রিকেট দল; বাংলাদেশের স্বপ্ন সারথিরা। ছবি: শামসুল হক

খুলনার মেয়ে সালমা খাতুন। ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেটের প্রতি দারুণ টান। বোলিং-ব্যাটিং—দুটোতেই বেশ সিদ্ধহস্ত। তবে তখন তাঁর স্বপ্নের সীমানাটা ছিল খুব ছোট। ক্রিকেটার হবেন, কল্পনাও করতে পারেননি। কিন্তু কী আশ্চর্য! তিনি এখন ক্রিকেটার। কেবল ক্রিকেটারই নন। এ দেশের নারী ক্রিকেটের কান্ডারিও।

সালমার ক্রিকেটার-স্বপ্নের পূর্ণতা পাওয়ার শুরু সেই ২০০৬ সালে। দেশেও তখন সবে যাত্রা শুরু হয়েছে নারী ক্রিকেটের। মেয়েদের আন্তজেলা প্রতিযোগিতা আয়োজনের উদ্যোগ নিল বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড। তারই অংশ হিসেবে গঠন হলো খুলনা জেলা দল। অথচ এ দলের ব্যাপারে কিছু জানতেন না সালমা! তবে তিনি দলের অনুশীলনে যোগ দিলেন কীভাবে?
গল্পটা শুনুন তাঁর মুখেই, ‘আমার এক মামাতো ভাইয়ের বন্ধুর সঙ্গে নিয়মিত ক্রিকেট খেলতাম। সে সালাউদ্দিন স্যারকে (খুলনা জেলার কোচ এবং খুলনার নারী ক্রিকেট দল গঠনের প্রধানতম ব্যক্তি) একবার আমার ব্যাপারে বলেছিল। সালাউদ্দিন স্যার ওকে বললেন, আমাকে নিয়ে যেতে। ওই সময় আমি আবার বেড়াতে গিয়েছিলাম দাদুর বাড়ি। মায়ের ফোনে পরদিনই চলে আসি। এরপর সালাউদ্দিন স্যারের সঙ্গে দেখা করতে মামাতো ভাই নিয়ে গেল মাঠে। প্রথম দিন মাঠে গিয়েছিলাম সালোয়ার-কামিজ পরে।’
এরপর শুরু হলো নিয়মিত অনুশীলন। তাঁকে প্রথম ক্রিকেটের পোশাক কিনে দিয়েছিলেন কোচ সালাউদ্দিন। অনুশীলনে ভালো করায় ২০০৭ সালে খুলনা জেলা দলে সুযোগ দেওয়া হলো সালমাকে। আন্তজেলা সেই প্রতিযোগিতায় একটা শতকও হাঁকালেন তিনি। তবে সেই প্রতিযোগিতায় অবশ্য খুলনা চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি, হয়েছিল রানারআপ। চ্যাম্পিয়ন ভোলা জেলা দল। এরপর জাতীয় দলেও ডাক এল। সালমার অগ্রযাত্রা শুরু ওখান থেকেই, যা চলছে এখনো। গত বছর খেলেছেন ঘরের মাঠে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। ব্যক্তিগতভাবে সাফল্যটাও নেহাত কম নয়। গত বছর আইসিসি মেয়েদের টি-টোয়েন্টি র‌্যাঙ্কিংয়ে হয়েছেন সেরা বোলার।

সংবাদ সম্মেলনে অধিনায়ক সালমা। ছবি: শামসুল হক
সংবাদ সম্মেলনে অধিনায়ক সালমা। ছবি: শামসুল হক

মেয়েদের ক্রিকেট আজকের যে পর্যায়ে এসেছে, ১০ বছর আগেও কেউ তা ভাবতে পারেনি। এ পরিবর্তনটা এল কীভাবে? সালমা বললেন, ‘প্রথম দিকে পরিবার থেকে বাধা দেওয়া হতো। কিন্তু এখন আর সেভাবে বাধা দেওয়া হয় না। অর্থাৎ দিন যত যাচ্ছে মানুষের মনোভাবে পরিবর্তন আসছে। এখন তো অনেক বাবা-মা নিজেরাই মেয়েকে অনুশীলনে নিয়ে আসেন, ক্রিকেটার বানাবেন বলে।’
ক্রিকেট খেলতে গিয়ে কখনো কি অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির শিকার হতে হয়েছে? সালমা বললেন, ‘দর্শকেরা যেমন সমর্থন করে, তেমনি তারাই দুয়ো দেয়, বাজে কথা বলে। এসব খেলারই অংশ। তবে খেলাধুলার বাইরে বাজে পরিস্থিতিতে কখনোই পড়িনি। বরং কোথাও গেলে মানুষ খুব উৎসাহিত করে।’ তবে সালমা জানালেন, টেলিভিশনে মেয়েদের খেলার প্রচার কম হওয়ায় মানুষ তাদের একটু কম চেনে-জানে। অবশ্য যাঁরা মেয়েদের ক্রিকেটের খোঁজখবর নিয়মিত রাখেন, তাঁরা ঠিকই উৎসাহ দেন, প্রশংসা করেন। খেলোয়াড়দের প্রতি তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গিও অন্য রকম।
মেয়েদের ক্রিকেট একটা পর্যায়ে এসেছে ঠিক; তবে হাঁটতে হবে আরও দূরে। বাংলাদেশ মেয়েদের ক্রিকেটের অধিনায়ক তাই বললেন, ‘আমি মেয়েদের ক্রিকেটের শুরু থেকে আছি। শুরু থেকে এখন—পুরো সময়টা চিন্তা করলে আমাদের উন্নতিই হয়েছে। হয়তো ছেলেদের মতো অতটা সুযোগ-সুবিধা আমরা পাই না। তবে আমাদের পরের প্রজন্ম শতভাগই পাবে বলে ধারণা। মিনহাজুল আবেদীন-আকরাম খান-আমিনুল ইসলামরা খুব বেশি সুযোগ-সুবিধা পাননি। কিন্তু এখনকার খেলোয়াড়েরা তার চেয়ে বেশি পাচ্ছেন। এখনকার নারী ক্রিকেটও আকরাম ভাইদের সেই সময়ে আছে। তবে দিন যত যাচ্ছে, আমাদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ছে। এটা খুবই ইতিবাচক দিক।’
নারী ক্রিকেটে উন্নয়নে বিসিবিকে আরও উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানালেন এ অলরাউন্ডার, ‘বোর্ড অনেক সহযোগিতা করছে। তবে এটা আরও বাড়াতে হবে। আমাদের আরও বেশি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার ব্যবস্থা করতে হবে। ম্যাচ না খেললে সামনে এগোনো কঠিন। অন্য দেশের মেয়েরা সারা বছরই ম্যাচ খেলে। আমরা সে তুলনায় অনেক কম খেলি। ঘরোয়া লিগগুলোও সময়মতো হয় না। এগুলো নিয়মিত হলে আমরা আরও ভালো করতে পারতাম।’
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলা হয়েছে। সালমার চোখে এখন নারী বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্ন। সালমাদের স্বপ্ন পূরণ হবে, এ চাওয়া গোটা বাংলাদেশেরই।