উড়ছে বাংলাদেশ...

অ্যাডিলেডের স্টেডিয়ামের বাইরে পতাকা হাতে আবেদ চৌধুরী
অ্যাডিলেডের স্টেডিয়ামের বাইরে পতাকা হাতে আবেদ চৌধুরী

সকালে ছিল অ্যাডিলেডের আকাশভরা মেঘ। আমরা ক্যানবেরা ছেড়েছি ভোরে বিমানে চেপে। ছয়টার ফ্লাইট, এয়ারপোর্টে পৌঁছাতে হবে পাঁচটায়, বাড়ি থেকে ট্যাক্সি নিয়ে রওনা হতে হবে চারটায়। শেষ অবধি রাতে আর ঘুম হলো না আমাদের। আমি আর আমার ক্রিকেট-পাগল ছেলে সামি। ছেলে অস্ট্রেলিয়ায় জন্ম ও বড় হওয়া। অস্ট্রেলিয়া দলের দুর্দান্ত সমর্থক। কিন্তু ক্যানবেরায় বাংলাদেশ আর আফগানিস্তানের খেলা দেখার পর থেকে তার মাঝে লক্ষ করতে শুরু করেছি অনেক পরিবর্তন। বিশেষ করে খেলার শেষে মাশরাফি, সাকিেবরা দৌড়ে এল দর্শকদের কাছে, তখন দেখলাম সামির চোখ-মুখ আনন্দে ঝলমল করছে। বুঝলাম, সে বাংলাদেশ দলকে ভালোবাসতে শুরু করেছে। স্কটল্যান্ডের বিরুদ্ধে বিজয় ছিল যেন এই ভালো লাগার পরের ধাপ।
যাই হোক, সকালে খেলা দেখতে এসে অ্যাডিলেডে আকাশভরা মেঘ দেখে আমাদের ভেতরটাও থমথমে। নাশতা খেতে খেতে আলাপ হলো বাংলাদেশি তরুণ এক দম্পতির সঙ্গে। তাঁরা বাংলাদেশ থেকে চলে এসেছেন এই খেলা দেখবেন বলে। এ রকম এসেছেন আরও অনেকে। বিভিন্ন দলের, পেশার, ধর্মের মানুষ—সবাই এসেছে এই ক্রিকেটের মিলনমেলায়। মজার ব্যাপার, ক্যানবেরা শব্দের অর্থও নাকি মিলনের স্থান।
দেশের চলমান অস্থিরতার মধ্যে ক্রিকেট যেন হয়ে গেছে দলমত-নির্বিশেষে আশ্রয়ের এক জায়গা। দুপুর নাগাদ আকাশ পরিষ্কার হলে দেখা গেল অস্ট্রেলিয়ার চিরচেনা নীল আকাশ। তাতে ভেসে ভেসে যাওয়া মেঘ, যেন আমাদের শরৎকাল।
আমরা বাবা–ছেলে হোটেল থেকে হেঁটে হেঁটে অ্যাডিলেড ওভালে চলে গেলাম। বসলাম ডন ব্র্যাডম্যান প্যাভিলিয়নের পাশে। মাঠজুড়ে তখন টাইগার-সমর্থকদের জয়ধ্বনি। সারা অস্ট্রেলিয়া থেকে বাংলাদেশিরা এসেছে। মানুষের সংখ্যা শেষ অবধি দাঁড়াল ১৩ হাজার। সাদার ওপর লাল ক্রসের পতাকা নিয়ে এসেছে ইংল্যান্ডের সমর্থকেরাও। তারা আমাদের মতো অতটা উচ্চকিত নয়। আমরা কিনেছি বাংলাদেশের পতাকা। ছেলে সামির হাতেও দেশের পতাকা। ভাবছিলাম, দেশ ও সমাজ নিয়ে চিন্তিত আমরা এখন খেলার মাঠে পতাকার মানুষ। এভাবেই আধুনিক যুগে খেলা হয়ে দাঁড়ায় জাতীয়তাবাদের প্রতীক।
তারপর কয়েক ঘণ্টা আমরা যেন উপভোগ করলাম এক আশ্চর্য ‘মিরাকল’। প্রথম টাইগারদের ব্যাটিং। তারা আমাদের নিরাশ করেনি। ২৭৫ রান করেছে বিখ্যাত ইংরেজ দলের বিরুদ্ধে।
ইনিংস শেষ হওয়ার পর সবখানে চাপা উত্তেজনা। ততক্ষণে অনেক ইংরেজ-সমর্থকও এসে জুটেছে। একজন এসেছে কোনো বিচিত্র কারণে পাকিস্তানের পতাকা নিয়ে। দেখলাম, নিরাপত্তাকর্মীরা এসে তাকে বের করে দিলেন। এই খেলায় বাংলাদেশিদের এই প্রবল জাতীয়তাবাদের কাছে আজ পাকিস্তানের পতাকার কোনো স্থান নেই, এটা অস্ট্রেলিয়ান নিরাপত্তাকর্মীরাও যেন বুঝতে পেরেছেন।
রাত ৯টা-১০টা অবধি প্রবল উত্তেজনা। একেকবার মনে হলো, উত্তেজনা এত বেশি যে মাঠে আর বসা যাচ্ছে না। ক্রমেই ইংল্যান্ডের সমর্থকেরা উত্তেজিত হয়ে উঠছিল। অনেক অস্ট্রেলিয়ান পুলিশ বাংলাদেশি সমর্থকদের মাঝে দাঁড়ানো। অ্যাডিলেড শান্ত শহর, কিন্তু গোলমাল লাগতে কতক্ষণ?
খেলার চূড়ান্ত মুহূর্তে রুবেল হোসেনের দু-দুটো দুর্দান্ত বোল্ড আউট! সেটা সরাসরি মাঠে থেকে দেখার খুশি ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। খেলাকে কেন্দ্র করে দেশপ্রেমের এমন বিস্ফোরণ যেন একটা নতুন জাতীয় সত্তার জন্মের মতো। অ্যাডিলেড শহরের যার প্রচণ্ড ঢেউয়ে আমরা ভেসে গেলাম সেই রাতে।
লেখক: জিনবিজ্ঞানী ও গবেষক।