সিলিকন ভ্যালিতে উদ্যোগী দুই তরুণ

ফাহিম মাসউদ আজিজ ও সাকিব হাসান যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালিতে গড়ে তুলেছেন ব্যাকপ্যাকব্যাং
ফাহিম মাসউদ আজিজ ও সাকিব হাসান যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালিতে গড়ে তুলেছেন ব্যাকপ্যাকব্যাং

দাদার একটি গুরুত্বপূর্ণ পথ্য, বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া ছোট ভাইবোনের বই কিংবা মায়ের জন্য একটি বিশেষ উপহার—অনেক সময় দেশের বাজারে পাওয়া যায় না। পাওয়া যায় অন্য কোনো দেশে কিন্তু সেগুলোর চাহিদা এত কম যে কোনো আমদানিকারক বা ব্যবসায়ী তা বাণিজ্যিকভাবে দেশে আনেন না। তখন খোঁজ নিতে হয় আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুবান্ধবকেও—ওই দেশ থেকে আসবে বা কিছুদিনের মধ্যে যাবে কি না। শুধু বাংলাদেশে নয়, এই সমস্যা রয়েছে বিশ্বজুড়ে। আর তাই তো দুই বাঙালি তরুণ উদ্যোগ নিয়েছেন এই সমস্যা দূর করার। যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালিতে তাঁরা গড়ে তুলেছেন ব্যাকপ্যাকব্যাঙ (backpackbang) নামের একটি নতুন উদ্যোক্তা কোম্পানি (স্টার্টআপ), যা বিশ্বজুড়ে পর্যটকদের সুযোগ করে দিচ্ছে অন্যের প্রয়োজনীয় সামগ্রী এক দেশ থেকে অন্য দেশে বৈধভাবে পৌঁছে দিতে।
ব্যাংকার বাবা-মা আজিজুল ইসলাম ও মনসুরা খাতুনের সন্তান ফাহিম মাসউদ আজিজ ২০০৭ সালে ধানমন্ডি বালক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও ২০০৯ সালে নটর ডেম কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। পরে এক বছর জাপানে প্রশিক্ষণ নিয়ে চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে উস্টার লিবারেল আর্ট কলেজে গণিত ও অর্থনীতিতে স্নাতক পড়তে শুরু করেন। কিন্তু কলেজে নতুন উদ্যোক্তা তৈরির নানান আয়োজন তাঁকে বারবার কলেজজীবনে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। নটর ডেম কলেজে তাঁর প্রিয় বন্ধু ছিলেন সাকিব হাসান। সাকিবের বাবা খাদ্য অধিদপ্তরের পরিচালক বদরূল হাসান আর মা শাহীনুর পারভীন গৃহিণী। সাকিব ২০০৯ সালে নটর ডেম কলেজ থেকে বুয়েটের কম্পিউটার কৌশল বিভাগে ভর্তি হন, পড়াও শুরু করেন। কিন্তু কিছুদিন পর সাকিব পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে, যোগ দেন ফাহিমের সঙ্গে। তাঁদের বিশ্বাস এমন কিছু করা, যা সবাইকেই এগিয়ে নেবে। ইন্টারনেটের এই যুগে দূরত্ব কোনো সমস্যা নয়। দুজনেই ভেবে ভেবে বের করেছেন, এখনো পৃথিবীর সব পণ্য সব দেশে পাওয়া যায় না! অথচ সারাক্ষণই কেউ না কেউ এক দেশ থেকে অন্য কোনো দেশে যাচ্ছে। এই যে পর্যটকদের আসা-যাওয়া আর পণ্যের জন্য কারও কারও হাপিত্যেশ করে বসে থাকা—এই দুইয়ের মধ্যে কোনো সংযুক্তি আনা যায় কি না।
বাংলাদেশে একটি দল গঠন করার জন্য গত ডিসেম্বরে দেশে এসেছিলেন সাকিব ও ফাহিম। সে সময় প্রথম আলোর কার্যালয়ে কথা হয় তাঁদের সঙ্গে।
যদি একটা সিস্টেম বানানো যায়, যেখানে পর্যটকদের সঙ্গে ক্রেতাদের আধুনিক ও নিরাপদ পদ্ধতিতে যুক্ত করা যায়। বললেন সাকিব।
‘মানে, আমি যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসার সময় যদি আপনার দরকারি বইটা নিয়ে আসতে পারি, তাহলেই আপনার সমস্যার সমাধান হয়।’ ব্যাখ্যা করলেন ফাহিম।
এই চিন্তা থেকে ওই দুজন একটি ওয়েবসাইট বানানোর চিন্তা করেন। তাঁদের প্ল্যাটফর্মে পর্যটকেরা নিবন্ধিত হয়ে জানাবেন তাঁরা কবে, কোথা থেকে কোথায় যাবেন। অন্যদিকে, ক্রেতারাও তাঁদের চাহিদার কথা জানাবেন। তাঁরা চাহিদা ও পর্যটকের গন্তব্য হিসাব করে দুজনের মধ্যে মেলবন্ধন করে দেন। পর্যটক তাঁর কাঁধের ঝোলাতে সেটি ক্রেতার দেশে বয়ে নিয়ে তাঁর হাতে পৌঁছে দেবেন। আর ক্রেতা পণ্যটি হাতে পাওয়ার পর ব্যাকপ্যাকব্যাঙ পর্যটককে বিল পরিশোধ করবেন।
২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পরীক্ষামূলকভাবে চালু করার মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে ৮০টি দেশ থেকে আগ্রহী ক্রেতা ও পর্যটকেরা তাঁদের প্ল্যাটফর্মে ভিড় করতে শুরু করেন।
সাকিব ও ফাহিম তখন এর গুরুত্ব বুঝতে পারেন। কিন্তু একটি স্টার্টআপ কোম্পানি দাঁড় করানোর সামর্থ্য তাঁদের ছিল না। এই সময় তাঁরা সিলিকন ভ্যালির সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ উদ্যোক্তা পরিচর্যা কেন্দ্র ওয়াই কম্বিনেটরে (ওয়াইসি) আবেদন করেন এবং ৫০০-এর বেশি আবেদনকে পরাস্ত করে ওয়াইসির ‘সিড সাপোর্ট’ লাভ করে। সিলিকন ভ্যালিতে ওয়াই কম্বিনেটরের ১২ সপ্তাহের পরিচর্যা কর্মসূচিতে যোগ দেন সাকিব ও ফাহিম। ওয়াই কম্বিনেটরের ওই কর্মসূচিতে প্রতি মঙ্গলবার হাজির হন বিশ্বখ্যাত প্রযুক্তি উদ্যোক্তারা। শোনান তাঁদের গল্প, ভুল ও শুধরে নেওয়ার কাহিনি। এ ছাড়া বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগও থাকে।
তবে সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া হয় দল গঠনের ওপর। জানালেন ফাহিম। তাঁদের কাজ শুরু করার জন্য ওয়াই কম্বিনেটর তাঁদের ১ লাখ ২০ হাজার ডলারের একটি প্রারম্ভিক মূলধনও দিয়েছে।
ফাহিম-সাকিব জানালেন, বাংলাদেশিদের কাছে ইলেকট্রনিক সামগ্রী, বইয়ের চাহিদা বেশি। লাতিন আমেরিকার মানুষেরা চান জুতা, বেল্ট আর ভারতীয়দের দরকার ফ্যাশনসামগ্রী আর বই।
বিশ্বব্যাপী একটি পিয়ার টু পিয়ার পণ্যসেবা নেটওয়ার্ক গড়ে তোলায় ব্যাকপ্যাকব্যাঙের অভিলাষ। তাদের স্বপ্ন নিশ্চয়ই একদিন পূরণ হবে।