শিশুকে বলি যুদ্ধকথা

শিশুকে তার বয়স উপযোগী করেই বলতে হবে যুদ্ধের গল্প। মডেল: রুনা খান ও রাজেশ্বরী। ছবি: কবির হোসেন
শিশুকে তার বয়স উপযোগী করেই বলতে হবে যুদ্ধের গল্প। মডেল: রুনা খান ও রাজেশ্বরী। ছবি: কবির হোসেন

চার বছরের শিশু অনন্ত। বাবার কাছে জানতে চায় ‘স্বাধীনতা দিবস কী?’ ‘মুক্তিযুদ্ধ মানে কী?’ অনন্তর বাবাও চান তাঁর সন্তান বেড়ে উঠুক একজন সচেতন দেশপ্রেমিক মানুষ হিসেবে। জানুক ১৯৭১-এর বিজয়গাথা। সন্তানকে এসব জানাতে গিয়ে তিনি মাঝেমধ্যে দ্বিধায় পড়ে যান। কীভাবে তাঁর সন্তানকে তিনি জানাবেন আমাদের বীরত্ব, ত্যাগ আর বিজয়ের আলেখ্য। কীভাবে জানাবেন যুদ্ধের প্রাপ্তি আর ত্যাগের কথাগুলো। যুদ্ধের নির্মমতা আর বীভৎসতা তার শিশুমনে আবার কোনো প্রভাব ফেলবে না তো!
যেকোনো বাঙালি শিশুর জন্য মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তথ্য জানা খুব জরুরি। মুক্তিযুদ্ধ কোনো রূপকথা নয়, এর সঙ্গে যুক্ত আমাদের ইতিহাস, রাজনীতি, সমাজ-বিবর্তন আর স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরম্পরা। একটি শিশুকে আত্মসম্মানবোধ নিয়ে বেড়ে ওঠার জন্য ১৯৭১ জানতেই হবে। এর জন্য স্কুলের পাঠ্যপুস্তক বা টেলিভিশনের আলেখ্য যথেষ্ট নয়। পরিবারে মা-বাবার দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। কেবল মুক্তিযুদ্ধ নয়, বরং ইতিহাসের সব যুদ্ধ নিয়েও শিশুকে জানানো প্রয়োজন। কেননা যুদ্ধের ভয়াবহতার উল্টো দিকেই থাকে মানবতা আর সভ্যতার রথে মানুষের এগিয়ে যাওয়ার গল্প।
পুরাকালের রোমাঞ্চকর গ্রিস ও ট্রয়ের যুদ্ধ, মোগল যুগে ভারতবর্ষের যুদ্ধ, পলাশীর যুদ্ধ, দু-দুটি বিশ্বযুদ্ধ, ভিয়েতনামের যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ ইত্যাদি সব যুদ্ধের সঙ্গেই যুক্ত মানুষের ইতিহাস। বইয়ের পাতার বাইরে বাবা-মায়েরা নিজের মতো করে যুদ্ধ সম্পর্কে তাঁদের ধারণা শিশুকে জানাবেন। ইতিহাস শোনাবেন গল্পের আঙ্গিকে। এতে শিশু মানবিক গুণসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে, আত্মকেন্দ্রিকতাকে অতিক্রম করে হয়ে উঠবে বিশ্বমানব। যুদ্ধের সবদিক শিশুকে জানাতে হবে। যুদ্ধের ইতিহাস কেবল হানাহানি, হিংসা আর সংঘাতের নয়, যুদ্ধের রয়েছে মানবিক ও ত্যাগের দিক।
অনেক সময় মা-বাবারা মনে করেন আমার সন্তান ছোট, এসব বিষয় জানার বয়স তার হয়নি। কোন বয়সে শিশুকে বাবা-মায়েরা কী ধারণা দেবেন, তা জানতে হলে শিশুর ‘ধারণার জগৎ তৈরি তত্ত্ব’ সম্পর্কে খানিকটা বুঝতে হবে। মনোবিজ্ঞানী জ্যাঁ পিয়াজে গত শতকের তিরিশের দশকে এ ‘ধারণার জগৎ তৈরির তত্ত্ব’ ব্যাখ্যা করেছেন। সেই তত্ত্বে তিনি বলেছেন, দুই থেকে সাত বছর বয়সের মধ্যে ধারণার জগৎ সৃষ্টির দ্বিতীয় স্তরে (প্রি-অপারেশনাল স্টেজ) শিশু যখন ভাষা শেখা শুরু করে, তখন থেকে তার মধ্যে চারপাশ সম্পর্কে একটি মূর্ত ধারণার জন্ম নেয়। যুক্তিবোধ জোরালো হয় না বটে কিন্তু শিশু এ সময় যা দেখে বা শোনে সেটাকেই বিশ্বাস করে। ৭ থেকে ১১ বছর বয়সে এর পরের স্তরে (কনক্রিট অপরেশনাল স্টেজ) শিশু তার চারপাশের ঘটে যাওয়া ঘটনার কার্যকারণ বুঝতে শেখে এবং যুক্তির প্রয়োগ করতে শুরু করে। আর পরের ধাপে অর্থাৎ ১১ বছরের পরে শিশু প্রবেশ করে আনুষ্ঠানিক কার্যকর স্তরে (ফর্মাল অপারেশনাল স্টেজ), যেখানে শিশু বিমূর্ত চিন্তা, নৈতিকতা ইত্যাদির চর্চার মাধ্যমে চারপাশকে বুঝতে শেখে। মুক্তিযুদ্ধসহ যেকোনো বিষয় সম্পর্কে শিশুকে ধারণা দেওয়ার আগে এই স্তরগুলো মা-বাবাদের মাথায় রাখা প্রয়োজন।
দুই থেকে ছয়-সাত বছর বয়সী শিশু, যারা ধারণার জগৎ তৈরির দ্বিতীয় স্তরে অবস্থান করছে, তাদের মুক্তিযুদ্ধসহ যেকোনো বিষয় জানাতে হলে তার বয়স উপযোগী করেই জানাতে হবে। জানাতে হবে কাদের সঙ্গে কাদের যুদ্ধ হয়েছিল, যুদ্ধের কারণে মানবসভ্যতা কী পেয়েছে আর কী হারিয়েছে। যুদ্ধের কোন দিকটি গর্বের, তা শিশুকে জানাতে হবে। যেমন মুক্তিযুদ্ধের কারণেই আমরা স্বাধীন হয়েছি। যুদ্ধের আত্মত্যাগী শহীদ এবং মুক্তিযোদ্ধারা যে অতিসম্মানীয় সেটা যেন শিশুরা বুঝতে পারে। পাশাপাশি পৃথিবীর অন্যান্য যুদ্ধের ইতিহাস শিশুকে জানাতে হবে কিন্তু তাকে এটাও বোঝাতে হবে যে যুদ্ধ কখনোই কাম্য নয়।
পরবর্তী সময়ে ৬ থেকে ১১ বছর বয়সের শিশুরা জানবে যুদ্ধ কেন হয়। যেমন যুদ্ধ বিষয়টি কাম্য না হলেও ১৯৭১ সালে কেন এটি অনিবার্য ছিল, সেই ধারণা সে যেন পায়। তবে কেবল ভয়াবহতা আর বীভৎসতা নয়, মুক্তিযুদ্ধের অর্জন জানাতে হবে তাকে। ১১ বছরের বেশি বয়সীদের মধ্যে যখন বিমূর্ত ধারণার জগৎ তৈরি হতে থাকে তখন তার সময় হয়েছে যুদ্ধের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট জানার। ব্রিটিশ শাসনামল থেকে শুরু করে বঞ্চনা আর শোষণের ইতিবৃত্ত, ভাষা আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলন, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী ফলাফল, বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপট জানাটাও শিশুর জন্য দরকার। বিশ্বযুদ্ধগুলোর বীভৎসতা, মানুষের সংগ্রাম বিশেষত শিশুদের কষ্টটুকু তাকে শোনাতে হবে। আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরির মতো একটি বই যেন তার অবশ্যপাঠ্য হয়ে ওঠে।
যুদ্ধের যে কালো দিক—নিমর্মতা, নির্যাতন, গণহত্যা এবং নারীদের সম্ভ্রমহানির বিষয়গুলোও শিশুর জানতে হবে। এগুলো এড়িয়ে যাওয়ার নয়, লুকিয়ে রাখারও নয়। শিশুকে এগুলো জানাতে হবে তার বয়সের উপযোগী করে, ধারণার জগৎ সৃষ্টি তত্ত্বের স্তরগুলোকে মাথায় রেখে। শহীদ আর বীরাঙ্গনা ধারণার সঙ্গে শিশুকে পরিচিত করাতে হবে। কেন একজন নারী বীরাঙ্গনা, কেন তিনি সম্মানীয়, সেই বিষয়টি মা-বাবা শিশুকে অবশ্যই জানাবেন। বিশ্বযুদ্ধের হলোকাস্ট কী, নুরেমবার্গ ট্রায়াল এবং বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয়গুলোও সহজভাবে শিশুকে জানান, ধীরে ধীরে সময় নিয়ে।
যুদ্ধের কথা জানানো মানে এই নয় যে যুদ্ধ করা খুবই ভালো, যুদ্ধের নিদারুণ কাহিনি আর ভয়াবহতার বিপ্রতীপে শান্তির পথে এগিয়ে যাক প্রতিটি শিশু, বুঝতে শিখুক যুদ্ধ নয়, এই পৃথিবী হোক শান্তি আর ভালোবাসার।

বাবা-মায়ের যা যা করা উচিত
. শিশু যখন ভাষা শিখতে শুরু করে তখন থেকেই শিশুকে যুদ্ধবিষয়ক সত্য ঘটনাগুলো বলা যেতে পারে। স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস, হিরোশিমা দিবস ইত্যাদি দিনগুলোর সঙ্গে শিশুকে পরিচিত করা।
. জাতীয় পতাকা দেখানো, বাড়িতে জাতীয় পতাকা রাখা আর শুদ্ধভাবে জাতীয় সংগীত শোনানো, জাতীয় পতাকা আর জাতীয় সংগীতকে কীভাবে সম্মান জানাতে হয় তা শেখানো।
. শিশুকে জাতীয় জাদুঘর, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, বধ্যভূমি, শহীদ মিনার, জাতীয় স্মৃতিসৌধ, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ইত্যাদি স্থানে নিয়ে যাওয়া
. শিশুকে তার বয়সের উপযোগী মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গল্প, কবিতা, মুক্তিযোদ্ধাদের চিঠি, ডায়েরি পড়তে দেওয়া, বিশ্বযুদ্ধের ওপর লেখা বই পড়তে উৎসাহিত করা। দেশাত্মবোধক গান শুনতে আগ্রহী করা।
. শিশুদের উপযোগী বিভিন্ন যুদ্ধের নাটক-চলচ্চিত্র দেখতে উৎসাহিত করা।
. পাকিস্তানি বাহিনী আর তাদের এ দেশীয় দোসরদের বীভৎসতা আর নির্মমতা জানানোর পাশাপাশি বাঙালির বীরত্বগাথাও শিশুকে জানানো।
. মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কোনো হতাশাব্যঞ্জক কথা শিশুর সামনে না বলা।
. শিশুকে মুক্তিযোদ্ধা আর বীর নারী মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান করতে শেখানো।
. মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বীর সেনানী, সেক্টর কমান্ডার, শহীদ বুদ্ধিজীবী, খেতাবপ্রাপ্তদের জীবনী পড়তে দেওয়া।
. স্কুল নির্বাচনের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা যে ওই স্কুলে মুক্তিযুদ্ধের চর্চা হয় কি না।
. একাত্তরে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির নৃশংসতা এবং বর্তমান সময়ে তাদের অপতৎপরতা সম্পর্কে শিশুকে ধারণা দেওয়া।
. মুক্তিযুদ্ধের সময়কালের পত্রিকা-প্রকাশনা যা পাওয়া যায় সেগুলো শিশুকে দেওয়া।
. নিজ পরিবারে কোনো মুক্তিযোদ্ধা বা ১৯৭১-এর প্রত্যক্ষদর্শী থাকলে তাদের কাছে শিশুকে নিয়ে যাওয়া এবং তাদের কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা শিশুকে শোনানো।
. মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কোনো তাচ্ছিল্যপূর্ণ, অবমাননাকর কথা কেউ বললে শিশুর সামনে সেটার প্রতিবাদ করা।
. শিশুকে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গান, গল্প, অভিনয় বা ছবি আঁকার প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া।
. মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক শিশুর যেকোনো কৌতূহল বা প্রশ্নের প্রকৃত উত্তর দেওয়া, সেগুলো এড়িয়ে না যাওয়া
. বিজাতীয় সংস্কৃতিকে পরিহার করে পরিবারের মধ্যে নিজস্ব ভাষা আর সংস্কৃতির চর্চা করা, ভিনদেশি সহস্র পর্বের ধারাবাহিক দেখার বদলে নিজ শিশুকে গুণগত সময় দেওয়া।
লেখক: মনোরোগ বিশেষজ্ঞ
soton 73 @gmail. com