বাংলার প্রেমে পড়েছি : নাইজেল হিউজ

মূল রচনা: রবীন্দ্রসংগীত শুনে পড়েছিলেন বাংলার প্রেমে। সেই প্রেমের টানেই যুক্তরাজ্যের ভূতত্ত্বের অধ্যাপক নাইজেল হিউজ গবেষণার ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন আমাদের এই ভূখণ্ডকে। গাছ আর পাথর ঘেঁটেই তিনি বের করে এনেছেন বঙ্গীয় বদ্বীপের হাজার বছরের চমকপ্রদ ইতিহাস

নাইজেল হিউজ
নাইজেল হিউজ

গাছ-পাথরের এক ধরনের ভাষা আছে। সেই ভাষা বুঝতে হবে, আর তা বোঝার জন্য তাদের কাছ থেকে ভালোভাবে লক্ষ করতে হবে। অনেক প্রশ্ন করতে হবে। পৃথিবীকে বুঝতে হলে এমনভাবেই এগোতে হয়। ছোট্ট মেয়ে মনীষা তার বাণীদির কাছ থেকে গাছ-পাথর সম্পর্কে জানতে চাইলে এভাবেই উত্তর পায়।
নাইজেল হিউজের লেখা ও দীপেন ভট্টাচার্যের অনুবাদেমনীষার পাথরের বন বইটিতে এভাবেই কথোপকথনের মাধ্যমে ঘটনা এগোয়। গাছের গুঁড়ির মধ্যে থাকা রেখা গুনে মনীষা খোঁজে ইতিহাসের নানা ঘটনাপ্রবাহ। প্রশ্ন-উত্তর আর পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে মনীষার জবানিতেই নাইজেল হিউজ একে একে তুলে ধরেন বঙ্গীয় বদ্বীপের চার-পাঁচ হাজার বছর আগের ইতিহাস।
প্রায় দুই যুগ ধরে চলা গবেষণায় নাইজেল জানতে পেরেছেন, এই বাংলা অঞ্চল হিমালয়ের কোল ঘেঁষে সৃষ্টি হয়ে বঙ্গোপসাগরের কোল থেকে বালি-পলি জমে বড় হয়েছে। এখানে মানুষের বসতি সাড়ে তিন হাজার বছর আগে শুরু হয়। আর ১০ হাজার বছর আগে এখানকার ভূমির উৎপত্তি ঘটে। তাহলে ওই বাকি সাড়ে ছয় হাজার বছর ধরে এখানে কী হয়েছে? কারা ছিল এখানে, তারাই কী করত? গেলই বা কোথায়? এসব প্রশ্নের উত্তর নাইজেল খুঁজে বেড়াচ্ছেন। বেশ কিছু উত্তর পেয়ে গেলেও অনেক কিছুই যে অজানা, সেটাও স্বীকার করে নিলেন।
অজানা প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে নাইজেল সারা বছর ছুটে বেড়ান হিমালয় থেকে বঙ্গোপসাগর, বীরভূম থেকে ভুটান, তিব্বত থেকে সিলেট। হাজার বছরের পথপরিক্রমায় এখানকার মাটির কী বদল হলো। হাজার বছর আগের যেসব চিহ্ন এখনো টিকে আছে, তা বিচার-বিশ্লেষণ করে জানার চেষ্টা করেন, কীভাবে কেন এই পরিবর্তন হলো।

সেই তরুণ বয়সেই বাংলার মাটি আর গানের প্রেমে পড়েছিলেন নাইজেল হিউজ
সেই তরুণ বয়সেই বাংলার মাটি আর গানের প্রেমে পড়েছিলেন নাইজেল হিউজ

ঢাকায় নাইজেল হিউজ
গত ৩১ আগস্ট ঢাকার আমেরিকান সেন্টারের উদ্যোগে নাইজেল হিউজ ঢাকায় এসেছিলেন। ঢাকায় বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কার্যালয়ে ও আমেরিকান সেন্টারে বঙ্গীয় বদ্বীপের পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাস নিয়ে বক্তৃতা করেন তিনি। এর এক ফাঁকেই কথা হয় ভূতত্ত্বের এই বিশ্বখ্যাত অধ্যাপকের সঙ্গে।
আলাপের শুরুতেই চমক। হাত মিলিয়ে পরিষ্কার বাংলায় নাইজেল জানতে চাইলেন, ‘কেমন আছেন?’ গায়ে ফতুয়া, চোখেমুখে সারল্য। বাঙালিয়ানার প্রেমে পড়েছেন নাইজেল বহু আগেই।
চামড়ার ব্যাগ থেকে একটি পাথরের টুকরা বের করলেন। দেখিয়ে বললেন, এটি আসলে একটি কাঠের টুকরা। ভারতের বীরভূম থেকে সংগ্রহ করে নিয়ে যাচ্ছেন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাগারে। গাছ-পাথরের ওই টুকরাটি দেখিয়ে বললেন, ‘বিন্দুর মাঝে সিন্ধুর দেখা মেলে—এই বাংলা প্রবাদটি আমি এসব গাছ-পাথরের ক্ষেত্রে অনেক বেশি প্রযোজ্য বলে মনে করি।’
জমে ওঠে আমাদের আলাপচারিতা। নাইজেল হিউজের সঙ্গে সেই আলাপচারিতার চুম্বক অংশ তুলে ধরলাম পাঠকদের জন্য।

হিমালয় থেকে বঙ্গোপসাগর—এই পুরো অঞ্চলের ভূমির গঠন ও ইতিহাস নিয়ে আপনি গবেষণা করছেন। পৃথিবীর এত এলাকা থাকতে এই এলাকা নিয়ে গবেষণায় আগ্রহী হলেন কেন?
নাইজেল হিউজ: ভূবিদ্যার ছাত্র হিসেবে হিমালয় নিয়ে অনেক আগে থেকে জানাশোনা ছিল। তবে এই অঞ্চল নিয়ে গবেষণা শুরুটা হয়েছিল বাংলাদেশে আসার পর। ১৯৮২ সালে আমার এক বন্ধুর বিয়েতে ঢাকায় এসেছিলাম। বাংলাদেশের এক শিল্পপতির সঙ্গে আমার ওই বন্ধুর বিয়ের অনুষ্ঠানের এক ফাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বেড়াতে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি রবীন্দ্রসংগীতের একটি উৎসব হচ্ছে। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো তন্ময় হয়ে রবীন্দ্রনাথের ওই গান শুনি। এরপর রবীন্দ্রসংগীতের ক্যাসেট কিনে মাতৃভূমি ইংল্যান্ডে নিয়ে যাই। তা-ও আমার মন ভরে না। তখন আমি আরও জানলাম, রবীন্দ্রনাথ পশ্চিমবঙ্গের বোলপুরে শান্তিনিকেতন গড়ে তুলেছিলেন। সেখানে এখনো রবীন্দ্র আদর্শকে অনুসরণ করে পড়াশোনা করানো হয়। আমি সেখানে ভর্তি হলাম। জানার চেষ্টা করলাম এখানকার মাটির কী এমন ক্ষমতা, এখানকার ইতিহাস ও সংস্কৃতির কী এমন প্রেরণা যে এমন সংগীত এখানে সৃষ্টি হয়। বাংলা ভাষা, ইতিহাস ও সংস্কৃতি—এই সবকিছু শান্তিনিকেতনে শেখানো হলো। আমি শিখলাম। পরে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা ও গবেষণার সুযোগ পাওয়ার পর সিদ্ধান্ত নিলাম আমি বঙ্গীয় বদ্বীপ ও হিমালয়ের ভূতাত্ত্বিক গঠন ও ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করব।

গাছ-পাথর নিয়ে গবেষণা করেন নাইজেল হিউজ
গাছ-পাথর নিয়ে গবেষণা করেন নাইজেল হিউজ

একদিকে রবীন্দ্রসংগীত ও সাহিত্য, অন্যদিকে ভূতত্ত্বের মতো জটিল বিষয়। এ দুটি বিষয়কে আপনি কীভাবে কাছাকাছি মনে করেন?
নাইজেল হিউজ: এটা সত্যি, আমাদের ভূতাত্ত্বিকেরা মৃত উপাদান, যেমন মাটি, পাথর, জীবাশ্ম নিয়ে গবেষণা করেন। এগুলো থেকেই অতীতের ঘটনা জানার চেষ্টা করেন। আর ভূতাত্ত্বিকদের ভাষাও বেশ জটিলই হয়। কিন্তু আমি খুব সহজ-সরল পদ্ধতিতে গবেষণা করি এবং তার ফলাফলগুলো মানুষকে জানানোর চেষ্টা করি। যেমন আমার গবেষণার প্রধান উপাদান হচ্ছে গাছ-পাথর। হাজার বছর আগের বনভূমি ও গাছ প্রাকৃতিক নানা পরিবর্তনের কারণে একসময় পাথরে পরিণত হয়। ভারত ও বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় এই গাছ-পাথরগুলো পাওয়া যায়। বাংলাদেশের সিলেট ও ময়মনসিংহ অঞ্চলে বেশ কিছু গাছ-পাথরের সন্ধান আমরা পেয়েছি। সবচেয়ে বেশি গাছ-পাথর পাওয়া গেছে ভারতের বীরভূম ও বাকুড়া এলাকায়। প্রতিটি গাছের মধ্যেই ওই নির্দিষ্ট এলাকার আবহাওয়া ও এর পরিবর্তন, সময়কালসহ অনেক ধরনের তথ্য জৈবিক ভাগেই লিপিবদ্ধ থাকে।

আরেকটু ব্যাখ্যা করে বলবেন?
নাইজেল হিউজ: এটা খুবই সহজ। যেমন কোনো গাছ একেকটি বছর পার করার পর তার গুঁড়ির মধ্যে নতুন একটি গোল রেখা সৃষ্টি করে। প্রতিটি রেখার পুরুত্ব ও একটি রেখার সঙ্গে আরেকটি রেখার দূরত্ব দেখে অনুমান করা যায় ওই বছরের আবহাওয়া কেমন ছিল। হাজার বছরের পরিক্রমায় একটি গাছ ধীরে ধীরে পাথরের মতো শক্ত হয়ে যায়। তবে তার বয়স, আবহাওয়ার প্রভাব রয়ে যায়। আমি আমার গবেষণাগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করে চিন্তা করি ও লিখি। প্রথমত, আমি বৈজ্ঞানিক জার্নাল ও একাডেমিক পরিসর এবং দ্বিতীয়ত, সাধারণ পাঠকদের কথা চিন্তা করে আমি লিখি। সাধারণ পাঠকেরা যাতে তাঁদের এলাকার হাজার বছরের পুরোনো ইতিহাস বুঝতে পারেন, সে জন্য আমি বই লিখেছি। মনীষা নামের একটি কিশোরীর জিজ্ঞাসু মনে কীভাবে বাংলা অঞ্চলের প্রাচীন ইতিহাস ধরা দেয়। কীভাবে সে গাছ-পাথরের মাধ্যমে ইতিহাস বোঝার চেষ্টা করে, তা ঘটনাপরম্পরায় তুলে ধরেছি।
মনীষা চরিত্রটি কাল্পনিক হলেও তার অভিজ্ঞতা ও বিশ্লেষণ আসলে এই অঞ্চলের ইতিহাসের সূত্র খুঁজতে ও রহস্য বুঝতে সহায়ক হবে। ইংরেজিতে লেখা ওই বইটি অনুবাদ করেছেন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও আমার কাছের বন্ধু দীপেন ভট্টাচার্য। ভারতে শান্তিনিকেতন ও বাংলাদেশে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক বইটি তাদের বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছে। সামনের দিনে এ ধরনের আরও কিছু বই লিখতে চাই। এ অঞ্চলের মানুষের কাছে তাদের ইতিহাস সহজবোধ্য করে জানাতে চাই।

হাজার বছরের পরিক্রমায় একটি গাছ ধীরে ধীরে পাথরের মতো শক্ত হয়ে যায়
হাজার বছরের পরিক্রমায় একটি গাছ ধীরে ধীরে পাথরের মতো শক্ত হয়ে যায়

গাছ-পাথর পরীক্ষা করে কী পেলেন। কেমন ছিল এই অঞ্চলের মাটি-পানি-বায়ু?
নাইজেল হিউজ: এখন পর্যন্ত যতটুকু জানতে পেরেছি, তাতে আমি নিশ্চিত যে এই অঞ্চলটি জীববৈচিত্র্যের দিক থেকে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ অঞ্চল ছিল। এই অঞ্চলটি কী করে পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতি এলাকায় পরিণত হলো, তার কারণও লুকিয়ে আছে এখানকার ভূমির গঠন-প্রক্রিয়ায়। এই হাজার বছরের পথপরিক্রমায় বনাঞ্চলের সৃষ্টি হয়েছে, তা আবার পলি পড়ে মাটির নিচে চাপা পড়েছে। বনভূমির বৃক্ষ ছাড়া অন্য প্রাণীদের দেহও এখানকার মাটির স্তরে স্তরে মিশে আছে। বাংলার নদী ও কৃষির টানে এখানে এসে মানুষ বসতি গেড়েছে। কিন্তু এখানকার মাটির নিচে স্তরে স্তরে রয়ে গেছে ওই বন ও প্রাণীদের ফসিল। এর অনেক কিছুই এখন খনিজ পদার্থে পরিণত হয়েছে।

মনীষার পাথরের বন
মনীষার পাথরের বন

মনীষার পাথরের বন

নাইজেলের লেখা মনীষার পাথরের বন বইতে সেই আদিকালের বন ও বন্য প্রাণীদের বিবরণ উঠে এসেছে। বিশাল আকৃতির চতুর্দন্তী হাতি আর বাঘ তখন বাংলার বনে ঘুরে বেড়াত। গলা অত লম্বা নয়, এমন ধরনের জিরাফ আর গায়েগতরে ছোট কিন্তু লম্বা শিংয়ের অধিকারী হরিণের দলও এখানকার বনে চষে বেড়াত, নদীতে পানি খেত। তখন গাছ ও গাছের পাতাগুলোও ছিল অনেক বড় বড়। বইয়ের এসব বর্ণনা অবশ্য নাইজেল কল্পনা থেকে দেননি। দিয়েছেন গাছ-পাথর আর ফসিল পরীক্ষা করে তার ফলাফল বিশ্লেষণ করে।