কোথায় আমাদের নতুন প্রজন্মের মূল্যবোধ?

নববর্ষের দিন উৎসবমুখর পরিবেশে বাঙালি মেতে উঠেছিল আনন্দ-উল্লাসে। তরুণ-তরুণী, শিশু-কিশোর, অভিভাবকসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মিলনমেলা এবং নানা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে প্রতিবছর বাংলা নববর্ষ পালন করা হয়। এবারের নববর্ষও এর ব্যতিক্রম ছিল না। কিন্তু নববর্ষের সব আয়োজন ম্লান করে দিল কিছু বখাটের ন্যক্কারজনক কার্যকলাপ। বুধবার সব পত্রপত্রিকা, সংবাদ ও যোগাযোগমাধ্যম ছেয়ে যায় কিছু নারীকে লাঞ্ছনার খবরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি-সংলগ্ন এলাকা, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসসহ বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্নভাবে নারীরা লাঞ্ছিত হন। কিছু সংঘবদ্ধ যুবক পূর্বপরিকল্পনা মোতাবেক এসব কাজগুলো করেছে।

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, পুলিশ এসব ঘটনাস্থলের বেশ নিকট দূরত্বে অবস্থান করছিল এবং যথারীতি নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। আর সাধারণ জনতাও তাদের মতোই এমন দৃশ্য আগ্রহভরে দেখছিল। আমাদের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ বাহিনীর এমন আচরণ অবশ্য এই প্রথম নয়। দাবি করা হচ্ছে, এসব কুলাঙ্গার তরুণেরা রাজনৈতিক আশ্রয়ে এই কাজগুলো করছে। এই তরুণেরা কিন্তু আমাদের দেশেরই সন্তান। আর যে দেশে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও সাবেক বিরোধীদলীয় নেতা, স্পিকার সবাই নারী, সেই দেশে কেন নারী এত লাঞ্ছিত হবেন? ব্যক্তিগতভাবে আমার বিশ্বাস, আমাদের প্রধানমন্ত্রীসহ সব নারীনেত্রী এ ধরনের ঘটনায় ক্ষুব্ধ না হয়ে পারেন না। তাহলে কেন আপনারা এর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেবেন না? আপনাদের দলের নামে যদি উচ্ছৃঙ্খল যুবকেরা দেশের নারীদের ক্ষতি করে, তবুও কি আপনারা শুধু দলীয় স্বার্থে চুপ করে থাকবেন? আর যদি আপনাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে এরা এমন দুষ্কর্ম করে চলে, তবে কি আমরা আমাদের বিবেকের সামনে প্রশ্নবিদ্ধ হব না?

সত্য তিতা হলেও সত্য। সত্য হলো, প্রতিটি সামাজিক সমাবেশ, অর্থাৎ বইমেলা, ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৬ ডিসেম্বর, পয়লা বৈশাখ—এমন দিনগুলো কেন্দ্র করে কিছু বিকৃত মনমানসিকতার যুবক ইচ্ছাকৃতভাবে নারীদের লাঞ্ছিত করে। তারা তাদের বখাটে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে পরিকল্পনা করেই এ ধরনের কাজ করে। তাহলে এর সমাধান কী?

কিছু লোক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বলেতে চান, এসব ঘটনার জন্য লাঞ্ছিত নারীরাই দোষী। তাঁদের পোশাক ও সাজসজ্জার কারণে তাঁদের সঙ্গে এমনটি হয়। তা-ই যদি হবে, তাহলে আমার প্রস্তাব, সিগারেটের প্যাকেটে যেমন লেখা থাকে ‘ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, এটি নিজ দায়িত্বে গ্রহণ করবেন’; তেমনি বাংলাদেশের প্রতিটি উল্লেখযোগ্য দিবস এবং একে কেন্দ্র করে সব উৎসবের প্রবেশদ্বারে লিখে দিতে হবে, ‘এখানে নারীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ, যদি কোনো অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে, এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়’। এমন যদি লিখে দেওয়া হয়, তাহলে নারীরা আর কোনো উৎসবেই অংশগ্রহণ করবেন না এবং লাঞ্ছিতও হবেন না।

যেসব ব্যক্তি বলেন পোশাক ও সাজসজ্জার জন্য নারী ধর্ষিত এবং লাঞ্ছিত হন; তাঁদের কাছে আমার প্রশ্ন, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে নারীরা তো বেশির ভাগ বোরকা পরেই চলেন। তবুও কেন তাঁরা ধর্ষণের শিকার হন? আর কোনো নারী যদি উগ্র পোশাকও পরিধান করেন, তার মানেই কি তিনি চান ধর্ষণের শিকার হতে? নারীদের পোশাকের দিকে আঙুল না তুলে প্রথমে আমাদের কিছু বিকৃত মানুষের মানসিকতায় পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। রাজনীতিকে পুঁজি করে যারা এসব অপকর্ম করেছে, সেসব পথভ্রষ্ট মানুষকে চিহ্নিত করে সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে বর্জন করতে হবে। তাদের আইনের আওতায় এনে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। সব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে সর্বোপরি সাধারণ জনগণ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও যুব সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের যে ভাইয়েরা সেই দিন নিজেদের আহত করে, আমাদের বোনগুলোকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন, সাধারণ জনতার পক্ষ থেকে তাঁদের প্রতি আমাদের আন্তরিক ধন্যবাদ। এই জাতীয় সভ্য সংস্কৃতি, প্রতিবাদী ও মানবতাবাদী তারুণ্য কবে আমরা পাব?

কিছু বিবেকবান মানুষ বেঁচে আছেন বলেই আজও সমাজ বেঁচে আছে। সবশেষে বলতে চাই, আমাদের দেশের প্রতিটি উৎসবের দিন বিভিন্ন উৎসবমুখর স্থানে নারীদের নিরাপত্তার জন্য সিসিটিভি, অতিরিক্ত পুলিশ, গোয়েন্দা সদস্য, নারীদের পৃথক লাইনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশের বিভিন্ন সামাজিক উৎসবে অনেক বিদেশি নারী-পুরুষকে অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়। নিরাপত্তা নিশ্চিত না করা গেলে, একবার ভেবে দেখুন, বিশ্বব্যাপী সভ্যসমাজে আমাদের দেশের তারুণ্য সম্পর্কে কেমন ধারণা হবে?

সাদিয়া আহমেদ, শিক্ষার্থী, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়