ইশতেহারে নারীর কথা

সিটি নির্বাচন ২০১৫
সিটি নির্বাচন ২০১৫

প্রতিদিন সকালে বের হয়ে বাসের লম্বা লাইনে দাঁড়ানো, রীতিমতো যুদ্ধ করে বাসে চড়া, মহিলা সিট দখল করে বসে থাকা পুরুষদের সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডা, ভিড়ের সুযোগে গায়ে চেপে আসা হাতগুলো ঠেলে সরানো, একরকম চলন্ত বাস থেকেই নামা—এসব পেরিয়ে অফিসে পৌঁছে তবে এক দণ্ড শান্তি। দিনের শুরুটাই এভাবে হয় ঢাকা শহরের হাজারো নারীর। বাড়ি ফেরার সময়েও একই রকম যুদ্ধ। এর মাঝে যদি বেরোনোর প্রয়োজন পড়ে, তবে তো আরও দুর্ভোগ। পথের মধ্যে টয়লেটের প্রয়োজন হলে খুঁজে বেড়াতে হবে কাছাকাছি কোনো পরিচিত বাড়ি আছে কি না। কিংবা বড়জোর কোনো শপিং মলে ঢুকে পড়া। ফুটপাত ধরে হাঁটা মানেই অবধারিত কানে উড়ে আসবে বাজে কোনো মন্তব্য। ঘুরে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করার কোনো মানে হয়! গায়ে হাত তো দেয়নি!
এমন পরিস্থিতিতে আশার কথা, রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনের এবারের মেয়র নির্বাচন। ইশতেহারে এ সমস্যাগুলো সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন বেশির ভাগ মেয়র প্রার্থীই। নারীনেত্রীরা বিষয়টা দেখছেন খুব ইতিবাচকভাবে। সমস্যাগুলো তো অন্তত স্বীকার করা হলো, এবার বাস্তবায়নের পথে এগোনো যাবে। এ নিয়ে কথা হয় এবারের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কয়েকজন মেয়র পদপ্রার্থীর সঙ্গে।
নারীদের জন্য পাবলিক টয়লেট, আলাদা যানবাহন, কর্মজীবী নারীদের হোস্টেল, মায়েদের সুবিধার জন্য দিবাযত্নকেন্দ্র—এ বিষয়গুলোর প্রতিশ্রুতি দেখা যাচ্ছে বেশির ভাগ ইশতেহারে। নারীবান্ধব নিরাপদ ঢাকা শহর গড়ে তুলতে কাজ করার অঙ্গীকার করছেন তাঁরা। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আওয়ামী লীগ-সমর্থিত মেয়র পদপ্রার্থী আনিসুল হক জানালেন, বাস্তবায়ন করা সম্ভব এমন লক্ষ্য নিয়েই এগোচ্ছেন তাঁরা। নারীদের জন্য আধুনিক একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ইচ্ছার কথাও জানালেন। ‘নিজের প্রতিষ্ঠানে নারীদের নানা সমস্যার সমাধানে কাজ করেছি। এ ব্যাপারে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আছে বলেই আমি মনে করি, মেয়র নির্বাচিত হলে ভালোভাবে কাজ করতে পারব।’ বললেন তিনি।
ঢাকা উত্তরের বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থী তাবিথ আউয়াল এসবের সঙ্গে যোগ করেছেন মা ও শিশুস্বাস্থ্যের বিষয়টিও। শিশুর জন্ম থেকে পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত বিনা মূল্যে মা ও শিশুর চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হবে প্রতি ওয়ার্ডে। নারী কাউন্সিলরদের আরও সক্রিয় করতে কাজ করবেন। সিটি করপোরেশনভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতে কোটার মাধ্যমে হলেও নারীর কর্মসংস্থান বাড়ানোর চেষ্টা করবেন তাবিথ আউয়াল।
জোনায়েদ সাকি কাজ করতে চান তৃণমূল পর্যায় থেকে। ‘এই শহর আসলে নারীবিদ্বেষী শহর, এর প্রমাণ মেয়েদের জন্য এখানে টয়লেটের ব্যবস্থা নেই। এর প্রভাবে নানা রকম রোগে ভুগছেন তাঁরা। বাইরে কাজ করাও কঠিন হচ্ছে তাঁদের জন্য।’ বললেন তিনি। এরপরই পরিবহনব্যবস্থায় জোর দেবেন বলে জানালেন। দিবাযত্নকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার জন্য কারখানাগুলোকে বাধ্য করার চিন্তাও আছে। তবে তিনি এ-ও বললেন, ‘নিরাপত্তার প্রশ্নে সিটি করপোরেশনের ক্ষমতা খুব সীমিত। বর্তমান কাঠামোর মধ্যে থেকেই যতটা সম্ভব কাজ করা হবে। যেমন কমিউনিটি পুলিশ, রাস্তায় আলোর ব্যবস্থা করা, মেয়েদের আত্মরক্ষার কৌশল শেখানো ইত্যাদি।’
দরিদ্র নারীদের জন্য কাজ করার অঙ্গীকার করলেন আবদুল্লাহ আল ক্বাফীও। নারীর প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা উন্নত করতে নানা ব্যবস্থা নেবেন বলে জানালেন। ‘ঢাকা শহরের দরিদ্র নারীদের সঙ্গে কথা বলে সমস্যাগুলো বুঝতে চেষ্টা করেছি। এ শহরের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা যে জীবনযাপন করেন, তা মানুষের জীবন বলা যায় না। সবার জন্য মানবিক ঢাকা গড়ে তুলতে চাই।’ বলেন ক্বাফী।
ইশতেহারে নির্দিষ্ট করে ইভ টিজিং কমানোর জন্য কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেছেন ঢাকা উত্তরের প্রার্থী মাহী বি চৌধুরী। ২৪ ঘণ্টার হটলাইন চালুর কথা জানালেন তিনি। যেকোনো নারী এই নম্বরে ফোন করে মনোরোগবিশেষজ্ঞের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে পারবেন। যে সমস্যার কথা চেনা কাউকে বলতে পারা যাচ্ছে না, তা এখানে বলে সহায়তা পাওয়া যাবে। এ ছাড়া সিটি করপোরেশনের যেকোনো কমিটিতে নারী-পুরুষ সমান অংশগ্রহণের ব্যবস্থা করবেন। ‘যেকোনো নির্বাচনে নারী ভোটারদের ব্যাপক সমর্থন পেয়েছি আমি। আমার কাছে তাঁদের প্রত্যাশা অনেক বলে মনে হয়। এ কারণে আমার তাঁদের প্রতি দায়িত্বটাও বেশি।’ বলেন তিনি।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওয়ামী লীগ-সমর্থিত মেয়র পদপ্রার্থী সাঈদ খোকন গুরুত্ব দেবেন সমান অধিকার প্রতিষ্ঠায়। দক্ষিণের বিএনপি–সমর্থিত মেয়র পদপ্রার্থী মির্জা আব্বাস নারীদের জন্য পাবলিক টয়লেটের ব্যবস্থা করার কথা বলেছেন ইশতেহারে।
বেশিরভাগ প্রার্থীর ইশতেহারে ঢাকা শহরে নারীর সমস্যা সমাধানে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপের কথা বলা আছে। প্রার্থীরা জানালেন, সেসব পূরণে তাঁদের সদিচ্ছাও আছে। কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ না বাড়ালে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। আর সে জন্য চাই নারীবান্ধব শহর গড়ে তোলা। এ ব্যাপারে একমত প্রায় সব প্রার্থী। নারীনেত্রীরা এ বিষয়টি দেখছেন তাঁদের দীর্ঘ আন্দোলনের সুফল হিসেবে। তবে সেসব প্রতিশ্রুতি বাস্তবে পূরণ হওয়াও চাই।


এই বিষয়টি খুব ইতিবাচক

এলিনা খান
আগে দেখা যেত, পরিবারের পুরুষেরা যা বলছেন, নারীরা সেই অনুযায়ীই ভোট দিচ্ছেন। ভোট দিয়ে নিজের মত প্রকাশের কথাটা তাঁরা ভাবতেন না। তবে এখন পরিস্থিতি বদলেছে। তাঁদের নিজস্ব মতামতের প্রতিফলন হতে দেখা যাচ্ছে। সে কারণে প্রার্থীরাও নারী ভোটারদের কথা আলাদা করে ভাবছেন। এবারের ইশতেহারগুলোতে সেটা ফুটে উঠেছে।
এই বিষয়টি খুব ইতিবাচক যে, নারীবান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলার সুনির্দিষ্ট চেষ্টা তাঁদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে। কতটুকু বাস্তবায়িত হবে, সেটা পরের কথা। এই উদ্যোগটাই যথেষ্ট প্রশংসনীয়। তবে এ জন্য সংবাদপত্র আর টক শোগুলো ধন্যবাদ পাবে। নারীরা তাঁদের মত তুলে ধরতে পারছেন এ প্ল্যাটফর্মগুলোতে। নারী ভোটারদের কাছে অনুরোধ, তাঁরা যেন একজন প্রার্থীর সার্বিক দিক বিবেচনা করেই ভোট দেন।

প্রধান নির্বাহী, বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন

মনে করিয়ে দিতে চাই নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা
ফারাহ কবীর
নারীদের জন্য পানি, আবাসন, যানবাহনের পাশাপাশি মনে করিয়ে দিতে চাই নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা। নগরপিতা হিসেবে এটা তাঁরই দায়িত্ব। পুলিশের সঙ্গে মিলেই তিনি কাজ করবেন। তাঁদের মনে করিয়ে দেবেন এ দায়িত্বের কথা। মেয়রের কাছে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

নির্বাহী পরিচালক, অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ