নবীনের নজরুল

শুধু পোশাকে নয়, তরুণেরা নানাভাবে ধারণ করে নজরুলকে। মডেল: কর্ণ ও শোয়েব, পোশাক: নিত্য উপহার, ছবি: খালেদ সরকার
শুধু পোশাকে নয়, তরুণেরা নানাভাবে ধারণ করে নজরুলকে। মডেল: কর্ণ ও শোয়েব, পোশাক: নিত্য উপহার, ছবি: খালেদ সরকার

‘আমার আপনার চেয়ে আপন যেজন, খুঁজি তারে আমি আপনায়।’ নজরুল নিশ্চয়ই জানতেন না, তাঁর লেখা এই পঙ্ক্তি একবিংশ শতাব্দীর কোনো এক বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া তরুণীর ‘ফেসবুক স্ট্যাটাস’ হয়ে শোভা পাবে।
ফেসবুকের ‘হোয়াটস অন ইওর মাইন্ড?’ প্রশ্নের উত্তরে প্রায়ই কাজী নজরুল ইসলামের গান থেকে দু-একটা লাইন তুলে দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ছাত্রী মৌটুশি রহমান। ‘বিদ্রোহী কবি হিসেবেই তাঁর পরিচিতি বেশি। আমার কাছে কিন্তু প্রেমের কবি হিসেবেই নজরুল বেশি প্রিয়। মাঝে মাঝে ছুটির দিনে খুব সকালবেলা নজরুলের গান শুনি। গানের কথাগুলো মাথার ভেতর ঘুরতেই থাকে।’ বলছিলেন মৌটুশি।
মৌটুশির সঙ্গে অবশ্য মতের পুরোপুরি মিল হলো না বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক ছাত্র সৌরভ মণ্ডলের। তাঁর কাছে প্রেমের চেয়ে নজরুলের লেখায় বিদ্রোহ প্রকাশ পেয়েছে আরও চমৎকারভাবে। সৌরভ মনে করেন, এখনো যেকোনো প্রতিবাদ-আন্দোলনের সঙ্গে আশ্চর্যভাবে বিদ্রোহী কবির বলা কথাগুলো মিলে যায়। প্রেরণা জোগায়। তবে অন্য লেখাগুলোও তাঁর খুব প্রিয়। সৌরভ বলেন, ‘বাসায় সঞ্চিতা আছে। মাঝেমধ্যেই পড়ি। কাজী নজরুলের “অভিশাপ” কবিতাটা আমার সবচেয়ে প্রিয়। তবু, আমি মনে করি বিদ্রোহী কবি হিসেবেই তিনি বেশি উজ্জ্বল। “কারার ওই লৌহ কপাট” কিংবা “দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার...”র মতো লেখাগুলোতে যে জোশ, আমার মনে হয় দেশে-বিদেশে আর কারও লেখায় এমনটা নেই।’
‘আমি এক পাড়াগেয়ে স্কুলপালানো ছেলে। তার ওপর পেটের ভেতর ডুবুরী নামিয়ে দিলেও ক অক্ষর খুঁজে পাওয়া যাবে না। স্কুলের হেডমাস্টারের চেহারা মনে করতেই আমার আজও জলতেষ্টা পেয়ে যায়।’ এমনটাই লিখেছিলেন নজরুল। স্কুলপালানো ছেলেটির লেখা কবিতাগুলোই ছোটবেলা থেকে পাঠ্যবইয়ে পড়ে পড়ে বেড়ে উঠেছেন আজকের তরুণেরা। তাঁরা নজরুলকে ধারণ করেছেন নিজেদের মতো করে। বইয়ের পাতা থেকে নজরুল টি-শার্টে উঠে এসেছেন। একসময় গ্রামোফোনে বাজত যাঁর গান, আজকাল সাউন্ডক্লাউড-ইউটিউবে তা গেয়ে কিংবা কবিতা আবৃত্তি করেও আপলোড করছেন কেউ কেউ। নাচের শিল্পী, ইস্টওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সোমেশ্বরী পারমিতার কাছেও নজরুলের গান খুব প্রিয়। বলছিলেন, ‘নজরুলের গানের রিদম খুব ভালো। অনেক বৈচিত্র্যও আছে। ছোটবেলা
থেকে “শুকনো পাতায় নূপুর বাজে” গানটার সঙ্গে অসংখ্যবার নেচেছি। গানটা খুব ভালো লাগে। কোরিওগ্রাফিও খুব সুন্দর।’
‘সত্যি বলতে, পাঠ্যবইয়ের বাইরে নজরুলের কবিতা খুব একটা পড়া হয়নি।’ আলাপের শুরুতেই বলছিলেন বেসরকারি ব্যাংকের কর্মী আবু কায়েস। আরও বললেন, ‘ছোটবেলায় দুখু মিয়ার কাহিনি পড়ে অবাক হতাম খুব। কোথা থেকে কোথায় উঠে এসেছেন। কবিতা খুব একটা পড়া না হলেও তাঁর গান শুনি। নজরুলের গান শুনলেই বুঝি এটা তাঁর লেখা। শব্দচয়নগুলো একটু অন্য রকম। খুব ভালো লাগে।’
তাই বলে আজকের দিনে সব তরুণই যে নজরুলকে ভালো করে জানেন-পড়েন-শোনেন, এমনটাও নয়। সেই যে শুরুতে মৌটুশির লেখা ফেসবুক স্ট্যাটাসের কথা বলছিলাম; স্ট্যাটাসের নিচে প্রথম কমেন্টটার কথাই ধরুন। মৌটুশির একজন বন্ধু লিখেছেন, ‘বাহ! ভালো তো। তুই আজকাল কবিতা লেখা শুরু করলি নাকি?’
মুশকিল!
তারপরও নজরুল বিরাজ করেন আজকের তরুণদের মনে। ফেসবুক, ইউটিউব তার সাক্ষী।