তিনি রেলের টিটিই

আলিয়া জাহান
আলিয়া জাহান

ঘড়িতে সকাল ৯টা ১০ মিনিট। তিতুমীর এক্সপ্রেস সান্তাহার ছাড়ল। জানালা গলিয়ে চোখ চলে গেছে বিস্তীর্ণ মাঠে। হঠাৎ কানে এলো এক নারীকণ্ঠ, ‘৫০০ টাকা দিন। টিকিট দিয়ে টাকা ফেরত নিয়ে যান।’ ট্রেনের ভেতরে নারীকণ্ঠের এমন দাপট তো শোনা যায় না। ঘাড় ঘোরাতেই দেখা গেল সাদা অ্যাপ্রোন পরা একজন নারী। অ্যাপ্রোনে লেখা রয়েছে টিটিই। দক্ষ হাতে টিকিটে সই করছেন।
পাশে বসে ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের শিক্ষক আনিসুজ্জামান। বললেন, ‘কোনো নারীকে টিটিইর দায়িত্বে এই প্রথম দেখলাম। এই টিটিইর সঙ্গে কথা বলে তাঁর অনুভূতির কথা জানতে পারলে সেটা একটা নতুন অভিজ্ঞতা হবে।’ ততক্ষণে টিটিই আরেকটু সামনের দিকে এগিয়ে গেছেন। আনিসুজ্জামান ডাক দিলেন। টিটিই এসে বসলেন। কোনো জড়তা নেই। সাবলীল ভঙ্গিতে কথা বলতে শুরু করলেন।
তাঁর নাম আলিয়া জাহান (৫০)। বাড়ি বগুড়ার সান্তাহারে। জানা গেল তিনি বাংলাদেশ রেলওয়ের একজন ট্রেন টিকিট এক্সামিনর (টিটিই)। তার সঙ্গে আরও একজন নিয়োগ পেয়েছেন এই পদে। তিনি নার্গিস পারভীন। দেশে এই দুজন ছাড়া আর কোনো নারী টিটিই পদে নেই।
আলিয়া জাহান বলেন, তাঁরা দুজনে একই সঙ্গে এ চাকরিতে ঢুকেছেন। রাজশাহী ও চিলাহাটির মধ্যে চলাচলকারী তিতুমীর এক্সপ্রেস এবং ঢাকাগামী নীলসাগর ট্রেনের দায়িত্ব তাঁর। নার্গিস পারভীন পার্বতীপুর ও ঢাকার মধ্যে চলাচলকারী ট্রেনের দায়িত্বে থাকেন।
কথা বলতে বলতেই ট্রেনের যাত্রীরা বুঝে ফেলেছেন টিটিইর সাক্ষাৎকার নেওয়া হচ্ছে। চারিদিক থেকে যাত্রীরাও ঘিরে ধরে টিটিইর জীবনী শোনার জন্য দাঁড়িয়ে গেছেন। আলিয়া জাহানের সেদিকে খেয়াল নেই। তিনি বলেই যাচ্ছেন। চাকরির পরীক্ষা, নিয়োগ, যোগদানের সাল তারিখ সব তাঁর মুখস্থ।
আলিয়া জাহান ১৯৮৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর চাকরির মৌখিক পরীক্ষা দিয়েছিলেন। সে মাসেই সান্তাহার কলেজ থেকে তিনি বিএ পরীক্ষা দেন। ১৯৮৪ সালে তিনি স্টেশনের ‘টিকিট কালেক্টর’ পদে যোগদান করেন। একই পদে নার্গিস পারভিনও যোগদান করেছিলেন। নার্গিস ১৯ জুন আর তিনি ১৩ জুলাই। একই সঙ্গে ২০১৩ সালে তাঁরা টিটিই হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন।
আলিয়া জাহানের অফিস হচ্ছে সান্তাহার জংশন স্টেশনে। প্রতিদিন সকালে তাঁকে সান্তাহার থেকে ট্রেনে উঠতে হয়। চিলাহাটি থেকে ফেরার সময় আবার সান্তাহারে এসে নেমে যান। কোনো কোনো দিন তাঁকে রাজশাহীতেও যেতে হয়। আবার নীলসাগরে ঢাকা পর্যন্তও যেতে হয়। দিনে-রাতে ট্রেনে এই কাজ করতে কোনো সমস্যা হয় কি না জানতে চাইলে আলিয়া জাহান বলেন, ‘বড় রকমের সমস্যা কোনো দিনই হয়নি।’
অনেকেই ট্রেনের টিকিট কাটেন না। বিনা টিকিটে ট্রেন ভ্রমণের প্রবণতা অনেকের মধ্যেই আছে, তাদের কীভাবে মোকাবিলা করেন? আলিয়া জাহানের জবাব ‘নারী হওয়ার কারণে আরও সুবিধা। কেউ আমার সঙ্গে বেশি ঝামেলা করতে চায় না। তাড়াতাড়ি টাকা দিয়ে টিকিট কিনে নেন।’
আলিয়ার বাবা আলিফ উদ্দিন ঢাকা বিভাগের টিটিই ছিলেন। বাবার উৎসাহেই তিনি এই পেশায় যোগ দিয়েছেন বলে জানান। কথা বলতে বলতে চলে এল হিলি স্টেশন। নারী এই টিটিইর সঙ্গে আলাপচারিতা শেষ হলো তখনকার মতো।