গল্পে শোনা বাবা

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তাঁর বাবাকে নিয়ে এই লেখাটি লিখেছেন ড্রিমস ফ্রম মাই ফাদার বইতে। আজ বাবা দিবস উপলক্ষে লেখাটি প্রকাশিত হলো।
বারাক ওবামা
বারাক ওবামা

মনে পড়ছে, মা ও নানার সঙ্গে কাটানো ছোটবেলার কথা। একটা আমগাছের নিচে বসে আমার চুলে হাত বোলাতে বোলাতে নানির কাছে শোনা বাবার গল্প। আমার ছোটবেলা জুড়ে ছিল এক অকল্পনীয় সারল্য। আশপাশের মানুষের মধ্য থেকে যে সারল্য হারিয়ে গেছে অনেক আগেই।
আমার শ্বেতাঙ্গ মা ও কৃষ্ণাঙ্গ বাবা অনেক বেশি জানতেন, অনেক কিছু দেখেছিলেন তাঁরা। আফ্রিকান আর আমেরিকান মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি তাঁদের হৃদয়ে মিশে ছিল। যারা আমাকে চিনত না, আমার পরিচয় আবিষ্কার করে (আবিষ্কার বলছি এ জন্য যে ১২-১৩ বছর বয়সে আমি কেবল আমার মায়ের কথাই বলে যেতাম, যাতে আমাকে শ্বেতাঙ্গদের একজন বলে মনে হয়) সেটা হজম করে নিতে তাদের কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করতে হতো। তারা আসলেই আর আমাকে বুঝে উঠতে পারত না। মিশ্র বংশপরিচয়, মানসিক দ্বন্দ্ব আর দুই মেরুর বিপরীত অনুভূতি তাদের বোঝানো যেত না। আমি মানুষকে তাদের সন্দিহান মনের জন্য দোষ দিই না। আমি অনেক আগেই আমার ছোটবেলার গল্প থেকে নিজেকে আলাদা করে নিতে শিখেছিলাম। অনেক পরে, যখন আমি আফ্রিকার লালচে মাটিতে আমার বাবার কবরের পাশে বসে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছি, কেবল তখন আমার শৈশব আমার কাছে ফিরে এসেছিল। তখনই আমি বুঝতে পেরেছিলাম, কত দীর্ঘ সময় ধরে আমি আমার জীবনের গল্প নতুন করে লিখতে চেয়েছি। আমার ইতিহাসকে নতুন করে সাজাতে চেয়েছি। আমার দুর্বলতা, ব্যর্থতা লুকিয়ে নিজের শৈশব আর পরিবারকে আগলে রাখতে চেয়েছি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিজেকে বাঁচিয়ে চলার আপ্রাণ চেষ্টা, পিতার খোঁজে এক ছেলের অন্তহীন যাত্রা এবং একজন কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানের সংগ্রামের গণ্ডি থেকে আমি বের হতে পারিনি।

.
.

বাবা যখন মারা যান, তখন তিনি আমার কাছে ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে আসা একটা অস্তিত্ব। তিনি হাওয়াই ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন সেই ১৯৬৩ সালে, আমি তখন দুই বছরের শিশু। তাই ছোটবেলায় বাবার স্মৃতি বলতে মা আর নানা-নানির বলা গল্পগুলোই ছিল সম্বল।
‘তোমার বাবা একটু কর্তৃত্বপরায়ণ ছিল ঠিকই’, মা অল্প হেসে বলতেন, ‘কিন্তু প্রচণ্ড সৎ ছিল বলেই এমন করত, সবকিছু মুখ বুজে মেনে নেওয়া তার স্বভাবের মধ্যে ছিল না।’
বাবাকে নিয়ে মায়ের প্রিয় গল্প ছিল, যখন বাবা একটা বড় অনুষ্ঠানে জিনস আর চিতার ছাপওয়ালা একটা পুরোনো শার্ট পরে পুরস্কার নিতে এসেছিলেন! ‘কেউ তাকে বলেনি এত জমকালো একটা অনুষ্ঠান হবে, সে এত বড় সম্মান পেতে যাচ্ছে। সে গটগট করে ভেতরে ঢুকে দেখে, রুমভর্তি সব মানুষ ডিনারের জ্যাকেট পরে এসেছে! জীবনে আমি সেই একবারই তাকে লজ্জিত হতে দেখেছি।’
‘কিন্তু একটা জিনিস জানো ব্যারি, তোমার বাবা, যেকোনো পরিস্থিতি সামাল দিতে পারত, তা যা-ই হোক না কেন। আর এ জন্যই সবাই তাকে পছন্দ না করে পারত না।’
গল্প শেষে নানা মাথা নাড়তে নাড়তে উঠে যেত, আর বলত, ‘বাবার কাছ থেকে একটা জিনিস তোমার শেখা খুব দরকার। আত্মবিশ্বাস। সফল হতে হলে এর কোনো বিকল্প নেই।’
এভাবে আমি বসে বসে বাবার গল্প শুনতাম। তাঁর কিছু সাদা-কালো ছবি ছিল, আলমারির ভেতর রাখা। আমি একটু বড় হয়ে গেছি যখন, তত দিনে মায়ের সম্পর্ক শুরু হয়েছে আর একজনের সঙ্গে, যাকে পরে মা বিয়ে করেন। আমাকে কেউ না বললেও আমি বুঝতাম, কেন বাবার ছবিগুলো আলমারির ভেতর ফেলে রাখা হয়। কালেভদ্রে আমি আর মা মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে ধুলোমাখা অ্যালবামটা দেখতাম। আমি একদৃষ্টে বাবার দিকে তাকিয়ে থাকতাম, হাসিতে ভরা একটা মুখ, চওড়া কপাল আর চোখে পুরু চশমা, তাতে বয়সের চেয়েও বড় দেখায়। এই মানুষটাই আমার বাবা।
বাবা ছিলেন আফ্রিকান, আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে, কেনিয়ার লুও গোত্রের। তার জন্ম হয়েছিল ভিক্টোরিয়া লেকের পাশে, অ্যালেগো নামে একটা জায়গায়। বাবার গ্রামের লোকজন ছিল বেশ গরিব, কিন্তু আমার দাদা হুসেইন ওনিয়াঙ্গো ওবামা ছিলেন খুব বড় চাষি, গোত্রের প্রধানের প্রায় সমকক্ষ। বাবা ছোটবেলায় ছাগল চরাত আর স্থানীয় স্কুলে পড়ত। স্কুলটা ছিল ব্রিটিশদের বানানো, খুব ভালো রেজাল্ট করে ওখান থেকেই স্কলারশিপ পেয়ে নাইরোবিতে পড়ার সুযোগ পান। কেনিয়া স্বাধীন হওয়ার কিছু আগে বাবা সুযোগ পান যুক্তরাষ্ট্রে এসে পড়াশোনা করার। বাবা ছিলেন প্রথম কয়েকজনের একজন, যাঁদের দেশের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয় পশ্চিমা প্রযুক্তি শিখে এসে নতুন আফ্রিকা গড়ার জন্য।
১৯৫৯ সালে বাবা ইউনিভার্সিটি অব হাওয়াইয়ে এসে পৌঁছান। তিনি ছিলেন এখানকার প্রথম কালো শিক্ষার্থী। ইকোনোমেট্রিক্স নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন। অসম্ভব মেধাবী বললে ভুল হবে না। প্রচণ্ড মনোযোগ দিয়ে কাজ করে তিন বছরের মাথায় গ্র্যাজুয়েশন করেন, তাও আবার ক্লাসে ফার্স্ট হয়ে। ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন গড়ে তুলতে তিনি সহায়তা করেন, আর সেখানকার প্রথম সভাপতিও নির্বাচিত হন। একটা রাশিয়ান কোর্সে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় এক লাজুক মার্কিন মেয়ের, বয়স মাত্র ১৮। তাঁরা একে অপরকে ভালোবেসে ফেলেন। মেয়েটির বাবা-মা প্রথমে খুবই চিন্তিত ছিলেন, কিন্তু ছেলেটির ব্যক্তিত্ব আর বুদ্ধি দেখে মুগ্ধ হয়ে তাঁরা আর না করতে পারেননি। খুব শিগগিরই তাঁদের বিয়ে হয়, এক ছেলেরও জন্ম হয়। নিজের নামে ছেলের নাম রাখেন তিনি ‘বারাক’। তারপর আরেকটা স্কলারশিপ পান হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করার জন্য, কিন্তু নতুন পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার মতো আর্থিক সংগতি ছিল না। আলাদা হয়ে যান তাঁরা। পড়াশোনা শেষে বাবা আফ্রিকায় ফিরে যান, মায়ের সঙ্গে একমাত্র ছেলে থেকে যায় বহুদূরে। কিন্তু দূরত্ব যতই হোক, ভালোবাসা থেকে যায়।
সূত্র: বারাক ওবামার ড্রিমস ফ্রম মাই ফাদার বইয়ের প্রথম অধ্যায়। ইংরেজি থেকে নির্বাচিত অংশের অনুবাদ: অঞ্জলি সরকার