আপন আলোয় অনন্য

র​াশিদা ফেরদৌস। ছবি: আবদুল মোমিন, মানিকগঞ্জ
র​াশিদা ফেরদৌস। ছবি: আবদুল মোমিন, মানিকগঞ্জ

বাড়ির কাছের স্কুলে পড়াশোনা করে অষ্টম শ্রেণিতে রাশিদা ফেরদৌসকে যে স্কুলে ভর্তি হতে হয়েছিল, তার দূরত্ব ছিল পাঁচ কিলোমিটার। রাশিদা বললেন, ‘তখন কোনো যানবাহন ছিল না। সরিষাবাড়ী উপজেলার সেই পোগলদিঘা হাইস্কুলে প্রতিদিন কাঁচা রাস্তায় হেঁটে যেতাম। মাঝখানে আবার ছিল একটা নদী।’ হেঁটে, খেয়া পার হয়ে স্কুলে যাতায়াত করতেন রাশিদা। নবম শ্রেণিতে উঠে স্কুলের কাছাকাছি বয়ড়ায় ফুফুর বাড়ি থেকে পড়াশোনা চালিয়েছেন। সেই বাড়িতে ছিল না চেয়ার-টেবিল। মাটিতে পিঁড়ি পেতে পড়াশোনা করতে হয়েছে। এভাবেই স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়েছেন। যোগ দিয়েছেন সরকারি
চাকরিতে। রাশিদা ফেরদৌস এখন মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক।
দূরে গিয়ে পড়াশোনা করাই শুধু নয়, রাশিদা ফেরদৌসকে দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়তে হয়েছে। জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলার পোগলদিঘা ইউনিয়নের মালীপাড়া গ্রামে তাঁর জন্ম। কৃষক ও ক্ষুদ্র পাট ব্যবসায়ী আবদুস ছামাদ সরকারের পরিবারে সচ্ছলতা ছিল না। সাত মেয়ের মধ্যে রাশিদা ফেরদৌস তৃতীয়। নিজের অদম্য ইচ্ছার কারণেই চালিয়ে গেছেন পড়াশোনা।
১৯৮২ সালে রাশিদা পোগলদিঘা উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর সরিষাবাড়ী কলেজে ভর্তি হন তিনি। বাড়ি থেকে তিন কিলোমিটার হেঁটে এসে সরিষাবাড়ীর ট্রেনে চড়তেন। এভাবে কলেজে যাতায়াত করতেন প্রতিদিন। কলেজে ভর্তি হয়েই স্বপ্ন দেখেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। মেয়ের স্বপ্নে বাধা দেন না বাবা, তবে একটা শর্ত জুড়ে দেন। ‘বাবা আমাকে বলেছিলেন এইচএসসিতে প্রথম বিভাগ পেলে তবেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হবে।’ মানবিক শাখা থেকে প্রথম বিভাগ পাওয়া কঠিনই ছিল। কিন্তু ১৯৮৪ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় সরিষাবাড়ীর শুধু একজন মেয়ে মানবিক থেকে প্রথম বিভাগ পেয়েছিলেন। তাঁর নাম রাশিদা ফেরদৌস।
১৯৮৫ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে ভর্তি হন রাশিদা ফেরদৌস। সে বছরই মারা যান তাঁর বাবা। সাত মেয়ে নিয়ে দিশেহারা অবস্থায় পড়েন মা জরিনা বেগম। রাশিদাদের সবার বড় বোন মাজেদা বেগম তখন সরকারি চাকরি করতেন, আর আরেক বোন জহুরা খাতুন তখন সরকারি চাকরিতে যোগ দিয়েছেন। তাঁরাই সংসারের হাল ধরেন, ছোট বোনদের পড়াতে থাকেন।
রাশিদা ফেরদৌস বিএ (সম্মান) পরীক্ষা দেওয়ার পরই ১১তম বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নেন। এরপর বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসন ক্যাডারে নিয়োগ পান তিনি। ‘১৯৯৩ সালে কুমিল্লা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সহকারী কমিশনার ও ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে যোগ দিই।’ বললেন রাশিদা। এরপর ১৯৯৭ সালে হন প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট। ২০০৫ সালে গাজীপুরের শ্রীপুরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন। জেলা প্রশাসক হিসেবে মানিকগঞ্জে যোগ দেন ২০১৪ সালের ২৫ জুন।
১৯৯৭ সালে সামরিক কর্মকর্তা সৈয়দ হেলাল উদ্দিনের (বর্তমানে লেফটেন্যান্ট কর্নেল) সঙ্গে বিয়ে হয় রাশিদার। এই দম্পতির দুই সন্তান। মেয়ে সৈয়দা ফারিহা তাহসিন পড়ে ময়মনসিংহ গার্লস ক্যাডেট কলেজে এবং ছেলে ফাইয়াজ রেজওয়ান পড়ে ঢাকার স্কলাস্টিকা স্কুলে। রাশিদা জানালেন, বিয়ের পর স্বামীর পূর্ণ সহযোগিতা পেয়েছেন সব সময়। চাকরিতে ঢোকার পর তাঁর ছোট চার বোনকেও পড়াশোনা করান। সবাই মাস্টার্স শেষ করে এখন চাকরি করছেন। রাশিদা বলেন, ‘আমাদের পড়াশোনা করা দেখে গ্রামের অভিভাবকেরা ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠাচ্ছেন। আমার গ্রামের অনেক ছেলেমেয়ে সরকারি-বেসরকারি ভালো ভালো চাকরি করছে।’
পড়াশোনার প্রতি রাশিদা ফেরদৌসের আগ্রহ সব সময়ই। কর্মজীবন শুরুর পরও তিনি একাধিক ডিগ্রি নেন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০০৩ সালে এলএলবি পাস করেন। চীন সরকারের বৃত্তি নিয়ে ২০১৩ সালে কমিউনিকেশন ইউনিভার্সিটি অব চায়না থেকে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন তিনি।
কর্মজীবনে নিজের কাজের জন্য একাধিক পুরস্কার অর্জন করেছেন জামালপুর জেলা থেকে প্রথম নারী জেলা প্রশাসক রাশিদা ফেরদৌস। দরিদ্র শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় সহায়তা করেন নিয়মিতভাবে। সামাজিক উন্নয়নে এলাকাবাসীকে অংশগ্রহণ করতে উৎসাহ দেন। তিনি বললেন, ‘আমার ইচ্ছা শিক্ষার প্রসার ঘটিয়ে নিজের মালীপাড়া গ্রামকে একটি আদর্শ গ্রামে পরিণত করা।’ আর এ জন্যই তিনি এখন নিজেরগ্রামে একটি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছেন।