আকাশপথে হাঁটা!

>
সাইফুল ইসলাম
সাইফুল ইসলাম
প্রায় ১ হাজার ১৬৮ ফুট উচ্চতায় হেঁটে বেড়াচ্ছেন আপনি। কেমন হবে সেই অভিজ্ঞতা? পৃথিবীর অন্যতম রোমাঞ্চকর এক অভিজ্ঞতা হিসেবে স্বীকৃত কানাডার সিএন টাওয়ারের এজ ওয়াক বা প্রান্ত ঘেঁষে হাঁটার অভিজ্ঞতা শোনালেন সাইফুল ইসলাম।

‘এজ ওয়াক’ বাংলায় বলা যেতে পারে কোনো কিছুর প্রান্ত ধরে হেঁটে বেড়ানো। আর এই হাঁটাটি যদি হয় সমতল ভূমি থেকে ৩৫৬ মিটার বা প্রায় ১ হাজার ১৬৮ ফুট ওপরে খোলা আকাশের নিচে পৃথিবীর উচ্চতম কোনো স্থাপনার প্রান্ত ঘেঁষে, তাহলে তো বুঝতেই পারছেন ব্যাপারটা কতখানি রোমাঞ্চকর।
উত্তর আমেরিকার দেশ কানাডার টরন্টোর প্রাণকেন্দ্রে সিএন টাওয়ারের অবস্থান। পৃথিবীর উচ্চতম স্থাপনাগুলোর তালিকায় প্রায়ই উঠে আসে এই ভবনের নাম। প্রায় ৫৫৪ মিটার (১ হাজার ৮১৬ ফুট) এই টাওয়ারটির সত্যিকার নির্মাণ যাত্রা শুরু হয় ১৯৬৮ সালে।
সিএন টাওয়ারকে আমেরিকার সোসাইটি অব সিভিল ইঞ্জিনিয়ারস (এএসওসিই) ১৯৯৫ সালে পৃথিবীর অন্যতম সাতটি আধুনিক বিস্ময়ের একটি ঘোষণা করে। ২০১১ সালে সিএন টাওয়ার পরিচালনা পর্ষদ এক বিস্ময়ের জন্ম দেয়। প্রথমবারের মতো ‘এজ ওয়াক’ চালু করে তারা। অনেক বিখ্যাত চলচ্চিত্র ও উপন্যাসে উঠে এসেছে সিএন টাওয়ারের এই ‘এজওয়াক’। প্রতিবছর ১৫ লাখের বেশি মানুষ সারা পৃথিবী থেকে সিএন টাওয়ার পর্যবেক্ষণ করতে যায়। তাদের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকজন শুধু দুঃসাহসিক এজ ওয়াকে অংশ নেয়। শখের বশে নানা দেশ ঘুরেছি। সিনএন টাওয়ারের এই রোমাঞ্চকর এজ ওয়াকের অভিজ্ঞতা নেওয়ার ইচ্ছা ছিল বহুদিনের। সুযোগটা এল গত জুলাইতে ঈদের ছুটিতে।

অংশগ্রহণকারীদের ভাগ করা হয় একেকটি দলে। ছবি সরবরাহ: লেখক
অংশগ্রহণকারীদের ভাগ করা হয় একেকটি দলে। ছবি সরবরাহ: লেখক

আসমানে পাখা মেলো
দিনটি ছিল ১৮ জুলাই। প্রায় চার বছরের লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নের দিন। পরিবারের লোকজন যদি জানে, জানি যেতে দেবে না। তাই কাউকে জানাইনি সেভাবে। মনে মনে একটু ভয় তো ছিলই। কাজটাতে ঝুঁকিও কম নয় নেহাত। সেদিন ১২টা ১ মিনিটের সময়টাকে সিএন টাওয়ার কর্তৃপক্ষ আমার দলের জন্য সময় নির্ধারণ করে দেয়। কেননা ওই সময়টা সূর্যের আলো ও বাতাসের গতি অনেকটাই অনুকূলে থাকে। নিয়মমতো আমরা ঘণ্টা দুয়েক আগেই সিএন টাওয়ার বেইস ক্যাম্পে পৌঁছে গেলাম।
প্রায় দুই ঘণ্টার প্রস্তুতির প্রথম ধাপ ছিল পেপার ওয়ার্কস মানে কাগজ-কলমের কাজ।
লম্বা একটা ফরম পূরণ করতে হবে, যার সঙ্গে আছে নানা শর্ত, জীবন িবমা, ভবিষ্যৎ সুবিধা, শারীরিক ক্ষমতা-অক্ষমতার বর্ণনা, ব্যক্তিগত তথ্য ইত্যাদি। তারপর ঘনিয়ে এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। পেদ্র নামের একজন হাতে ধরে ধরে আমাদের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গের স্বাভাবিকতা পরীক্ষা করলেন।
এরপর চারজন কর্মী আমাদের বিশেষ পোশাকগুলোর সঙ্গে বিশেষ জুতা, বেল্ট, হুক, রিবন, মেটাল বডি লকার, আর বিশেষ ফিতা পরিয়ে দিলেন। মিশেল নামের আরেকজন একটি যন্ত্র দিয়ে আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের স্বাভাবিকতা পরীক্ষা করলেন।
অবশেষে কক্ষে এলেন দলীয় বিশেষজ্ঞ গাইড। আমাদের ডান হাতের রাবার প্যাকে বসানো নামফলক দেখে এজ ওয়াক ক্রম ঠিক করা হলো। সব পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে গাইড এই ক্রম তৈরি করেন। মাত্র ৫ ফুট চওড়া ও ৪৯২ ফুট লম্বা ধাতব পাতের ওপরে প্রায় ৩০ মিনিট মুক্ত হাতে হাঁটতে হবে। সঙ্গে মোট চারটি পয়েন্টে ছয়টি ‘অ্যাক্ট’ বা কসরত করতে হবে। এগুলোর নাম এজ ওয়াকিং, বেনডিং, লিনিং, হাই ফাইভ, গ্রুপ শোইং ও ফাইনাল মুভিং। এই ছয়টি কাজ বা কসরত ঠিকভাবে না করলে সনদ ও স্বীকৃতি পাওয়ার কোনো সুযোগ থাকবে না।
এজ ওয়াকের সময় মোট ৩৬টি সাপোর্ট লেন আর ১৬টি উচ্চক্ষমতার ক্যামেরা থাকবে। গাইডের মাথায় ও হাতে থাকবে আরও দুটি বিশেষ ক্যামেরা ও সাংকেতিক যন্ত্র। গ্রুপ ফটোসেশনের পর গাইড সবাইকে জোরেশোরে ‘গুডলাক’ বলে তাঁকে অনুসরণ করতে বললেন।
যখন বিশেষ কক্ষ থেকে আমরা ক্রম অনুসারে একে একে বের হচ্ছিলাম, এক অপূর্ব দৃশ্য আমার চোখ আটকে গেল।
২৫-৩০ জন কর্মীসহ সাধারণ পর্যবেক্ষণে আসা শ দুয়েক মানুষ আমাদের দাঁড়িয়ে করতালির মাধ্যমে সম্মানিত করল। বিশেষ এলিভেটরে করে ১১৬ তলায় পৌঁছে আরেকটি বিশেষ কক্ষে আমাদের দেহের সামনে ও পেছনে দুটি করে মোট চারটি ঝুলন্ত ধাতব রিবন পরানো হলো। সর্বশেষ কিছু নির্দেশনা আর একটি ছোট ভিডিও নমুনা দেখে শুরু হলো দুঃসাহসিক যাত্রা।

শুধু হাঁটা নয়, সফলভাবে এজ ওয়াক শেষ করতে হলে করা দরকার কিছু কসরতও
শুধু হাঁটা নয়, সফলভাবে এজ ওয়াক শেষ করতে হলে করা দরকার কিছু কসরতও

পাখির চোখে দেখা
ভয়টা কীভাবে যেন কেটে গেল। অনেক উঁচু থেকে যখন নিচে তাকালাম মনটা রোমাঞ্চে ভরে উঠল। একদিকে অন্টারিও হ্রদ, অন্যদিকে রজারস সেন্টার, রিপ্লিজ অ্যাকুয়ারিয়াম, টরন্টো হোটেল আর বিশাল বিশাল নির্মাণশৈলী।
এই অভিজ্ঞতার কোনো তুলনা হয় না। পরিষ্কার আকাশে অত উঁচু থেকে নায়াগ্রা জলপ্রপাতের সৌন্দর্য দেখাটাও ছিল ভাগ্যের ব্যাপার। নিয়মমতো সবকিছু শেষ করতে প্রায় ৪২ মিনিট লেগে যায়।
এবার গাইড একটি নির্দিষ্ট জায়গায় দাঁড়িয়ে আমাদের অর্জনের স্বীকৃতি ঘোষণা করলেন। যখন বিশেষ এলিভেটরে করে বেইস ক্যাম্পে ফেরত এলাম, আবার সবাই দাঁড়িয়ে সম্মান জানাল। এই দারুণ দুঃসাহসী অভিজ্ঞতাটি আমার জন্য সব সময় অনুপ্রেরণা। এই অর্জন আমার প্রাণপ্রিয় ছাত্রছাত্রীদের জন্য আমি উত্সর্গ করতে চাই।
লেখক: ঢাকার শান্ত-মারিয়ম বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাপারেল ম্যানুফ্যাকচার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগের শিক্ষক

.
.

সময়

.
.

সিএন টাওয়ার পরিচালনা পর্ষদ বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়কে এজ ওয়াক সেশন বলে ঘোষণা দেয়। তবে এটা সম্পূর্ণ নির্ভর করে উপযুক্ত আবহাওয়ার ওপর। সাধারণত উত্তর আমেরিকার গ্রীষ্মকালীন সময়ে এটা বেশি হয়।
খরচ
নিবন্ধন ফি ১৯৫ ডলারসহ আনুষঙ্গিক আরও কিছু খরচ মিলিয়ে কমপক্ষে ৩০০ ডলার গুনতে হবে। আর সিএন টাওয়ারের কাছাকাছি থাকতে গেলে হোটেল ভাড়া সাধারণত ৩০০-৬০০ ডলার হতে পারে।
যাঁরা এজ ওয়াক করতে চান
প্রাপ্তবয়স্ক হতে হবে আর সঙ্গে ত্রুটিমুক্ত স্বাভাবিক শারীরিক গঠন। উচ্চতা পাঁচ ফুটের ওপরে হওয়া জরুরি। ওজন ৩৪ কিলোগ্রাম থেকে ১৪০ কিলোগ্রামের মধ্যে থাকতে হবে। ছোট কিংবা বড় যেকোনো শারীরিক অসুবিধা থাকলে অনুমতি পাওয়া কঠিন। শ্বাস-প্রশ্বাসের স্বাভাবিকতা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। যাঁদের উচ্চতাভীতি আছে, এই কাজটি তাঁদের জন্য নয়। রোমাঞ্চের সঙ্গে ঝুঁকিটাও মাথায় রাখতে হবে।