সুরাইয়ার জন্য ভালোবাসা

এবার যেন নিশ্চিন্ত সুরাইয়া। ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন
এবার যেন নিশ্চিন্ত সুরাইয়া। ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন
২৩ জুলাই মাগুরায় মায়ের পেটে গুলিবিদ্ধ হয় শিশু সুরাইয়া। শুরুতে মাগুরা সদর হাসপাতালে এবং ২৬ জুলাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে তাকে বাঁচাতে কঠিন সংগ্রামে নামেন একদল চিকিৎসক। কীভাবে সংকটাপন্ন এক শিশুকে তাঁরা ফিরিয়ে দিলেন মায়ের কোলে? পড়ুন মানুষের চেষ্টা আর ভালোবাসার এক আবেগময় গল্প। লিখেছেন তানজিনা হোসেন

২৩ জুলাই তারিখটা সম্ভবত ডা. শফিউর রহমান জীবনে কখনো ভুলবেন না। কেননা, পেশাগত জীবনে এ রকম একটা অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হবেন, তিনি কখনো ভাবেননি। যদিও শল্যবিদ্যা বা সার্জারিতে উচ্চতর প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা থাকার কারণে বুলেটবিদ্ধ বা আহত রোগীর চিকিত্সা জীবনে অনেক করেছেন, কিন্তু তাই বলে মাতৃজঠরে গুলিবিদ্ধ শিশু? যে শিশুর জন্মই হয়নি এখনো, গুটিসুটি মেরে আছে মায়ের পেটের ভেতর, মাসহ সে কিনা গুলিবিদ্ধ! এমন ঘটনা কে কবে দেখেছে?

যাঁরা ছিলেন ভরসা: ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাত​ালে তাঁর দলের সঙ্গে কানিজ হাসিনা (সামনে)। ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন
যাঁরা ছিলেন ভরসা: ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাত​ালে তাঁর দলের সঙ্গে কানিজ হাসিনা (সামনে)। ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

শফিউরের চ্যালেঞ্জ
মাগুরা সদর হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ শল্যচিকিত্সক শফিউর রহমান তখনো জানতেন না যে কেবল বাংলাদেশে কেন, গোটা পৃথিবীতেই চিকিত্সকদের এ ধরনের ঘটনার সম্মুখীন হওয়ার ঘটনা বিরল। বিশ্বের নামকরা চিকিত্সা সাময়িকীগুলো জানাচ্ছে, গর্ভাবস্থায় আঘাত বা দুর্ঘটনার হার কম নয়, কিন্তু মা ও শিশু একই সঙ্গে গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা আসলেই বিরল। গোটা বিশ্বে এ রকম গোটা কয়েক ঘটনা লিপিবদ্ধ হয়েছে, আর তা থেকে জানা যায় এ রকম ঘটনার পর সঠিক ত্বরিত চিকিত্সায় মায়ের প্রাণ বাঁচানো সম্ভব হলেও শিশুর মৃত্যুঝুঁকি ৭০ শতাংশের বেশি। অবশ্য এত কিছু না জেনেই মাগুরা সদর হাসপাতালের চিকিত্সকেরা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন যে নাজমা নামের গুলিবিদ্ধ গর্ভবতী মাকে এখনই অস্ত্রোপচার করতে হবে, কেননা পেটের ভেতর রক্তক্ষরণ হওয়ায় তিনি ‘শক’ এ রয়েছেন। ততক্ষণে জরুরি আল্ট্রাসনোগ্রাম জানান দিচ্ছে গর্ভস্থ শিশুটির বয়স ৩২ সপ্তাহ ৫ দিন এবং এখনো তার হৃৎস্পন্দন আছে! ‘হতভাগ্য শিশুটির বাঁচা-মরা নিয়ে খুব বেশি চিন্তা করার অবকাশ ছিল না তখন,’ বলেন ডা. শফিউর। ‘কেননা, মায়ের জীবন বাঁচানোর জন্যই অস্ত্রোপচারটি জরুরি। তাই আমরা দেরি না করে অস্ত্রোপচার শুরু করে দিই।’
নাজমার পেটের ভেতরটা ছিল রক্তে পরিপূর্ণ, অ্যামনিওটিক ফ্লুইড বা জরায়ুর পানিতে মাখামাখি আর গুলিটা পেটের বাঁ দিক ভেদ করে আটকে ছিল শ্রেণিচক্রের পেশিতে, এতগুলো ক্ষত ঠিকঠাক করতে করতেই সন্ধ্যা ছয়টার দিকে জন্ম নেয় এক আশ্চর্য শিশু। যে শিশু তার জন্মের আগে থেকেই স্বজাতির নৃশংসতার শিকার হয়েও প্রবলভাবে বেঁচে থাকতে চাইল। আর তাই অপরিণত, নীলচে ছোট্ট শিশুটি সবাইকে অবাক করে দিয়ে পাঁচ মিনিট পর কেঁদে উঠল জোরে। মাগুরা সদর হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ জয়ন্ত কুমার কুণ্ডু আর অবেদনবিদ (অ্যানেসথেসিস্ট) সৌমেন সাহা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন তাকে নিয়ে। তখন তাঁরাও জানতেন না, এই শিশুটির জন্য একদিন সারা দেশের মানুষ নীরব প্রার্থনায় শামিল হবে একসঙ্গে।

শুরুর কান্ডারি: চিকিৎসক শফিউর রহমানের জন্য এটি ছিল কঠিন এক অভিজ্ঞতা।  ছবি: খালেদ সরকার
শুরুর কান্ডারি: চিকিৎসক শফিউর রহমানের জন্য এটি ছিল কঠিন এক অভিজ্ঞতা। ছবি: খালেদ সরকার

আরেক ‘মা’
জন্মের ৫৬ ঘণ্টা পর মাকে ছেড়ে চাচা ও ফুফুর সঙ্গে মাগুরা থেকে ঢাকার দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ২৬ জুলাই ভোর চারটায় শিশুটি এসে পৌঁছায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে। শিশু সার্জারি বিভাগে সেদিন রাত্রিকালীন দায়িত্ব পালন করছেন ডা. সদরুদ্দিন আল মাসুদ। প্রথম ওকে দেখে একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলেন কি? প্রশ্নটা শুনে ডা. মাসুদ একটু হাসেন, ‘না, ঠিক ঘাবড়াইনি। কেননা, এখানে আমরা নানা ধরনের বিচিত্র ও ক্রিটিক্যাল শিশু রোগী দেখে সব সময়ই অভ্যস্ত। কিন্তু এত ছোট্ট একটা শিশু, গুলির আঘাতে বিদীর্ণ, হ্যাঁ, একটু চমকে দিয়েছিল বটে।’ সকালবেলা শিশু সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কানিজ হাসিনা প্রথম দেখেন শিশুটিকে, শিশুটি তখন জানে না যে তারই তত্ত্বাবধানে এরপর আরও অনেকগুলো দিন কাটাতে হবে তাকে, গর্ভে ধারণ না করেও শিশুটিকে দ্বিতীয়বার ‘জন্ম’ দেবেন এই নারী। ওর বুকের ডান পাশ দিয়ে ঢুকে গেছে যে গুলিটা, তা মায়ের পেটের ভেতর গুটিসুটি হয়ে থাকার কারণে ভাঁজ করা হাত ও গলার পাশ ঘেঁষে চোখের কিছু ক্ষতি করে বেরিয়ে গেছে অন্য ধার দিয়ে। তারপরও এই ছোট্ট নাজুক শিশুটিকে তখনই অস্ত্রোপচার না করারই সিদ্ধান্ত নিলেন ডা. কানিজ। এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় আতঙ্কের নাম সংক্রমণ ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ। তাই সঙ্গে সঙ্গে ওয়ার্ডের আর সব শিশুর কাছ থেকে আলাদা করে ফেলা হলো তাকে। বিদেশি বন্ধুদের কাছ থেকে উপহার হিসেবে পাওয়া বেবি কটগুলোর একটিকে জীবাণুমুক্ত করে এক কোণে স্থাপন করা হলো, তাপমাত্রা যেন বেশি কমে না যায়, সে জন্য মাথার কাছে রাখা হলো একটা ফ্যান হিটার। লক্ষণরেখা টেনে দেওয়া হলো তার বিছানার চারপাশে, জীবাণুমুক্ত না হয়ে যে কারও প্রবেশ নিষেধ তার ভেতর। চিকিৎসকেরা সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থান নিলেন সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য।
মাতৃজঠরে থাকাকালে একটি শিশু রক্তে অক্সিজেনের জন্য মায়ের রক্তকেই ব্যবহার করে, নিজের ফুসফুসকে নয়। আর এ কারণেই বুকের খাঁচার ভেতর ফুসফুসটা জন্মের আগ পর্যন্ত চুপসে থাকে। এই অসামান্য রক্ষাকবচের জন্য বুলেট বুক ভেদ করে গেলেও শিশুটির ফুসফুসে কোনো আঘাত করতে পারেনি, না হলে রক্তক্ষরণে অনেক আগেই মারা যেত সে। কথাগুলো বলছিলেন শিশু সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক আবদুল হানিফ। একইভাবে শিশু ধারণের কারণে ফুলে ওঠা জরায়ু মায়ের পেটের অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে ঠেলে দিয়েছে ওপরে, আর বুলেটটা মায়ের পেট বিদীর্ণ করলেও পেটের ভেতরকার জরুরি অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে ছুঁতে পারেনি সেভাবে। তার ওপর জরায়ুর পানি আর পেশির সঙ্গে আস্ত একটা শিশুর উপস্থিতি বুলেটের গতিকে অনেকটাই ধীর করে দিয়েছে, না হলে মাও মারা যেতেন সেই আঘাতের কারণে। মা ও মেয়ে দুজনেই একে অপরকে বাঁচিয়েছেন নিজেদের অজান্তে! জানালেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক নীলুফার বেগম, নাজমাকে যিনি তত্ত্বাবধান কেরছেন। মাগুরার চিকিৎসকদের ত্বরিত অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত ও সঠিক পদক্ষেপের প্রশংসা করে তিনি বলেন, ‘পরবর্তী সময়ে নাজমা সংক্রমণ, শ্বাসকষ্ট, জ্বর ইত্যাদি সমস্যা নিয়েই ঢাকায় আসে এবং আমরা তার চিকিত্সা দিই। তার ত্বকেও বেশ সমস্যা ছিল। কিন্তু সঠিক সময়ে সঠিক চিকিত্সা না হলে সে নিজেও যে ঝুঁকিমুক্ত ছিল, তা-ও নয়।’
বিপদ অবশ্য তখনো পিছু ছাড়েনি সুরাইয়ার, তত দিনে নামকরণ হয়েছে ওর, আর সারা দেশের মানুষ সেই নাম জেনে গেছে সংবাদমাধ্যমের কল্যাণে। প্রতিদিন ভিড় জমছে হাসপাতালে। এর পরের গল্পটা শুনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের নবজাতক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আবিদ হোসেন মোল্লার কাছ থেকে।

অবশেষে মায়ের কোলে সুরাইয়া
অবশেষে মায়ের কোলে সুরাইয়া

মায়ের কোলে ফেরা
সুরাইয়া অস্ত্রোপচারের উপযোগী হয়ে উঠল। ২১টি সেলাই পড়ল এইটুকুন শরীরে। সেই ধকলটাও সামলে উঠতে না উঠতে একের পর এক দুঃসংবাদ। তত দিনে সে চলে গেছে স্পেশাল কেয়ার বেবি ইউনিটে। এরই মধ্যে তার জন্ডিস দেখা দিল মারাত্মক আকারে, রক্তে অণুচক্রিকার হার গেল কমে, হৃদ্যন্ত্রে শোনা যাচ্ছে একটা অস্বাভাবিক শব্দ, তারপর যেদিন শরীরে পানি জমতে শুরু করল, সেদিন অধ্যাপক আবিদের মুখ থমথমে। ১০ সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ মেডিকেল বোর্ড তৈরি হয়ে গেছে তত দিনে। সেখানে আছেন শিশু সার্জারি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক আশরাফ উল হক, অধ্যাপক আবদুল হানিফ, সহযোগী অধ্যাপক কানিজ হাসিনা, শিশু বিভাগের প্রধান অধ্যাপক এখলাসুর রহমান, হৃদ্রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবদুল ওয়াদুদ চৌধুরী, কার্ডিও থোরাসিক সার্জন কামরুল, চর্ম বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী, চক্ষু বিভাগের ডা. ফরিদুল হাসান, অর্থোপেডিক বিভাগের ডা. গোলাম মোস্তফা, প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের ডা. নওয়াজেশ। নিয়মিত আলোচনায় বসছেন তাঁরা। দফায় দফায় পরামর্শ দিতে ছুটে এসেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নবজাতক বিভাগের অধ্যাপক মো. শহীদুল্লাহ এবং জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের চিকিৎসকেরা। ‘অনেকেই আমাদের যথেষ্ট সহায়তাই করেছেন’—বললেন অধ্যাপক আবিদ হোসেন। সাংবাদিেকরাও সহায়তা করেছেন। তাঁরা শিশুটির কাছে যাওয়ার জন্য জোর করেননি। বিধিনিষেধও মেনে চলেছেন। না মেনেই বা উপায় কী? স্ক্যাবু ইনচার্জ সিস্টার জয়ন্তী ঘাগড়া আর সুরাইয়ার সার্বক্ষণিক নার্স সুলতানা পারভীন নাকি বাঘিনীর মতোই আগলে রেখেছিলেন ওকে। সঠিক নিয়ম না মেনে এমনকি নিজেদের অধ্যাপককেও কাছে ঘেঁষতে দেননি তাঁরা! এই যে বুক দিয়ে আগলে রাখা সেবিকারা, ওই যে ওয়ার্ডবয় রাজু যে রক্ত দিয়েছেন অস্ত্রোপচারের সময়, শিশু সার্জন সিফাত ছুটে গিয়ে কিনে এনেছেন মশারি, লেপ, কাঁথা আর বালিশ। সিফাতের শাশুড়ি নাকি পরম যত্নে নিজে সেলাই করে দিয়েছেন জামাকাপড়। নাম না-জানা স্তন্যদাত্রী মায়েরা এসে ওকে দুধ খাওয়াতে চেয়েছেন। এ রকম বহু মানুষের ভালোবাসা আর শুভকামনায় শেষ পর্যন্ত সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গিয়ে সুরাইয়া প্রমাণ করে দিল এখনো মানুষ তার মানবতা আর প্রেম দিয়েই জিততে পারে।
শেষ দৃশ্যে তাই দেখি মা নাজমা হাসিমুখে কোলে নিচ্ছেন সুরাইয়াকে ছবি তোলার জন্য, ‘আরে আরে ছবি তোলার জন্য তো আমি একটা মাথার ব্যান্ড কিনেছি’ বলে ছুটে আসছেন সিফাত। আর সুরাইয়ার বাবা বাচ্চু ভূঁইয়া লাজুক মুখে জিজ্ঞেস করছেন, ‘আমি কোন দিকে দাঁড়াব?’ আর একদল স্নেহময় চিকিত্সক-সেবিকা-হাসপাতালের কর্মী উচ্ছ্বসিত হাসি হাসছেন। এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্য আর কী হতে পারে!