সুস্থতার ফেরিওয়ালা

কিস্তির টাকা তোলার জন্য বেরিয়েছেন সরোজ কুমার হাজরা ও শ্যামলী রায় দম্পতি। ছবিটি গতকাল শুক্রবার মহাদেবপুর উপজেলা সদরের বক চত্বর এলাকা থেকে তোলা—সোয়েল রানা
কিস্তির টাকা তোলার জন্য বেরিয়েছেন সরোজ কুমার হাজরা ও শ্যামলী রায় দম্পতি। ছবিটি গতকাল শুক্রবার মহাদেবপুর উপজেলা সদরের বক চত্বর এলাকা থেকে তোলা—সোয়েল রানা

সুস্থ থাকতে হলে হাঁটতে হবে—চিকিৎসকের এই পরামর্শ মেনে প্রতিদিন নিয়ম করে হাঁটা শুরু করলেন সরোজ কুমার হাজরা। তিন-চার মাস পর আলস্য ভর করল। অনেক দিন না হাঁটায় বিগড়ে যেতে থাকল শরীর। নিয়মিত হাঁটাকে কাজের অংশ করার কথা ভাবলেন তিনি।
সরোজ কুমার হাজরা ঠিক করলেন ফেরি করে কিস্তিতে কাপড় বিক্রি করবেন। যেই ভাবনা, সেই কাজ। হয়ে গেলেন ফেরিওয়ালা। তাঁর জন্য কাপড় ফেরি করা সহজ হয়েছে, কারণ নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলায় তাঁর একটি কাপড়ের দোকান আছে।
কাপড় ব্যবসায়ী হওয়ার আগে সরোজ কুমার হাজরা ছিলেন মহাদেবপুর উপজেলার পাহাড়পুর ইউনিয়নের গঙ্গারামপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। ২০০২ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। তাঁর স্ত্রী শ্যামলী রায় শোভাপুর ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রে স্বাস্থ্য সহকারী। কাপড় ফেরি করার কাজ ও হাঁটাহাঁটিতে তিনি সরোজ কুমারের সঙ্গী।
প্রতিদিন অফিস শেষে সন্ধ্যার পর স্বামীর কাজে সাহায্য করেন শ্যামলী রায়। তাঁদের এক ছেলে ও দুই মেয়ে। চাকরি ও বিয়ের সূত্রে তাঁরা দেশের বাইরে থাকেন। বৃদ্ধ মা-বাবাকে তাঁরা নিজেদের কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছেন। কিন্তু দেশ ছেড়ে যেতে চাননি এই দম্পতি।
শিক্ষকতার চাকরি থেকে অবসরের পর সরোজ কুমার পেনশনের টাকা দিয়ে মহাদেবপুর বাজারে কাপড়ের ব্যবসা শুরু করেন। পাঁচ বছর ধরে তিনি এখানে দোকান করছেন। ভালোই চলছিলেন। কিন্তু আস্তে আস্তে শরীরে নানান রোগ বাসা বাঁধে। শুরুতে কষ্ট দিল অম্বল (গ্যাসট্রিক)। দেশে অনেক চিকিৎসক দেখিয়েছেন। ছেলেমেয়েরা ভারতের চেন্নাইয়ের একটি হাসপাতালে নিয়ে যান। পরীক্ষায় ধরা পড়ে হৃদ্রোগ। এনজিওগ্রাম করে হার্টের রক্তনালিতে ব্লক শনাক্ত করা হয়। সেখানে চিকিৎসা নেওয়ার পর দুই বছর সুস্থ ছিলেন। এবার যুক্ত হয় ডায়াবেটিস। ২০১১ সালে অজ্ঞান হয়ে রাজশাহীর একটি ক্লিনিকে ভর্তি হন। একপর্যায়ে ক্লিনিকের চিকিৎসকেরা তাঁকে বাঁচানো সম্ভব না বলে ফিরিয়ে দেন। অজ্ঞান অবস্থায় সরোজ কুমারকে ভারতের শিলিগুড়ির একটি সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। চিকিৎসকেরা তাঁকে কলকাতার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আন্তর্জাতিক ইনস্টিটিউট অব কার্ডিয়াক সায়েন্স (আরটিআইআইসিএস) হাসপাতালে পাঠান। সেখানে তাঁর হৃদ্যন্ত্রে অস্ত্রোপচার করা হয়।
সরোজ কুমার বলেন, ‘সেবার ১৯ দিন অজ্ঞান ছিলাম। তখন আমার প্রতি এমএল রক্তে সুগারের পরিমাণ ছিল ৪০০ ইউনিট। ডাক্তাররা বলেছিলেন, এই অবস্থায় বেশি দিন বাঁচা সম্ভব না।’
ওই চিকিৎসকেরাই সরোজ কুমার নিয়মিত হাঁটার পরামর্শ দেন। দেশে ফিরে তিনি প্রথমে আধা ঘণ্টা, পরে এক ঘণ্টা করে নিয়মিত হাঁটা শুরু করেন। সরোজ কুমার বলেন, ‘একা একা কোনো কাজ ছাড়া হাঁটতে ভালো লাগত না। কিছুদিন পর অনিয়মিত হয়ে পড়ি। তাতে শরীর খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ একদিন ফেরি করে কিস্তিতে মানুষের কাছে গিয়ে কাপড় বিক্রির পরিকল্পনা মাথায় এল। শুরু করলাম। এখন প্রতিদিন আমার হাঁটাও হয়, কিস্তিতে কাপড় বিক্রি করায় গরিব মানুষেরও উপকার হয়। রথ দেখাও হয়, কলা বেচাও হয়।’

নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলা সদরের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের মাঝে বাকিতে লুঙ্গি-শাড়ি বিক্রি করেন সরোজ কুমার হাজরা ও শ্যামলী রায় দম্পতি। বাকি টাকার কিস্তি তুলছেন তাঁরা। ছবিটি গতকাল উপজেলা সদরের বক চত্বর এলাকা থেকে তোলা l প্রথম আলো
নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলা সদরের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের মাঝে বাকিতে লুঙ্গি-শাড়ি বিক্রি করেন সরোজ কুমার হাজরা ও শ্যামলী রায় দম্পতি। বাকি টাকার কিস্তি তুলছেন তাঁরা। ছবিটি গতকাল উপজেলা সদরের বক চত্বর এলাকা থেকে তোলা l প্রথম আলো

সরোজ কুমার চোখে কম দেখেন বলে স্ত্রীও তাঁর সঙ্গে যান। তিনি কিস্তির টাকা সংগ্রহ করেন আর হিসাব রাখেন। একটি লুঙ্গির দাম ৩০০ টাকা হলে প্রথম কিস্তিতে ৫০ টাকা করে নেন। এরপর প্রতিদিন হেঁটে হেঁটে ওই গ্রাহকদের কাছ থেকে দুই থেকে পাঁচ টাকা করে কিস্তি তোলেন। এভাবেই প্রতিদিন সন্ধ্যায় পথে নামেন এই ফেরিওয়ালা দম্পতি। প্রতিদিন হাঁটার ফলে তাঁদের শরীর এখন ভালো রয়েছে বলে জানান তাঁরা।
সম্প্রতি এক সন্ধ্যায় অনেক খোঁজাখুঁজির পর মহাদেবপুর বাজারে গিয়ে দেখা মিলল ওই দম্পতির। তরকারি বাজার এলাকায় খাতা দেখে দেখে দোকানদারদের কাছ থেকে কিস্তির টাকা তুলছিলেন শ্যামলী রায়। পরিচয় না দিয়ে কিছুক্ষণ তাঁর পেছন পেছন বিভিন্ন দোকানে ঘুরছিলেন এই প্রতিবেদক। লুঙ্গি বা শাড়ি ক্রেতারা কেউ দুই টাকা, কেউ পাঁচ টাকা করে দিচ্ছিলেন। তিনি তা খাতায় টুকে নিচ্ছিলেন। একপর্যায়ে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে কথা বলতে চাইলে তিনি পাশেই অন্য দোকানে তাঁর স্বামী সরোজ কুমারকে দেখিয়ে দিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে বললেন। পরে সেখানেই কথা হয় এই ফেরিওয়ালা দম্পতির সঙ্গে।
সরোজ কুমার প্রথম আলোকে বলেন, তিনি এসব লুঙ্গি ও শাড়ি বিক্রি করে সামান্যই লাভ করেন। তবে এই পর্যায়ে বড়লোকদের কাছে কাপড় বিক্রি করেন না তিনি। বড়লোকেরা তো কিস্তির ঝামেলায় যেতে চান না। কিন্তু কিস্তির ব্যবস্থা না থাকলে তো হাজরা দম্পতির হাঁটা কমে যাবে। তাঁরা হাঁটতে চান। আর চান অপেক্ষাকৃত অসচ্ছল লোকদের খুব কম দামে বস্ত্র কেনার সুযোগ দিতে।
এই দম্পতি জানান, কিস্তির কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই। যে যত বেশি কিস্তিতে টাকা শোধ করবে, ততই তাঁদের ভালো। তাঁরা বারবার আসবেন, হাঁটবেন, সুস্থ থাকবেন। আর সাধারণ মানুষগুলোর টাকা শোধের কোনো চাপ থাকবে না।
সরোজ কুমার বলেন, ‘৩৭ বছর শিক্ষকতা পেশায় ছিলাম। সব সময় মানুষের কাছে থেকেছি। তাই মানুষের কাছ থেকে দূরে থাকতে ভালো লাগে না। কিস্তিতে কাপড় বিক্রি করার মাধ্যমে মানুষের কাছে থাকতে পারছি। মানুষও আমাদের বিশ্বাস করে, ভালোবাসে। মানুষের এই ভালোবাসা ও বিশ্বাস নিয়েই জীবন কাটাতে চাই। কখনো পরনির্ভরশীল হয়ে থাকতে চাই না।’
সরোজ কুমারের স্ত্রী শ্যামলী রায় বলেন, ‘আমি নিজেও হাই-প্রেশারের (উচ্চ রক্তচাপ) রোগী। শরীরে চর্বি বাড়ানো যাবে না। নিয়মিত হাঁটার ফলে আমিও ভালো আছি।’
কিস্তির খাতা দেখিয়ে শ্যামলী রায় বললেন, এই মাসে ৩৩২ জনকে কিস্তিতে কাপড় দেওয়া হয়েছে। প্রতিদিন হেঁটে হেঁটে তাঁদের সবার কাছে গিয়ে কিস্তির টাকা তোলেন তাঁরা। কারও টাকা শোধ হচ্ছে, আবার নতুন করে কেউ কাপড় কিনছে। এভাবেই দুই বছর ধরে চলছে।
মহাদেবপুর বাজারে মজিবর রহমান, উজ্জ্বল কুমার, স্বপন সাহা, আকবর হোসেনসহ এই দম্পতির কাছ থেকে কিস্তিতে কাপড় কিনেছেন—এমন ১০-১২ জন ব্যক্তির সঙ্গে কথা হলো। তাঁরা জানান, বাজারের দোকানে অনেক সময় কাপড় কিনে ঠকতে হয়। কিন্তু মাস্টার তাঁদের ঠকান না। আবার কিস্তিতে কাপড় দেন। ইচ্ছেমতো টাকা পরিশোধ করা যায়। অনেকেই হিসাবও রাখেন না। কাপড়ের দাম উঠে গেলে হাজরা দম্পতিই ক্রেতাদের বলেন, আর টাকা দিতে হবে না।
স্থানীয় লোকজন এই দম্পতির প্রতিদিনের কাজ দেখে বিস্মিত। মহাদেবপুর লিচুবাগান এলাকার বাসিন্দা আহসান হাবিব, জাহিদুল ইসলাম ও সাইফুল ইসলাম জানান, প্রথম দিকে তাঁরা ভেবেছিলেন এটা ব্যবসারই একটা কৌশল। কিন্তু পরে যখন সবাই জানতে পারলেন, প্রতিদিন হাঁটার জন্য এই দম্পতি কিস্তিতে ফেরি করে কাপড় বিক্রি করছেন, তখন সত্যিই অবাক হতে হয়েছে।
সরোজ কুমার ও শ্যামলী রায় দম্পতির প্রতিবেশী লিচুবাগান এলাকার বাসিন্দা ছয়েফ উদ্দিন ও শওকত আলী। তাঁরা দীর্ঘদিন ধরে ডায়াবেটিস রোগে ভুগছেন। ছয়েফ উদ্দিন জানান, চিকিৎসকের পরামর্শে পাঁচ বছর ধরে হাঁটাহাঁটি করছেন। কিন্তু মাঝেমধ্যেই অবহেলা হয়, হাঁটা হয় না। এখন হাঁটার জন্য এই দম্পতির বিশেষ ধরনের উদ্যোগ দেখে পাড়ার অনেকেই অনুপ্রাণিত হয়েছেন।
মহাদেবপুরের স্বর্ণ ব্যবসায়ী শওকত আলী বলেন, ‘ডায়াবেটিস ও হার্টের সমস্যা ধরা পড়ার পর থেকে প্রতিদিন সকালে উপজেলার ডাকবাংলা মাঠে হাঁটাহাঁটি করি। এতে শরীরের রোগ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। কিন্তু কিস্তিতে কাপড় বিক্রি করে হাঁটার যে কৌশল, এটা অভিনব। এই দম্পতির কারণে অনেক গরিব মানুষের উপকারও হচ্ছে।’
একই কথা বললেন নওগাঁর উকিলপাড়ার ময়নুল হক ও শফিকুল ইসলাম। তাঁদেরও হাঁটাহাঁটির অনুপ্রেরণা এখন এই দম্পতি।
সৎ ও ভালো মানুষ হিসেবে সরোজ কুমার হাজরা ও তাঁর স্ত্রী আগে থেকেই সবার শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। এখন সেই শ্রদ্ধা ভক্তিতে রূপ নিচ্ছে। সুস্থ থাকতে তাঁরা কাপড়ের ফেরিওয়ালা হয়েছিলেন। কিন্তু মহাদেবপুরে পরিচিত মহলে এখন তাঁরা সুস্থতার ফেরিওয়ালা।