সে যন্ত্রণা থেকে আর মুক্তি নেই

.
.

‘কোনো নারী জীবনে একবার ধর্ষিত হলে যে মানসিক যন্ত্রণায় ভোগেন, সারা জীবনে সে যন্ত্রণা থেকে আর মুক্তি মেলে না। অসহনীয় আর অব্যক্ত পীড়ায় জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। কী যে কষ্ট! এই কষ্টের কথা না কারও কাছে বলা যায়, না সহ্য করা যায়। ভীষণ যন্ত্রণায় একা একা গুমরে মরি।’
এভাবেই ২০ বছর বয়সে ধর্ষণের শিকার হওয়া আলো (ছদ্মনাম) নিজের দুঃসহ স্মৃতির কথা বলেন। আলোর বয়স এখন ৩২ বছর। তিনি ও তাঁর স্বামী দুজনই কর্মক্ষেত্রে সফল। বিয়ে করেছেন সাত বছর আগে। কোলজুড়ে আছে তিন বছরের ছেলে।
সুখে, স্বাচ্ছন্দ্যে থাকার কথা হলেও প্রতিটি মুহূর্তে মানসিক পীড়ন আর অপরাধবোধে ভোগেন আলো। প্রায়ই ভাবেন এই ঘটনাটি না ঘটলে কি তাঁর জীবনটা এমন হতো! ঘটনাটি মনে পড়লেই ভয়ে কুঁকড়ে যান তিনি। আতঙ্ক চেপে বসে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে দুর্বার তারুণ্যে কাটে প্রতিটি দিন। সে রকম একদিনে এক নিকটাত্মীয় নির্মমভাবে হানা দেয় আলোর জীবনে। কেড়ে নেয় তাঁর জীবনের আলো। ধর্ষিত হওয়ার ঘটনা এভাবেই বর্ণনা করেন আলো। ‘ঘটনার পরে খুব ভয় পেয়েছিলাম। আঘাতটা এত অপ্রত্যাশিত ছিল, কী করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। মনে হয়েছিল, কেউ জানলে কীভাবে বেঁচে থাকব। কীভাবে মানুষের সামনে মুখ দেখাব। কয়েকবার আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত পারিনি। লজ্জায় পরিবারের কাউকেও বলতে পারেনি।’
কিছুক্ষণ চুপ থেকে আলো আবার বলতে শুরু করেন। ‘এরপরে নিজেকে গুটিয়ে নিই। বিশ্ববিদ্যালয় আর বাসা। কারও সঙ্গে বন্ধুত্বও করিনি। এ সময় পরিচয় হয় একজনের সঙ্গে। যাকে আমি পরে বিয়ে করি। একদিন তাকে সব ঘটনা খুলে বলি। সে আমার পাশে দাঁড়ায়। আমি আবার অনেকটা স্বাভাবিক হই। বিয়ের প্রথম এক বছর সে আমাকে সন্তানের মতো আগলে রাখে। কিন্তু প্রথমবার গর্ভধারণ করার পরেই বদলে যায় তার আচরণ। এত দিনের চেনা মানুষটা অচেনা হয়ে যায়। অন্তঃসত্ত্বা হয়েছি জানার পর সে আমাকে এত মিষ্টি করে বলেছিল, “কনগ্রাচুলেশনস”। ওই মুহূর্তটা এখনো সবচেয়ে সুখের ও স্বপ্নময় সময়। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই বলে, “এই বাচ্চার প্রতি আমার ন্যূনতম অনুভূতি নেই। আমি এখনই বাচ্চা চাই না।” তারপর তার একার ইচ্ছায় গর্ভপাত করা হয়। প্রতিবাদ করতে চাইলে সে আমাকে বুঝিয়ে দেয় ধর্ষণের শিকার একটা মেয়ের এত কথা বলার কিছু নেই। তাদের চাওয়ার কোনো মূল্য নেই।’
এরপর থেকে কিছু হলেই এটিকে সামনে নিয়ে আসে স্বামী। তবে কখনো শারীরিকভাবে নির্যাতন করেনি। কিন্তু মানসিক নির্যাতনে বিপর্যস্ত আলোর জীবন। আলো বলেন, ‘সে প্রতি মুহূর্তে বুঝিয়ে দেয়, আমি ধর্ষিত হয়েছি। সবার কাছ থেকে এই কথা লুকিয়ে আমাকে রক্ষা করছে।’
অনেক সময় আলোর সঙ্গে গৃহকর্মীর মতো আচরণ করে। এমনকি তাঁর মেধা নিয়েও প্রায়ই খোঁটা শুনতে হয়। সংসারে তাঁর মতামতের কোনো মূল্য নেই। তাঁকে স্বামীর অনুগ্রহ নিয়েই দিনযাপন করতে হয়। আলো বলেন, ‘গর্ভপাতের পরে যখন একা কোনো কাজ করতে পারি না, তখন সে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে চলে যায়। এমনকি ডাক্তারের কাছেও আমাকে নিয়ে যায়নি। একদিন এই আচরণের কারণ জানতে চাইলে সে বলে, “তুমি এমন কোনো সতীসাধ্বী নারী নও যে সম্মান করে কথা বলতে হবে। তোমার মতামতের গুরুত্ব দিতে হবে। তুমি হচ্ছ অভিশপ্ত নারী। তোমায় বিয়ে করে করুণা করেছি, স্রেফ করুণা। এখনো ডিভোর্স দিইনি বা বাসা থেকে বের করে দিইনি, সে তোমার ভাগ্য।’”
এরপর থেকে প্রতিটা দিন আলো যুদ্ধ করে বেঁচে আছেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠেই আলো বলেন, ‘আমি ওর দোষ দিতে চাই না। শুরুতে আবেগের বশে সে হয়তো আমার পাশে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু সে কখনো আমাকে ভালোই বাসেনি। মাঝেমধ্যে মানসিক চাপ আর নিতে পারি না। একা বাসায় চিৎকার করে কাঁদি। সারা রাত জেগে থাকি। মনে হয় ছেলেটিকে নিয়ে পালিয়ে যাই। কিন্তু কিছুই করা হয় না। কষ্টগুলো বুকে নিয়ে ভোরের জন্য প্রত্যাশা করি। তবুও আমি ওকে ভালোবাসি, সেই প্রথম দিনটির মতো ভালোবাসি। আসলে কোনো মেয়ে একবার ধর্ষিত হলে, আজীবনই সে ধর্ষিত হতে থাকে কোনো না-কোনোভাবে।’