'আব্বা বলেছিলেন তুমিও পারবে'

যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয়ে নর্থওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে সেলিম শাহরিয়ার l ছবি: সংগৃহীত
যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয়ে নর্থওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে সেলিম শাহরিয়ার l ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশ গৌরব করতে পারে অধ্যাপক সেলিম শাহরিয়ারকে নিয়ে। দুনিয়া কাঁপানো মহাকর্ষ তরঙ্গ শনাক্ত করার ঘটনায় তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত নর্থওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের একটি দলকে। ১১ ফেব্রুয়ারি ওয়াশিংটনে সংবাদ সম্মেলন করে যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীরা ঘোষণা দিয়েছেন, ১৩০ কোটি আলোকবর্ষ দূরে দুটি কৃষ্ণগহ্বরের মিলনের ফলে যে তরঙ্গ উঠেছিল, তার সংকেত এসে ধরা পড়েছে তাঁদের যন্ত্রে। এই যন্ত্র তৈরিতে অবদান রেখেছেন বাংলাদেশের পাবনা জেলার বেড়ার সন্তান অধ্যাপক সেলিম শাহরিয়ার। নর্থওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাককরমিক স্কুল অব ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বুলেটিনে তাঁকে নিয়েই শিরোনাম করা হয়েছে, ‘সেলিম শাহরিয়ার অবদান রেখেছেন মহাকর্ষ তরঙ্গ আবিষ্কারে’।
গতকাল সোমবার (যুক্তরাষ্ট্রে রোববার) আমার সঙ্গে টেলিফোনে অধ্যাপক সেলিমের কথা হয়। তখন তিনি বারবার স্মরণ করছিলেন তাঁর বেড়ার দিনগুলো। তিনি পড়তেন বেড়া বিপিন বিহারি উচ্চবিদ্যালয়ে। তাঁর পিতা আজিম উদ্দীন আহমেদ ছিলেন একই স্কুলের গণিতের শিক্ষক। আব্বার হাত ধরে তিনি স্কুলে যেতেন। আব্বা বলতেন, ‘যা অন্যে পারবে, তুমিও পারবে। চেষ্টা করো। চেষ্টার অসাধ্য কিছু নেই।’ আব্বাই তাঁর ভেতরে আত্মবিশ্বাস ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। আব্বার সঙ্গে গ্রামের মেঠো পথ ধরে স্কুলে যেতে যেতেই তিনি দেখতে থাকেন বড় স্বপ্ন। আব্বা মারা গেছেন অনেক দিন, প্রায় দুই যুগ। মা-ও মারা গেছেন চার বছর আগে।
১৯৬৪ সালে জন্ম সেলিম শাহরিয়ারের। বিপিন বিহারি স্কুল থেকে মাধ্যমিক আর ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় তিনি মেধাতালিকায় ছিলেন দশের মধ্যে। এরপর তিনি চলে যান এমআইটি বা ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে, ১৯৮২ সালে। গ্রাম থেকে উঠে আসা এক কিশোর, দুই বছর ঢাকায় থেকে সোজা বোস্টন। ওখানে তাঁর মাথার ওপরে ছায়া হলেন আবদুল ওয়াহাব শেখ ও তাঁর পরিবার। তাঁরা ১৯৬৮ সাল থেকে বোস্টনে আছেন। তাঁর মেয়ে রাবিয়া শেখ। এক বছরের মাথায় সেলিম বিয়ে করলেন রাবিয়াকে। শ্বশুর আবদুল ওয়াহাব শেখের অবদানের কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন সেলিম। শ্বশুরের পড়াশোনা ম্যাসাচুসেটসের ওয়ালথামের ব্র্যান্ডেইস বিশ্ববিদ্যালয়ে, হোটেল ম্যানেজমেন্ট নিয়ে। তিনি শেরাটন হোটেলের ব্যবস্থাপক ছিলেন। পরে তিনি বোস্টনের একটি মসজিদের ইমামের দায়িত্ব নেন, মারা গেছেন গত বছরের শেষ দিকে। স্ত্রী রাবিয়া প্রতিরক্ষা প্রযুক্তিবিষয়ক একটি কোম্পানির প্রেসিডেন্ট। এটি ইলিনয় অঙ্গরাজ্যের রোলিং মিডোজে অবস্থিত, নাম ডিজিটাল অপটিকস টেকনোলজিস। নিজের বিষয়ে বললেন, ‘আমি তো একটু আগেভাগে বিয়ে করেছি, আমার ছেলে সাজিদের বয়স ২৯, ছোট ছেলে রুমানের বয়স ২১।’
সেলিম শাহরিয়ার নর্থওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎকৌশল ও কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক। পদার্থবিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিজ্ঞানেরও অধ্যাপক। এবং অ্যাটমিক অ্যান্ড ফোটোনিক টেকনোলজি ল্যাবরেটরির (এপিটিএল) পরিচালক। এই মহাকর্ষ তরঙ্গ যে শনাক্ত করা গেছে, এ বিষয়ে অধ্যাপক সেলিম ও তাঁর তিন শিক্ষার্থীর লেখা প্রবন্ধগুলো ফিজিক্যাল রিভিউ লেটারসে প্রকাশিত হয়েছে। ১০ বছর ধরে সেলিম কাজ করছেন লাইগোর তরঙ্গ শনাক্তকারী যন্ত্রের সংবেদনশীলতা ও ব্যান্ডউইট্থ বাড়ানোর জন্য। লাইগো (এলআইজিও) মানে হলো লেজার ইন্টারফেরোমিটার গ্র্যাভিটেশনাল-ওয়েভ অবজারভেটরি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বুলেটিনে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে আইনস্টাইনের ১৯১৫ সালের আপেক্ষিকতা তত্ত্বের সূত্র টেনে সেলিম বলেছিলেন, ‘আইনস্টাইন যখন এই ধারণা দেন, তখন এটা ছিল কল্পনারও অতীত যে আমরা এত সূক্ষ্ম পরিমাপ করতে পারব। এটা এতই সূক্ষ্ম যে এটা মাপার কথা কল্পনা করাও কঠিন ব্যাপার।’ ২০১৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর তাঁদের লাইগোর যন্ত্রে অ্যানটেনা এক সেকেন্ডের পাঁচ ভাগের এক ভাগ সময়ের জন্য একটা প্রোটনের এক হাজার ভাগের এক ভাগ পরিসরে নড়ে উঠেছিল। অধ্যাপক সেলিম ও তাঁর দলের সদস্যরা এবার কাজ করছেন এই শনাক্তকারক যন্ত্রের আরও উন্নতির জন্য। তিনি ফোনে বললেন, ‘আমরা যন্ত্রের সংবেদনশীলতা ২০ গুণ বাড়াব, যার ফলে মহাকাশের ৮ হাজার গুণ বড় পরিসর অবলোকন করতে পারব।’ এ ব্যাপারে তাঁরা অনেক দূর এগিয়েই গেছেন।
অধ্যাপক সেলিম আরেকটা জিনিস সৃজন করতে যাচ্ছেন। আণবিক ঘড়ি। আর তা বিভিন্ন গ্রহে কৃত্রিম পালসার হিসেবে বসানো হবে। পালসার হলো নিয়মিত ও দ্রুত স্পন্দমান বেতার-তরঙ্গের মহাজাগতিক উৎস। আগে মহাকাশ গবেষণা হতো কেবল আলো দিয়ে, এরপর থেকে হবে তরঙ্গ দিয়ে! তিনি বলছেন, ‘যখন বিগ ব্যাং হয়, তখন মহাজগৎ এত ঘনীভূত ছিল যে আলো বাইরে বেরোতে পারেনি। তখনকার পরিস্থিতি জানতে তরঙ্গ সহায়তা করবে।’
অধ্যাপক সেলিম এখন সপরিবারে ইলিনয়ের নর্থওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সানফ্রান্সিসকোতে আছেন ভ্যালেন্টাইনের ছুটিতে। টেলিফোনে তিনি বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের উদ্দেশে বলেন, ‘বেশি করে পদার্থবিজ্ঞান পড়া উচিত। বিজ্ঞানে ছেলেমেয়েদের আগ্রহী করে তুলতে হবে। তোমাদের বিশ্বাস করতে হবে যে আমিও পারব। আমাদের দিয়েও বড় কিছু হবে।’
বেড়ার গ্রামের সবুজ ধানখেতের পাশ দিয়ে মেঠো পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে তাঁর শিক্ষক পিতা ঠিক এ কথাটাই বলেছিলেন। ‘তুমিও পারবে।’ আমাদের বাংলাদেশের গ্রামের স্কুল থেকে উঠে আসা ড. দীপঙ্কর তালুকদার, ড. সেলিম শাহরিয়াররা পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় জায়গায় বড় আবিষ্কারের সঙ্গে যুক্ত থেকে এই প্রেরণাটাই দিচ্ছেন-আমরাও পারি।