লেকে পেহলা পেহলা প্যায়ার

গায়িকা শামসাদ বেগম
গায়িকা শামসাদ বেগম

মৃত্যুর সংবাদকে ডজ দিয়ে আরও ১৫ বছর জীবন পেলেন হিন্দি গানের কিংবদন্তি শামসাদ বেগম। ভারতের কয়েকটি পত্রিকায় তাঁর মৃত্যুর খবর বেরিয়েছিল একবার। এটা ছিল নাম বিভ্রান্তিজনিত ভ্রান্তি। মৃত্যুবরণ করেছিলেন অন্য এক শামসাদ বেগম, দিলীপ কুমারের স্ত্রী সায়রা বানুর দাদি। সুকণ্ঠী শামসাদ বেগমের ৯৪ বছরের দীর্ঘ জীবনের অবসান ঘটে ২৩ এপ্রিল ২০১৩।

আজও যদি পুরান ঢাকার রেস্তোরাঁগুলোতে কার গান বাজছে এর ওপর একটি সমীক্ষা চালানো হয়, শামসাদ বেগম থাকবেন শীর্ষস্থানে। এক রেস্তোরাঁয় বাজছে ‘লেকে পেহলা পেহলা প্যায়ার, ভারতকে আঁখো মে খুমার’।

অন্যটিতে চলছে ‘সাইয়া দিলমে আনা রে/ আ কে ফির না জানা রে/ ও আ কে ফির না জানা রে/ ছম ছমা ছম ছম...’।

১৯৪০-এর দশকে গানের একচ্ছত্র সম্রাজ্ঞী ছিলেন শামসাদ বেগম, ১৯৫০-এর দশকে তাঁর সঙ্গে যোগ দিলেন আরেক কিংবদন্তি লতা মুঙ্গেশকর। ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে ব্যাপক জনপ্রিয়তা তাঁর গানের।

লতা মুঙ্গেশকর বলেছেন, শামসাদ বেগমের যে জনপ্রিয়তা, যে তারকাখ্যাতি এবং আমজনতার যে অশেষ শ্রদ্ধা তাঁর প্রতি, তিনি নিজে তা কখনো অর্জন করতে পারেননি।

১৯৪০-এর দশকে নায়িকার চেয়ে গায়িকার গুরুত্বকে অনেক বেশি করে তুললেন তিনি। ছবি হিট করাতে চাইলে পরিচালক ও প্রযোজকদের প্রথম পছন্দ শামসাদ বেগম। সেই দিনগুলোয় রেকর্ড করা প্রতিটি গানের জন্য পেতেন সাড়ে ১২ টাকা আর চলচ্চিত্রের জন্য গাইলে ১০০ টাকা। হিন্দি ছায়াছবির জগতে তিনি একেবারে গোড়ার দিককার কণ্ঠশিল্পী।

শামসাদ বেগমের জন্ম ১৪ এপ্রিল ১৯১৯, পাঞ্জাবের অমৃতসরে। শৈশব কাটে লাহোরে। রক্ষণশীল পরিবার ছিল বলে গলা খুলে গান গাওয়ার সুযোগ ছিল না। তাঁর সংগীতপ্রেমিক চাচা অনেক অনুনয়-বিনয় করে বড় ভাইয়ের অনুমতি নিয়ে অডিশন টেস্টে অংশ নিতে নিয়ে আসেন তাঁকে। শামসাদ তাঁর ব্যতিক্রমী কণ্ঠ দিয়ে উতরে যান। বাবা নানা শর্ত জুড়ে দেন, বোরকা পরতে হবে এবং কোনো ধরনের পার্টিতে যেতে পারবেন না। গান গাইতে পারছেন, এই আনন্দে সব শর্ত কবুল করে নেন শামসাদ।

১৫ বছর বয়সে বিয়ে করেন আইনজীবী গণপতলাল কাটোকে। বিয়ের পরও বাবাকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে চলেছেন। তবে রেডিও রেকর্ড ছাড়াও ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও বিয়ের আসরে তিনি গান গাইতেন।

সারেঙ্গির ওস্তাদ হুসেইন বক্সওয়ালে সাহেব তাঁর স্পষ্ট ও অননুকরণীয় কণ্ঠে মুগ্ধ হয়ে শামসাদকে তাঁর শিষ্য সুরকার লাহোরের গোলাম হায়দারের কাছে নিয়ে আসেন। গোলাম তাঁকে দিয়ে প্রথম প্লেব্যাক করান ১৯৪১ সালে খাজাঞ্চি ছবিতে, তারপর ১৯৪২ সালে খান্দান-এ। ১৯৪৪ গোলাম হায়দার লাহোর ছেড়ে স্থায়ীভাবে মুম্বাই চলে গেলে শামসাদও তাঁকে অনুসরণ করেন। সেখানে নবীন ও তুলনামূলক স্বল্পখ্যাত সুরকার নওশাদ আলী লেগে থাকেন শামসাদের পেছনে। শামসাদের কণ্ঠ আর নওশাদের সুর বাজার মাত করে দিল। গুরুদত্ত পরিচালিত কাভি আর কাভি পার ছবিতে শামসাদ বেগম সুপারহিট। ও পি নায়ায়ের সুরে সিআইডি ছবিতে শামসাদ ও মোহাম্মদ রফির ‘লেকে পেহলা পেহলা প্যায়ার’-এ ঠোঁট মিলিয়েছেন শাকিলা ও দেব আনন্দ। ১৯৫১ সালে বাহার ছবিতে শামসাদ বেগমের ‘ছাইয়া দিল মে আনা রে’ গানটি উপমহাদেশের সংগীতপ্রিয় একটি পরিবারও খুঁজে বের করা যাবে না, যেখানে দিনের পর দিন গাওয়া হয়নি। ছবির নায়িকা বৈজয়ন্তীমালা। নওশাদ মোগল--আজম ছবিতে একসঙ্গে দুই কিংবদন্তি শামসাদ বেগম ও লতা মুঙ্গেশকরকে নিয়ে এলেন।

সুরকার শিল্পী শচীন দেব বর্মণ শামসাদ বেগমের জন্য শবনম-এর গানে সুর করেছেন। ওপি নায়ার বলেছেন, মন্দিরের ঘণ্টার মতো সুস্পষ্ট শামসাদের কণ্ঠ। নওশাদ আলী, অনিল বিশ্বাস, সাজ্জাদ হোসেন, রামচন্দ্র, চিত্রগুপ্ত শঙ্কর-জয়কিষাণ তাঁকে দিয়ে শত শত গান গাইয়েছেন। শামসাদ বেগমের সমকালীন তাঁর প্রিয় শিল্পীরা হচ্ছেন: জোহরাবাঈ, আমিরবাঈ, বেগম আলতার, যূথিকা রায়, নূরজাহান।

একটা আফসোস তাঁর রয়েই গেছে, যদিও একই ছবিতে দুজনই গান গেয়েছেন (শাহজাহান), কে এল সায়গলের সঙ্গে তাঁর গান গাওয়া হয়নি। আরও একটি আফসোস, একমাত্র মেয়ে উষার সুরেলা কণ্ঠ থাকলেও বাবা তাকে মায়ের মতো গায়িকা হতে দেননি।