'আমি তো মরে বাঁইচা আছি'

সুখী আক্তার l ছবি: প্রথম অ​ালো
সুখী আক্তার l ছবি: প্রথম অ​ালো

‘যারা আমার চোখ কাইড়া নিছে তাগো এমুন শাস্তি চাই যে দ্যাশের মানুষ য্যান আজীবন তাদের ঘিন্না করে। তারা য্যান সমাজে মুখ না দেখাইতে পারে। আমি তো বাবা-মার বাড়িতে ভালাই ছিলাম। গরিব মা-বাবা আমার সুখ দেখবার লাইগ্যা অল্প বয়সে বিয়া দেয়। কিন্তু সুখ তো পাইলাম না।’ কথাগুলো বলছিলেন স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজনের ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার সুখী আক্তার (২৩)।
গত বছরের ১৭ জুলাই সুখীর স্বামী রবিউল ইসলাম, দেবর আক্তার হোসেন, ভাশুর ইদ্রিস আলী ও ননদ ডলি বেগম বৈদ্যুতিক কাজে ব্যবহৃত টেস্টার দিয়ে সুখীর ডান চোখ তুলে নেন। এ ঘটনায় সুখীর ভাই মহসিন বাদী হয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে রবিউল হোসেন, আখতার হোসেন ও ইদ্রিস আলীর বিরুদ্ধে মামলা করেন। সুখীর স্বামী রবিউল এখন কারাগারে। তাঁর দুই ভাই ও বোন পলাতক।
সুখী বলেন, ‘স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজনের লোভ অইছিল যৌতুক নিবার। যৌতুক না পাইয়া তারা টেস্টার দিয়া খুঁচাইয়া খুঁচাইয়া আমার ডান চোখ তুইল্যা নিল। আমি তো মইরাই গেছিলাম। এহন অন্ধ হইয়া কতকাল বাঁচমু তা আল্লাহই জানে। হেরা এহন আবার মামলা তুইল্যা নিবার লাইগ্যা আমগো মাইরা ফেলাইবার ষড়যন্ত্র করতাছে। আমি হেগো শাস্তি চাই।’
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি দুপুরে ঢাকার নবাবগঞ্জ থানার মোল্লাকান্দা গ্রামে সুখী আক্তারের বাবার বাড়িতে তাঁর সঙ্গে কথা হয়। সুখী তাঁর জীবনে ঘটে যাওয়া সেই ভয়াবহ ঘটনার কথা বলতে বলতে একপর্যায়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, ‘তখন আমি ক্লাস সেভেনে পড়ি। ২০০৫ সালে সিঙ্গাইর থানার মধুরচর গ্রামের মৃত আবদুল মিয়ার মেজো ছেলে রবিউল ইসলামের সঙ্গে আমার বিয়া হয়। আমার বয়স তখন মাত্র ১২ বছর। ওই বয়সে সংসার কী জিনিস বুঝতাম না। স্বামী তখন রিকশাভ্যান চালাইত। বিয়ের পর থেইক্যা স্বামী যৌতুকের জন্য আমারে নানাভাবে নির্যাতন করে। যৌতুকের জন্য শ্বশুরবাড়ির লোকজন অনেক জ্বালাইত আমারে। আমার সুখের কথা চিন্তা কইরা তিন-চার বছর আগে আমার মা-বাবা চার লাখ টাকা কর্জ করে দুবাই যাওয়ার জন্য রবিউলকে টাকা দেয়।’

সুখীকে বাড়িতে রেখে তাঁর স্বামী দুবাই চলে যান। সুখী বলতে থাকেন, ‘আমার দেবর ভালা মানুষ না। সে জুয়া খেলে। মাঝেমইধ্যে সে আমারে খারাপ কথা কইত। অনেক সময় আমি দৌড়ে অন্যের বাড়িতে চইলা যাইতাম। পরে নিজের সম্মান বাঁচাইতে আমি মায়ের বাড়ি চইলা আসি। এতে দেবর রাগ হইয়া আমার স্বামীর কাছে ফোন করে আমার নামে মিথ্যা বদনাম করছে।’

রবিউল প্রথমবার টানা আড়াই বছর দুবাই থাকেন। চাকরির টাকা তিনি তাঁর ভাইবোনের কাছে পাঠাতেন। গত বছরের মে মাসের শেষের দিকে দেশে ফিরে আসেন। স্ত্রী ও কন্যাসন্তান লুবনা আক্তারকে (৮) নিয়ে সাভারের কলমা গ্রামে একটি ভাড়াবাসায় ওঠেন ঈদুল ফিতরের মাস দেড়েক আগে। এর ১০-১২ দিন পর আবার রবিউল সিঙ্গাপুর যাবেন বলে স্ত্রীকে বাবার বাড়ি থেকে টাকা এনে দিতে বলেন। কিন্তু টাকা দিতে অস্বীকার করলে সুখীর ওপর নির্যাতন শুরু হয়। আর ১৭ জুলাই টেস্টার দিয়ে তুলে নেওয়া হয় তাঁর ডান চোখ।

‘আমি তো মরে বাঁইচা আছি। আমারে মাইরা ফেলার লাইগাই তারা আমার চোখ তুলে নিছে। অন্য চোখেও কম দেখতে   পাই। ডাক্তাররা কইছে, ডান চোখে একটা নকল চোখ লাগায়ে দিবে। তাতে অনেক  টাকা লাগবে, এটা আমি পামু কোথায়? তা ছাড়া আমার মেয়ে লুবনা ক্লাস থ্রিতে পড়ে। ওর লেখাপড়ার খরচ কে দিবে?’ বললেন সুখী।