একাত্তরের মায়েরা

.
.

রুমীর মা জাহানারা ইমাম ভাবছেন, ছেলে যদি অন্য ছেলেদের মতো বিছানায় পাশ-বালিশ শুইয়ে রেখে যুদ্ধে চলে যেত, তাহলেই তিনি বেঁচে যেতেন। ছেলে তাঁর আইএসসি পাস করেছে, ঢাকায় ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হয়েছে, আবার আমেরিকায় ইলিনয় ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতেও ভর্তি হয়েছে। আগস্টের শেষে তাকে যেতে হবে আমেরিকায়। এপ্রিলের শেষে (১৯৭১) সে যেতে চায় যুদ্ধে। শেষে মা বললেন, ‘দিলাম তোকে দেশের জন্য কোরবানি করে। যা, তুই যুদ্ধে যা।’ ছেলে আগরতলায় গেল, আগরতলায় ট্রেনিং নিয়ে ঢাকা শহরে ফিরে এসে অংশ নিল গেরিলা অপারেশনে। ১৯৭১ সালের আগস্টের শেষে পাকিস্তানি সৈন্যরা ঘেরাও করল জাহানারা ইমামদের বাড়ি। ধরে নিয়ে গেল রুমিকে, তার ভাই জামীকে, বাবা শরিফ সাহেবকে। রুমী আর ফিরল না। মা আজীবন আফসোস করতেন, কেন তিনি সেদিন বলতে গিয়েছিলেন ওই কথা। যদি বলতেন, যা যুদ্ধে, ফিরে আয় বীরের বেশে, হয়তো তা-ই হতো।
জুয়েলের পুরো নাম আবদুল হালিম চৌধুরী। জগন্নাথ কলেজ থেকে বিএসসি পাস করে কাজ করতেন একটা গ্লাস ফ্যাক্টরিতে। আসল পরিচয় তিনি ছিলেন ক্রিকেট খেলোয়াড়। আজাদ বয়েজ ক্লাবে খেলতেন, পরে মোহামেডানেও যোগ দিয়েছিলেন, ছিলেন মারকুটে ব্যাটসম্যান। তিনিও ছিলেন ঢাকার আরবান গেরিলা দলের সদস্য। মুক্তিযুদ্ধে একটা অভিযানে গুলি লাগে তাঁর আঙুলে। আগস্টের সেই ভয়াল রাতে তিনি ছিলেন আজাদদের বাড়িতে। সেখানেই পাকিস্তানি সৈন্যরা হানা দেয়। সহযোদ্ধা কাজী কামাল (পরে বীর বিক্রম) পাকিস্তানি সামরিক অফিসারের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে গুলি করে দৌড় ধরেন। কাজী কামাল পালিয়ে যেতে সক্ষম হন, কিন্তু জুয়েল, আজাদসহ অনেকেই ধরা পড়েন। জুয়েলের মায়ের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম ২০০৩ সালের ডিসেম্বরে। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি তো নিষেধ করেছিলাম জুয়েলকে যুদ্ধে যেতে।’ তখন এই মায়ের বয়স ৭৩। মুক্তিযুদ্ধের ৩৪ বছর পরেও শহীদ জুয়েলের মা স্বপ্নে দেখতেন জুয়েলকে, ‘জুয়েল ফুলবাগানে ঘুরছে। বলছে, মা দরজাটা বন্ধ কোরো না।’

.
.

আজাদ কিন্তু আগরতলা যায়নি। মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছিল তাদের মগবাজারের বাসায়। আর তাদের সঙ্গে দুটি অপারেশনে অংশ নিয়েছিল, ছোটবেলা থেকেই বন্দুক চালাতে জানত বলে। তার বাবা ছিলেন ভীষণ বড়লোক। আজাদের বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করলে ক্লাস সিক্সে পড়া একমাত্র ছেলেকে নিয়ে মা বেরিয়ে যান স্বামীগৃহ থেকে। বহু কষ্টে আজাদকে লেখাপড়া করান। আজাদ মাস্টার্স পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ২৯ আগস্ট দিবাগত রাতে, ৩০ আগস্ট আজাদরা ধরা পড়ে। আজাদের মা ছেলেকে দেখতে রমনা থানায় যান। ছেলেকে বলেন, ‘শক্ত হয়ে থেকো বাবা, কোনো কিছু স্বীকার করবে না।’ ছেলে বলে, ‘মা কত দিন ভাত খাই না। আমার জন্য ভাত নিয়ে এসো।’ পরদিন মা যত্ন করে ভাত রেঁধে নিয়ে যান ছেলের কাছে। গিয়ে দেখেন ছেলে নেই। এই ছেলে আর কোনোদিনও ফিরে আসেনি। আর এই মা ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন, আর কোনো দিনও ভাত খাননি।
আজাদের মা বিশ্বাস করতেন, ছেলে বেঁচে আছে, ফিরে আসবে। মাঝেমধ্যেই গুজব শুনতেন, ছেলেকে অমুকখানে দেখা গেছে। শুধু নিজের মৃত্যুর আগে তিনি বলে যান, ‘আমার ছেলে আসলে একাত্তর সালেই শহীদ হয়েছে, আমার কবরের গায়ে লিখে রাখবে, শহীদ আজাদের মা।’ ঢাকার জুরাইনে তাঁর কবরের গায়ে তাই লেখা আছে—শহীদ আজাদের মা।
তাদের সহযোদ্ধা হাবিবুল আলম বীর প্রতীক বই লিখেছেন ব্রেভ অব হার্ট। তাতে আমরা পাই এই বিবরণ—কীভাবে বিছানায় বালিশ রেখে চাদর দিয়ে ঢেকে পেছনের দরজা দিয়ে ছাদ মাড়িয়ে দেয়াল ডিঙিয়ে তিনি চলে গিয়েছিলেন যুদ্ধে।

.
.

আর মুক্তিযোদ্ধা শাহাদত চৌধুরী (পরে বিচিত্রা সম্পাদক) আমাকে বার বার বলতেন, ‘আনিস, তুমি আরেকটা বই লেখো, তাতে থাকবে মুক্তিযোদ্ধাদের মায়েদের কথা, বোনেদের কথা। তুমি সব মায়েদের কাছে যাও। দেখবে, একেকজন বোনের একেকজন মায়ের কী সাহস, কী প্রতিজ্ঞা!’
৪৫ বছর আগের এক মুক্তিযোদ্ধার মায়ের বয়স যদি তখন ৪০ হয়, এখন তাঁর বয়স হবে ৮৫। সব মায়ের কাছে যাওয়া হয়নি। কিন্তু যে কজন শহীদজননীর কাছে গিয়েছিলাম, দেখেছিলাম, তাঁদের সবাই এখনো ছেলের ছবি যত্নে আগলে রেখেছেন। যেমন রেখেছিলেন শহীদ জুয়েলের মা। তাদের টিকাটুলির বাসায়, জুয়েলের জন্য আলাদা একটা ঘর রেখেছিলেন সাজিয়ে। স্বপ্নেও মাকে জুয়েল বলত, দরজা খোলা রেখো।
মিলান কুন্ডেরা বলেছিলেন, ক্ষমতার বিরুদ্ধে মানুষের লড়াই হলো বিস্মৃতির বিরুদ্ধে স্মৃতির লড়াই। শহীদদের ও মুক্তিযোদ্ধাদের মায়েরা তা-ই করে গেছেন, করে যাচ্ছেন। অন্য সবাই তাঁদের ছেলেমেয়েদের অবদানের কথা ভুলতে পারেন, মায়েরা পারেন না। তাই তাঁরা ছেলের ছবি সাজিয়ে রাখেন, জন্মদিন মৃত্যুদিন পালন করেন। জুয়েলের মাকে বলেছিলাম, কী চান? তার জবাব ছিল, ‘আমার ছেলেকে যেন কেউ ভুলে না যায়, তা-ই চাই।’
শহীদ কিংবা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মায়েদের এই চাওয়ার কথা যেন আমরা ভুলে না যাই।