বাংলা ভালোবাসি

খান মো. আনোয়ারুস সালাম
খান মো. আনোয়ারুস সালাম

স্মার্টফোনের জন্য গুগল ট্রান্সলেটের একটা অ্যাপ্লিকেশন আছে। এটা খুলে পর্দায় আঙুল বা কাঠি দিয়ে লেখা যায়। হাতের লেখা কাকের ঠ্যাং হোক আর বকের ঠ্যাং—ক্ষতি নেই। গুগল ঠিক বুঝে ফেলে। অন্য ভাষায় সেটি অনুবাদও করে দেয়। খুব বেশি দিন হয়নি গুগল এই সুবিধা যোগ করেছে। এতে হাতে লেখা বাংলা ভাষা বুঝতে ও অনুবাদ করতে পারে গুগল ট্রান্সলেট। গুগলের হাতের লেখা শনাক্ত করার প্রযুক্তিতে বাংলা যোগ করার কৃতিত্বটা খান মো. আনোয়ারুস সালামের। কিছুদিন আগে পর্যন্ত তিনি ছিলেন বাংলাদেশে গুগলের কান্ট্রি ইঞ্জিনিয়ারিং কনসালট্যান্ট। এই কম্পিউটার প্রোগ্রামারের আগ্রহ যান্ত্রিক অনুবাদে (মেশিন ট্রান্সলেশন); মানে যন্ত্র নিজে নিজে একটা ভাষা বুঝে সেটাকে অন্য ভাষায় অনুবাদ করে দেবে। আর এ কাজ যন্ত্রকে দিয়ে করানোর জন্য দরকারি অ্যালগরিদম, প্রোগ্রাম বানিয়ে দেন খান মো. আনোয়ারুস সালাম।
কম্পিউটারে আনোয়ারের শুরুটা সেই কৈশোরে। ১৯৮৬ সালের ২৪ ডিসেম্বর চাঁদপুরে জন্ম। বাবা মো. আবদুস সালাম খান ব্যাংকার, মা আনোয়ারা চৌধুরী শিক্ষকতা করতেন। বললেন, ‘ঢাকায় যখন নবম শ্রেণিতে পড়ি, তখন প্রচুর গেম খেলতাম। খেলতে খেলতে গেম বানাতে ইচ্ছা হলো।’ গেম বানাতে জানতে হবে প্রোগ্রামিং। ভাই খান মো. মাহফুজুস সালাম ভিজ্যুয়াল বেসিকের একটা বাংলা বই কিনে দেন। ওটা দেখে শুরু হলো আনোয়ারের ছোট ছোট গেম বানানো। এটা ১৯৯৯-২০০০ সালের কথা। আনোয়ারের বড় ভাই খান মো. মাহবুবুস সালাম তখন জাপানে থাকতেন। ‘মেজো ভাই (মাহফুজ) তাঁকে বাংলায় ই-মেইল লিখতে চাইতেন। তখন ৮ ফাল্গুন নামে একটা সফটওয়্যার ছিল, সেটা দিয়ে মাউস ক্লিক করে করে একেকটা ই-মেইল দুই দিন ধরে লিখতেন মেজো ভাই। তখন আমার মাথায় এল সহজে বাংলা লেখা যায় কীভাবে?’ বললেন আনোয়ারুস সালাম।
৮ ফাল্গুন প্রোগ্রামটিতে যুক্তাক্ষর লেখা খুবই কঠিন ছিল। আনোয়ার মন দিলেন এদিকে। ২০০১ সালে শুরু করলেন তাঁর বাংলা লেখার প্রোগ্রামের কাজ। ২০০৩-এ তৈরি করলেন ‘অক্ষর’ সফটওয়্যার। তখন তাঁর বয়স ১৬ বছরের কিছুটা বেশি। অক্ষর-এ শুধু যে মাউস ক্লিক করে লেখা যায় কিংবা সহজে যুক্তাক্ষরগুলো আনা যায় তা নয়, এটিতে ইংরেজিতে ‘amar’ লিখে বাংলায় ‘আমার’ পাওয়া যায়; মানে ফোনেটিক কি-বোর্ড। ‘সে সময় বাংলার জন্য তেমন কোনো ফোনেটিক কি-বোর্ড ছিল না।’ বললেন তিনি।
টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে আনোয়ার চিহ্নিত করলেন ২০০৩ সালের জানুয়ারিতে প্রথম আলোর প্রজন্ম ডটকম পাতায় অক্ষর সফটওয়্যার নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনটিকে। ওই বছরই বিসিএস কম্পিউটার শোতে পুরস্কার পায় অক্ষর। বুয়েটের একটা সফটওয়্যার প্রতিযোগিতায়ও পুরস্কার পায় এটি। সেখানে আনোয়ারের ব্যাপারে আগ্রহ দেখান অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী। ১৪১১ (২০০৪ সাল) বাংলা নববর্ষের দিনে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে অক্ষর-এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হলো। সবার প্রশংসা পেলেন খান মো. আনোয়ারুস সালাম।
২০০৪ সালে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন খান মো. আনোয়ারুস সালাম। জামিলুর রেজা চৌধুরী তখন সেখানকার উপাচার্য। কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগে পুরো বৃত্তি নিয়েই ভর্তি হন তিনি। আর তা অক্ষর সফটওয়্যারের কারণে। পড়াশোনার পাশাপাশি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সিআরবিএলপির রিসার্চ ফেলো হিসেবেও কাজ করেন। তখনই যান্ত্রিক অনুবাদ নিয়ে গবেষণার শুরু আনোয়ারের।
স্নাতক হওয়ার পর জাপানের মনবুশো বৃত্তি নিয়ে পড়তে যান টোকিও ইউনিভার্সিটি অব ইলেকট্রো কমিউনিকেশনসে। বিষয় ওই যান্ত্রিক অনুবাদ। ‘জাপানে যাওয়ার মূল কারণ সেখানে যান্ত্রিক অনুবাদ নিয়ে অনেক কাজ হয়। আর ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে যান্ত্রিক ভাষা ইউএনএলের (ইউনিভার্সাল নেটওয়ার্কিং ল্যাঙ্গুয়েজ) উদ্ভাবক হিরোশি উচিদার সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পাব।’ বলেন, আনোয়ার। উচিদার সঙ্গেই কাজ করেছেন খান মো. আনোয়ারুস সালাম। ধীরে ধীরে যান্ত্রিক অনুবাদে বাংলাকে যোগ করেছেন। টোকিওতে ২০১১, ’১২ ও ’১৩-এর ২১ ফেব্রুয়ারি উদ্যাপন করা হয় ইউএন মডেল কনফারেন্সের মাধ্যমে। এখানে সম্মেলনের বিষয়গুলো অংশগ্রহণকারী প্রত্যেকের কম্পিউটারে যার যার ভাষায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে অনূদিত হয়ে যেত। বাংলার অংশটা যথারীতি আনোয়ারই করে দেন। স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি সম্পন্ন করার পর ২০১৪ সালে গুগলে যোগ দেন আনোয়ার। বাংলা নিয়ে কাজ করতে চান, তাই গুগলের সিঙ্গাপুর অফিসের অধীনে বাংলাদেশে কান্ট্রি ইঞ্জিনিয়ারিং কনসালট্যান্ট হিসেবে কাজ শুরু করেন খান মো. আনোয়ারুস সালাম। গুগলের আছে গুগল ডেভেলপার গ্রুপ (জিডিজি)। আনোয়ার প্রস্তাব করেছিলেন গুগল ল্যাঙ্গুয়েজ গ্রুপ চালু করার। আলাদা গ্রুপ হয়নি, তবে পৃথিবীর একমাত্র ভাষাভিত্তিক ডেভেলপার গ্রুপ হয়েছে জিডিজি-বাংলা। অন্য সব জিডিজি শহরভিত্তিক। আনোয়ার মনে করেন, ২০১৫ সালে জিডিজি বাংলার নেওয়া ‘বাংলার জন্য চার লাখ’ কর্মসূচি গুগলের যান্ত্রিক অনুবাদে বাংলাকে আগের চেয়ে বেশ খানিকটা সমৃদ্ধ করতে পেরেছে।
এ বছরই গুগল ছেড়েছেন খান মো. আনোয়ারুস সালাম। যোগ দিয়েছেন ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকে, সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে। গত ফেব্রুয়ারিতে নিজের প্রতিষ্ঠান ড্রিমডোর সফট থেকে বানিয়েছেন বাংলা হিসাবরক্ষণ সফটওয়্যার ‘হিসাব-নিকাশ’। এটি অনলাইন থেকে এখনো বিনা মূল্যে ব্যবহার করা যায়। দোকানের ইলেকট্রনিক ক্যাশ রেজিস্টার, কম্পিউটারসহ যেকোনো যন্ত্রেই বাংলায় হিসাব কষা যাবে। বিল, ভাউচার, স্লিপ বাংলায় প্রিন্ট করা যাবে অনায়াসেই।
খান মো. আনোয়ারুস সালাম বড় পরিসরে বিস্তৃত আকারে যন্ত্রে বাংলা ভাষার প্রয়োগ ঘটাচ্ছেন, ছড়িয়ে দিচ্ছেন বিশ্বময়। বললেন, ‘বাংলা নিয়ে কাজ করতে চাই। প্রচুর গবেষণা করার রয়েছে।’ আর সেটাই ধ্যানজ্ঞান এই প্রযুক্তি গবেষকের।