সাঁতারে স্বর্ণোজ্জ্বল!

মাহফুজা খাতুন
মাহফুজা খাতুন

জীবনের সেই দিনটির কথা যখন বলেন, চোখ ভিজে আসে তাঁর। লুকোতে পারেন না মনের ভেতরে জমে থাকা দুঃখগাথা। বাবার চিকিৎসার জন্য মা একদিন ছোট মেয়েটির দুটি সোনার পদক বিক্রি করে দিলেন। কয়েক বছর আগে ঢাকায় বাংলাদেশ শিশু একাডেমীর সাঁতার প্রতিযোগিতায় এসে পেয়েছিল মেয়েটি। সেই পদক বিক্রির দুঃখ তাঁকে এগিয়ে চলার পথে দিয়েছে অন্তহীন প্রেরণা। সেটির কল্যাণেই সব বাধা পেরিয়ে হয়ে উঠেছেন আজকের মাহফুজা খাতুন, যিনি শিলা নামেও পরিচিত!
এ নামটি এখন সুবাস ছড়ায় ক্রীড়াঙ্গন ছাপিয়ে সবখানে। গত ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে জোড়া সোনার হাসিতে ভরিয়েছেন গোটা বাংলাদেশকে। দক্ষিণ এশীয় গেমসের (এসএ গেমস) মঞ্চে বাংলাদেশের নারীদের তুলে ধরেছেন অনেক উঁচুতে। মাহফুজা এখন নারী সংগ্রামের প্রতীক, তারুণ্যের মশাল হাতে হাজারো নবীনের আদর্শ। অথচ এই মাহফুজাকে কদিন আগেও কে চিনত! এমন কত মাহফুজাই বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে এসে হারিয়ে যান, অন্যায়-অবিচারের শিকার হয়ে ফেরেন আপন ঠিকানায়। কেউ কেউ লম্বা সময় ধরে স্রোতের বিরুদ্ধে বৈঠা বেয়ে টিকেও থাকেন। কিন্তু মাহফুজার মতো কজন পারেন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে, হাজার ওয়াটের আলো টেনে নিতে পারেন এই অনগ্রসর ক্রীড়া সংসারে! মাহফুজা পেরেছেন বলেই গর্ব নিয়ে বলতে পারেন, ‘আমি হারিয়ে যেতে আসিনি বলেই টিকে ছিলাম।’ সেই লড়াইয়ের দিনগুলোতে কোচের চোখে চোখ রেখে এই মাহফুজাই বলেছিলেন, ‘পারলে আপনি আমাকে বাদ দেন! আমি খেলবই।’ মাহফুজা খেলার জন্যই শুধু খেলেননি, নিজেকে শাণিত করে উঠেছেন বিজয়স্তম্ভেও। সেই দৃশ্য তাঁকে ফিরিয়ে নেয় সংগ্রামী দিনগুলোতে, ‘একজন কোচ আমাকে জাতীয় দলে খেলাবেন না বলে দিয়েছিলেন। কিন্তু আমি তাঁকে চ্যালেঞ্জ করেছিলাম এবং শেষ পর্যন্ত আমিই জিতেছি।’ জয়ী হওয়ার এই সংগ্রামে সয়েছেন অনেক অবহেলা। কত কাঁটার আঘাত! দেশের অন্যতম সেরা সাঁতারু হলেও তাঁকে বাইরে প্রশিক্ষণ দূরে থাক, বিদেশে কোনো প্রতিযোগিতায় পাঠানো হয়নি। তবে মন খারাপ করলেও পরক্ষণে চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞায় ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। সব উপেক্ষার জবাব দিতে চেয়েছেন এসএ গেমসে। যেখানে আগের দুবার অল্পের জন্য সোনাবঞ্চিত হয়েছেন প্রিয় ব্রেস্ট স্ট্রোক ইভেন্টে। ২০০৬ সালে ব্রোঞ্জ, ২০১০ সালে রুপা আর ২০১৬ সালে সোনা—এভাবেই মাহফুজা লিখলেন সাফল্যের অনন্য এক কাব্য। বাংলাদেশের ক্রীড়া ইতিহাসে তিনিই একমাত্র নারী সাঁতারু, যাঁর গলায় উঠেছে দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্বের মালা। একবার নয়, দু-দুবার এবং একই প্রতিযোগিতায়! অবিশ্বাস্য, অকল্পনীয়। শুধু নীরব সাধনাই নয়, নীরব লড়াইয়ের বড় এক বিজ্ঞাপনও হয়ে উঠেছেন মাহফুজা। যশোরের অভয়নগরের পাঁচকবর গ্রামের একটা মেয়ের ঢাকায় আসা, পুলে নেমে পানির সঙ্গে সখ্য...সহজ ছিল না মোটেও। কৃষক বাবা আলী আহমেদ গাজী মেয়েকে ঢাকায় আসার টাকা দিতে পারতেন না। তাঁর জমিজমা যা ছিল, বেশির ভাগই বিলিয়ে দিয়েছেন। স্কুল-কলেজের জন্য দান করেছেন ৭২ শতক জমি। নিজের এখন আছে মাত্র ৭-৮ শতক। এলাকার অনেকেই পাশে দাঁড়িয়ে মাহফুজার দিকে বাড়িয়েছিলেন সহায়তার হাত। বিকেএসপিতে ভর্তি হলেন ২০০২ সালে। ভর্তির টাকা, জামানতের পাঁচ হাজার টাকা, পোশাক, বেতন—কত লড়াই করতে হয়েছে! কিন্তু জীবনের চাকা থেমে থাকেনি। বিকেএসপির ‘সোলায়মান স্যার’ বলতেন, খেলায় ভালো করলে তিনি বিকেএসপির মহাপরিচালককে অনুরোধ করে বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ করে দেবেন। মাহফুজা ভালো করতেন সাঁতারে। তাই আর্থিক ব্যাপারে ছাড় পেতেন। সেসব ছাপিয়ে আরেকটি গল্পও মাহফুজার জীবন সার্থক করে তুলেছে। ব্যতিক্রমী উদাহরণ গড়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতায় øস্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছেন, খেলার ফাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতেন। জাতীয় প্রতিযোগিতা, জাতীয় দল, বিশ্ববিদ্যালয় এবং নৌবাহিনীর চাকরি—সবই সামলেছেন দারুণভাবে। এমনও হয়েছে, বিকেলে মিরপুর সাঁতার পুলে প্রতিযোগিতা শেষ করেই ছুটেছেন চট্টগ্রামের বাস ধরতে। কখনো সাহস হারাননি, খেলার পর বই নিয়ে বসেছেন। সব সময়ই তাঁর চোখে মায়াঞ্জন বোলাত বড় কিছু করার স্বপ্ন। হোক না তিনি দোচালা টিনের ঘরের প্রতিনিধি। কিন্তু অদম্য ইচ্ছার জোরে আজ সেই মেয়েটিই নিজের চারপাশে গড়েছেন ‘রাজপ্রাসাদ’। এই মাহফুজা নাম এখন দেশের প্রধানমন্ত্রীর মুখেও। তাঁর বাড়িতে লেগেছে পল্লী বিদ্যুতের সংযোগ। বিক্রি করা মেডেল দুটির সোনা কিনে দেওয়ার অঙ্গীকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি পেয়েছেন স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তাদের কাছ থেকেও। তাঁকে দেখলে এখন লোকে ছুটে আসে, রাস্তায় দাঁড়িয়ে সেলফি তোলে। বদলে যাওয়া জীবনে কদিন আগে ঘর বেঁধেছেন। বন্ধু থেকে স্বামী হওয়া শাহজাহান আলীও একজন চ্যাম্পিয়ন সাঁতারু, ২০০৬ সালের এসএ গেমসে ওই ব্রেস্ট স্ট্রোক সাঁতারেই সোনার পদক তুলেছেন গলায়। মাহফুজা পেছনে তাকিয়ে বলেন, ‘লম্বা একটা ভ্রমণ আপাতত শেষ করলাম। শেষটা এত মধুর হবে ভাবিনি।’ আলী আহমেদও ভাবেননি মেয়ে এভাবে চমকে দেবে সবাইকে। যশোরের বাড়ি থেকে ফোনে কেঁদেই ফেললেন গর্বিত বাবা, ‘আমার সম্পদ আমার মেয়ে।’ সেই মেয়ের কল্যাণেই এখন তাঁর চিকিৎসার ভার নিতে চারপাশে কত কত সহায়তার হাত! এমন ধন্যি মেয়ে থাকলে বাবা-মায়ের আর কী চাই জীবনে।