'বেগম'-এর নূরজাহান বেগম

>
নূরজাহান বেগম l ছবি: প্রথম আলো
নূরজাহান বেগম l ছবি: প্রথম আলো

বেগম পত্রিকার সম্পাদক নূরজাহান বেগম চলে গেলেন গতকাল ২৩ মে। বেগম পত্রিকা প্রকাশের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ২০০০ সালের ৮ নভেম্বর নারীমঞ্চে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করা হয়েছিল। সেই সংখ্যায় প্রকাশিত নূরজাহান বেগমের বিশেষ সাক্ষাৎকার এবং এক নজরে বেগম পত্রিকা এখানে আবার প্রকাশ করা হলো।  এ ছাড়াও পরবর্তীকালে রস+আলোতে প্রকাশিত আরেকটি সাক্ষাৎকার পুনর্মুদ্রণ করা হলো।
নারী সাংবাদিকতা, লেখালেখিতে মেয়েদের অংশগ্রহণের পথিকৃৎ  নূরজাহান বেগমের প্রতি নারীমঞ্চের শ্রদ্ধাঞ্জলি।

‘ভেতরে আসতে পারি?’
—‘আসুন।’
—‘না, মানে আমরা নতুন অ্যাডভোকেট হয়েছি। গাউনের কাপড় কিনতে এসেছিলাম পাশের দোকানে। হঠাৎ চোখে পড়ল সাইনবোর্ড সাপ্তাহিক বেগম, তাই ঢুকে পড়লাম।’
চার যুবকের একজন বললেন, ‘ছোটবেলায় দেখেছি আমার মা বেগম পড়তেন। আমার নাম রাখা হয়েছে বেগম পত্রিকা থেকে। সেই পত্রিকা এখনো আমাদের বাসায় রাখা আছে। পোকায় খেয়ে গেছে। ছোটবেলা থেকেই নূরজাহান বেগমের নাম জেনেছি। আপনাকে পত্রিকার ছবিতে দেখেছি, টিভিতে দেখেছি। আজকে সামনাসামনি দেখতে পেরে খুব ভালো লাগছে।’
‘তোমার মা আছেন?’
‘িজ’
‘আমার সালাম দিয়ো।’
‘িজ, অবশ্যই বলব। দুদিন আগেই তো বেগম–এর ৫০ বছর পূর্তি হলো, তাই না?’ অতঃপর যুবক চারজন চলে গেল। নূরজাহান বেগম কৃতজ্ঞতার দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে রইলেন খোলা দরজার দিকে, যুবকদের চলে যাওয়ার জুতার মচমচ শব্দের দিকে। পুরান ঢাকার পুরোনো বাড়ির বড় জানালা ছাপিয়ে রোদ এসে পড়ছিল তঁার মুখে। কে বলবে গোলাপি শাড়ি পরা গোলাপি বরেনর এই মানুষটির বয়স পঁচাত্তর!
এই ২ নভেম্বর। দুপুরবেলা। ৬৬ পাটুয়াটুলী। বেগম অফিসে বসে বেগম সম্পাদক নূরজাহান বেগমের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করার এক ফঁাকেই ঘটেছিল ঘটনাটা।
পাঠক চলুন, ৫০ বছর পূর্তির পর বেগম সম্পাদক নূরজাহান বেগমের মুখোমুখি হই।
প্রথম আলো: ৫০ বছর তো পার হয়ে গেল বেগম–এর।
নূরজাহান বেগম: যদি বছরের হিসাব করি তাহলে ৫৩ বছর পার হলো, কিন্তু পত্রিকার সংখ্যার দিক থেকে ৫০ বছর পূর্তি। এক বছরে ৪৮টি সংখ্যা বের হয়।
প্র. আ.: বেগম–এর শুরুর কথাটা যদি বলতেন।
নূ. বে.: ১৯৪৭ সালের ২০ জুলাই কলকাতা থেকে প্রথম বের হয় সাপ্তাহিক বেগম। আমার বাবা সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসির উদ্দীনই এই পত্রিকাটি বের করার উদ্যোগ নিলেন। তখন দাঙ্গার কারণে কলকাতায় আমরা অশান্তির মধ্যেই ছিলাম। তবু বাবা মেয়েদের সাহিত্যচর্চার জন্য একটি আলাদা কাগজ বের করার উদ্যোগ নিলেন। বাবা সুফিয়া কামালকে বললেন বেগম–এর সম্পাদক হওয়ার জন্য। আমি তখন সবে কলেজ থেকে বের হয়েছি। আমি হলাম ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক।
সবচেয়ে বড় কথা, সে সময় মেয়েরা পত্রিকা অফিসে এসে লেখা দিয়ে যেতে পারতেন না। কিন্তু হিন্দু এবং মুসলিম মেয়েরা ডাকে প্রচুর লেখা পাঠাতেন। এবং উভয় সম্প্রদায়ের মেয়েদের মধ্যেই বেগম জাগরণ সৃষ্টি করতে পেরেছিল।

.
.

প্র. আ.: বেগম–এর বিশেষ সংখ্যা বের হলো কবে প্রথম?
নূ. বে.: কলকাতা থেকে বেগম–এর তৃতীয় বর্ষ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে (১৯৪৭-১৯৫০), সেখানে আমরা তিনটি বিশেষ সংখ্যা বের করেছি। দুটি ঈদসংখ্যা, একটি বিশ্বনবী বিশেষ সংখ্যা। ঢাকায় আসার পর ১৯৫১-৫২ থেকে আবার বেগম–এর বিশেষ ঈদসংখ্যা বের হলো। বরাবর লেখিকাদের ছবি দিয়ে ঈদসংখ্যা প্রকাশ হয় বেগম–এর। এতে লেখিকারা পরস্পরকে চিনতে পারেন।
প্র. আ.: বেগম ক্লাব শুরু হলো কবে?
নূ. বে.: ১৯৫৪ সালে বাবা বেগম ক্লাবের জন্ম দিলেন। এই ক্লাবই লেখিকাদের একত্রিত করতে সহযোগিতা করল। তঁারা একসঙ্গে হয়ে আলাপ-আলোচনা করতেন। প্রথম দিকে মাসে একবার। পরের দিকে বছরে একবার।
প্র. আ.: কোথায় বসতেন?
নূ. বে.: এই তো এই অফিসেই। পাশের ঘরে। ১০০ জন বসার ব্যবস্থা ছিল। পরের দিকে বিশিষ্ট লেখিকাদের সংবর্ধনা দেওয়া শুরু করল বেগম ক্লাব। প্রথম সংবর্ধনা দেওয়া হয় কবি সুফিয়া কামালকে। শামসুন্নাহার মাহমুদ ছিলেন বেগম ক্লাবের সভানেত্রী আর সেক্রেটারি ছিলাম আমি।
প্র. আ.: একটা কথা বলি? একটা ক্লাব চালাতে তো কিছু টাকাপয়সার প্রয়োজন হয়। বেগম ক্লাবের অর্থের উৎস কী ছিল?
নূ. বে.: পুরোটাই চালাতেন বাবা। সওগাত প্রেস থেকেই আসত। কোনো দান বা অনুদান নেওয়া হয়নি। আর বেগম পত্রিকাটিও এক অর্থে চালাতেন বাবাই। আমরা তঁার সহযোগী ছিলাম মাত্র। একেবারে শেষের দিকে তঁার অসুস্থতার কারণে তিনি আমাদের ওপর দায়িত্ব ছেড়ে দেন। তবু ১৯৯৪ সালে বাবা মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত তঁাকেই আমরা বেগম–এর সবকিছু দেখিয়ে নিতাম।
প্র. আ.: বেগম ক্লাবের কর্মকাণ্ড কদিন চলল?
নূ. বে.: সত্যি বলতে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত বেগম ক্লাবের কর্মকাণ্ড চলেছে।
প্র. আ.: বেগম–এর ছবি কোথায় পেতেন?
নূ. বে.: বিভিন্ন পত্রিকা থেকে নিতাম। সওগাত পত্রিকার ব্লক ব্যবহার করতাম। ঢাকায় এসে ফটোগ্রাফার সাঈদা খানমের ছবি পেয়েছি। আর মডেল? কোথায় পাব? কেউ রাজি হয় না। এর বোন, ওর খালার ছবি তোলা হতো প্রচ্ছদের জন্য। এখনকার অবস্থা তো ভিন্ন। তবে বেগম প্রচ্ছদের ছবিটিকে কখনোই ডিস্টার্ব করে না। শিরোনাম প্রচ্ছদে দেয় না। বেগম মনে করে ছবিটা একটা শিল্প। ওটা নষ্ট করা ঠিক নয়। সূচি তো ভেতরে আছেই।
প্র. আ.: বেগম–এর শুরুর চেহারা আর এখনকার চেহারায় অনেক অমিল?
নূ. বে.: অনেক ক্ষেত্রে শুরুর রীতিটাই আছে। যেমন বিশেষ সংখ্যায় লেখিকাদের ছবি ছাপা, প্রচ্ছদে শিরোনাম না লেখা...তবে এখন তো ব্লকে না ছেপে কম্পিউটারে কম্পোজ হয়। অফসেটে ছাপা হয়। চেহারা তো পাল্টাবেই। তা ছাড়া ডিমাই সাইজ থেকে ম্যাগাজিন সাইজ হয়েছে।
প্র. আ.: এখন যে বিভিন্ন পত্রিকার সঙ্গে মেয়েদের পাতা রয়েছে, সেগুলো কি আপনি পড়েন? কেমন লাগে?
নূ. বে.: অবশ্যই পড়ি। ভালো লাগে। গর্ব লাগে। মেয়েরা সাংবাদিকতা করছে সেটা দেখে মনে হয় বেগম–এর সংগ্রাম বৃথা যায়নি। তবে ইদানীং আমার মনে হয়, বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকার সঙ্গে যে বিশেষ ফিচার পাতাগুলো বের হচ্ছে, তাতে করে সাপ্তাহিক বা পাক্ষিক ম্যাগাজিনের পাঠক-পাঠিকা হারিয়ে যাচ্ছে।
প্র. আ.: বেগম–এর বয়স তো ৫০ হলো। আপনার বয়স কত লিখব?
নূ. বে.: (বিস্ময়মাখা কণ্ঠে) কত লিখব মানে? যা বয়স তা-ই লিখবে? আমার জন্ম ২০ জুন ১৯২৫। ৭৫ বছর বয়স আমার।
প্র. আ.: ২০ জুন? সেকি, তাহলে তো দুজনের জন্মদিন একদিনেই। আপনার এবং সুফিয়া কামালের!
নূ. বে.: ও হো, আমার জন্মদিন তো ৪ জুন। দেখো তো সুফিয়া খালা, বেগম আমাদের জীবন এত ওতপ্রোতভাবে জড়ানো যে তঁার জন্মদিনের তারিখটাই বলে ফেলেছিলাম। উঠে চলে আসছি। হঠাৎ চোখ পড়ল বেগম অফিসের ছোট আধুনিক ডিজাইনের কাঠের চেয়ারগুলোর দিকে। ‘বাহ্, চমৎকার ডিজাইন তো’ বললাম। জবাবে হেসে দিলেন নূরজাহান বেগম, ‘এই চেয়ারগুলোর বয়সও ৫০ পার হলো। বেগমের শুরু থেকে এরা আছে। কলকাতা থেকে যখন চলে এলাম আমরা, তখন এই বেগম–এর চেয়ারগুলোও এসেছে।’ আশ্চর্য! কে বলবে? অথচ দেখে মনে হয় এই তো সেদিনের কেনা। হালের কোনো ডিজাইনারের ডিজাইনে তৈরি। ঠিক যেন বেগম–এরই মতো। ৫০ বছরেও টিকে থাকা।
(সংক্ষেপিত)