বাংলা ভাষাপ্রেমী বরিস পালইয়ানস্কি

আধুনিক রাশিয়ায় যে কজন লেখক-অনুবাদক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাজ নিয়ে গবেষণা করছেন, বরিস পালইয়ানস্কি তাঁদের অন্যতম। ​ছবি: জামিল খান
আধুনিক রাশিয়ায় যে কজন লেখক-অনুবাদক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাজ নিয়ে গবেষণা করছেন, বরিস পালইয়ানস্কি তাঁদের অন্যতম। ​ছবি: জামিল খান

রাশিয়ায় অনেক প্রবীণের কাছে আজও উজ্জ্বল হয়ে আছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। গোটা সোভিয়েত ইউনিয়নের স্কুলগুলোতে একসময়ে নিয়মিত রবীন্দ্রনাথের কবিতা কিংবা ছোটগল্প পড়ানো হতো। এখনো অনেক রুশ তাঁদের মনে লালন করে চলেছেন এই কবিকে।

বরিস পালইয়ানস্কি
বরিস পালইয়ানস্কি

আধুনিক রাশিয়ায় যে কজন লেখক-অনুবাদক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কর্ম নিয়ে গবেষণার কাজ করছেন, বরিস পালইয়ানস্কি তাঁদের অন্যতম। ‘শৈশব ও কৈশোরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’ শিরোনামে রুশ ভাষায় তাঁর লেখা একটি বইয়ের প্রদর্শনী গত ১১ মে মস্কোতে অনুষ্ঠিত হলো। এতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিঠি, ডায়েরি, প্রবন্ধসহ বিভিন্ন লেখার সংকলন রয়েছে। এ ছাড়া ঠাকুর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কবির সম্পর্কের বিশ্লেষণ এবং কবির প্রথম যুক্তরাজ্য সফরে যাওয়ার অনুভূতির মতো বিষয়গুলো খুব সহজ ও সাবলীল রুশ ভাষায় উপস্থাপন করা হয়।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫৫তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে ওই দিন রাশিয়ার সরকারি গ্রন্থাগারের প্রাচ্য সাহিত্য কেন্দ্র এবং মস্কোর ভারতীয় দূতাবাসের জওহরলাল নেহরু সাংস্কৃতিক কেন্দ্র যৌথভাবে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
কে এই বরিস পালইয়ানস্কি?
পুরো নাম পালইয়ানস্কি বরিস গাভরিলোভিচ। বরিস পালইয়ানস্কি ১৯২৫ সালের ২৭ অক্টোবর কুরস্ক শহরে জন্মগ্রহণ করেন। মস্কো থেকে প্রায় ৫৩০ কিলোমিটার দূরবর্তী ওই শহরেই তাঁর বেড়ে ওঠা। পড়াশোনা করেন মস্কো আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে। পেশাদার অনুবাদক ও দোভাষী হিসেবে রাশিয়ায় তাঁর যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। মস্কোর প্রাচ্য ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়ে বাংলা ভাষা শেখার সুযোগ পান তিনি এবং ধীরে ধীরে ভারতীয় উপমহাদেশের কৃষ্টি-সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিতি লাভ করেন। নতুন একটি বিদেশি ভাষা শিখতে কেমন লেগেছিল, এমন প্রশ্নের জবাবে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘যেকোনো বিদেশি ভাষা সে তো কঠিন, বিশেষ করে বাংলা। তবে আমার কাছে বিশেষ কঠিন ছিল না; আকর্ষণ নিয়ে বাংলা শিখেছি। পরিচিত বাঙালিদের কাছেও অনেক কিছু শিখেছি।’
আমার হৃদয় তোমার আপন হাতে
বরিস পালইয়ানস্কি তাঁর বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের বিভিন্ন সময়ে দোভাষী, প্রকাশনা সংস্থার সম্পাদক এবং শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। মস্কোর কূটনৈতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনি খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে বাংলা ভাষা শেখাতেন। একবার চাকরির সুবাদে ১৯৬১ সালে তাঁকে ভারতে যেতে হয়েছিল। সেখানে এক রবীন্দ্রসংগীতানুষ্ঠানে খ্যাতিমান বাঙালি কণ্ঠশিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের দেখা পান তিনি। অনুষ্ঠানের বিরতির একপর্যায়ে বরিস পালইয়ানস্কির সঙ্গে আলাপচারিতার সময় বাংলা ভাষার প্রতি তাঁর অসাধারণ দক্ষতা দেখে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় দারুণ মুগ্ধ হয়েছিলেন। অনুষ্ঠানের বাকি অংশের পুরোটা সময়ে বরিস পালইয়ানস্কিকে মঞ্চে নিজের পাশে বসিয়ে গান পরিবেশন করেন হেমন্ত। ওই দিন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘আমার হৃদয় তোমার আপন হাতে দোলে, দোলাও দোলাও দোলাও’ গানটি আজও তাঁর মনে দাগ কেটে রয়েছে। এই প্রতিবেদকের অনুরোধে চার লাইন গেয়েও শোনালেন বরিস পালইয়ানস্কি।
বরিস পালইয়ানস্কির আরও একটি পরিচয় আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে (১৯৪১-১৯৪৫) নাৎসি জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেন। যুদ্ধে রেড আর্মির বিজয় রুশ ভাষাভাষী মানুষদের জন্য বিরাট জাতীয় গৌরবের বিষয় হয়ে রয়েছে।
মস্কোর প্রাচ্য সাহিত্য কেন্দ্রের সবাই বরিস পালইয়ানস্কিকে এক নামে চেনেন। এই কেন্দ্রে অনেক বছর ধরে কর্মরত আছেন পশ্চিমবঙ্গের স্মিতা সেনগুপ্ত। এই প্রতিবেদককে তিনি জানান, ‘রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় গ্রন্থাগারের সঙ্গে বরিস পালইয়ানস্কির রয়েছে অনেক বছরের সম্পর্ক। ২০০৬ সালে প্রাচ্য সাহিত্য কেন্দ্র নিজস্ব ভবনে যাওয়ার পরেই তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে এবং সেই থেকে তাঁকে নিয়মিত আমাদের কেন্দ্রে আসা-যাওয়া করতে দেখতাম।’
বরিস এখন
বরিস পালইয়ানস্কির বয়স এখন প্রায় নব্বইয়ের কোঠায়। অবসর নিয়েছেন। বয়সের ভারে আর আগের মতো একা চলাফেরা করতে পারেন না। খুব একটা দরকারি কাজ ছাড়া ঘরের বাইরে বের হন না। তা ছাড়া একা চলাফেরা করতেও তাঁর কষ্ট হয়। তাই বই পড়ে কিংবা টিভি দেখে সময় কাটান। বাড়িতে বসেই নীরবে-নিভৃতে চলছে তাঁর বাংলা সাহিত্যচর্চা। বাংলা ভাষার টানে মাঝেমধ্যে কাউকে সঙ্গে নিয়ে এখনো ছুটে আসেন মস্কোর প্রাচ্য সাহিত্য কেন্দ্রে। খুঁজে বেড়ান রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্ম।
আলাপের শেষদিকে বরিসকে জিজ্ঞেস করি, আপনি যে সময়ে বাংলা ভাষা শিখেছেন, সে সময়ের চেয়ে এখনকার বাংলা ভাষার যে পরিবর্তন, সেটা কি আপনি টের পাচ্ছেন? ‘টের পাচ্ছি।’ বলেই হাসলেন বরিস।
বরিসকে শেষ প্রশ্ন। বাংলা ভাষা শেখার জন্য সবচেয়ে দরকারি জিনিসটি কী? বরিসের জবাব, ‘ইচ্ছা। ইচ্ছা নেই তো কিছু হবে না।’
বরিস পালইয়ানস্কির একটি ভিডিও সাক্ষাৎকার দেখুন প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণে (www.prothom-alo.com)