কন্যাশিশুর অগ্রগতির জন্য চাই পর্যাপ্ত তথ্য

প্রত্যেক কন্যাশিশুই গুরুত্বপূর্ণ। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ১১ অক্টোবরকে আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে। এর লক্ষ্য কন্যাশিশুর অধিকার এবং তারা যেসব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে তা স্বীকার করা। কন্যাশিশুর কোনো বিষয়ে উন্নতি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে অগ্রগতির শামিল।

বিশ্বে বর্তমানে ১১০ কোটি (১ দশমিক ১ বিলিয়ন) কন্যাশিশু রয়েছে, যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ১৫ শতাংশ। কিন্তু কন্যাশিশুরা এখনো অহরহ বৈষম্যের শিকার হচ্ছে এবং তারা ছেলেদের মতো সব সুযোগ পায় না। এ কারণে ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা বেশি অপুষ্টির শিকার হয়। স্কুল থেকে ঝরে পড়ে। বাল্যবিবাহে বাধ্য হয়। শিকার হয় নির্যাতন ও পাচারের। এসবই শিশু অধিকার-সংক্রান্ত কনভেনশন এবং অধিকাংশ দেশের সংবিধানের লঙ্ঘন।

কন্যাশিশুরা যেসব বৈষম্যের শিকার হয়, তা প্রায়ই তথ্য আকারে দলিলবদ্ধ করা হয় না। অথচ তাদের সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে যথেষ্ট তথ্য হাতে থাকলে তা কন্যাশিশুর সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ ভালোভাবে বোঝার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যেত।

বৈশ্বিকভাবেই কন্যাশিশু-সম্পর্কিত ও লিঙ্গভিত্তিক তথ্যের ঘাটতি রয়েছে। এই তথ্য থাকলে তা গুরুত্বপূর্ণ নীতি গ্রহণে ও কর্মসূচি নির্ধারণে প্রয়োগ করা যেত। কিন্তু যথেষ্ট তথ্য না থাকায় এ ব্যাপারে সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে। তথ্য থাকলে কন্যাশিশুর অধিকার নিশ্চিত হতো। তাদের পর্যবেক্ষণ যেত।

.
.

বাংলাদেশে কন্যাশিশুদের পরিস্থিতি
বাংলাদেশে প্রায় ১ কোটি ৬০ লাখ (১৬ মিলিয়ন) কন্যাশিশু আছে, যা দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ। কন্যাশিশুর জীবনের প্রথম ১০ বছরের তথ্য মোটামুটি পাওয়া যায়। কিন্তু তাদের দ্বিতীয় দশক বা কৈশোরকালের তথ্য খুব কমই মেলে।
বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে (বিডিএইচএস) ১৫-১৯ বছর বয়সী বিবাহিত কিশোরীদের তথ্য নিয়ে কাজ করে। বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) কাছে আছে মাধ্যমিক স্কুলপর্যায়ের লিঙ্গভিত্তিক তথ্য। এর মধ্যে আছে স্কুলে ভর্তি, পড়ালেখা চালু রাখা ও ঝরে পড়ার তথ্য। বাংলাদেশ ম্যাটারনাল মর্টালিটি অ্যান্ড হেলথ কেয়ার সার্ভে (বিএমএমএস) ১৫-১৯ বছর বয়সী বিবাহিত কিশোরীদের তথ্য নিয়ে কাজ করে। লেবার ফোর্স সার্ভে (এলএফএস) কাজ করে ১৫-১৯ বছর বয়সীদের লিঙ্গভিত্তিক বিভিন্ন তথ্য নিয়ে।
এ কথা বলা জরুরি যে এসব জরিপে বিশেষ করে অবিবাহিত কিশোরীদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। শুধু তা-ই নয়, ১০-১৪ বছর বয়সী কিশোরীদের প্রসঙ্গও এখানে গুরুত্ব পায়নি। ফলে কোন কোন সামাজিক বিষয় কীভাবে তাদের জীবনকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে, তা বোঝা দুরূহ হয়ে পড়ে।
লক্ষণীয় হলো, জরিপের মাধ্যমে যেসব তথ্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে পাওয়া যায় তাতে দেখা যাচ্ছে, মেয়েদের অবস্থা ছেলেদের মতো ভালো নয়। যেমন: ব্যানবেইসের ২০১৪ সালের এক জরিপ বলছে, ৬৮ শতাংশ মেয়ে এবং ৫৭ শতাংশ ছেলে মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তি হয়। অর্থাৎ​ মাধ্যমিক স্কুলে ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের সংখ্যা বেশি। কিন্তু তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, মাধ্যমিক স্কুলপর্যায়ে মেয়েদের ঝরে পড়ার হার ছেলেদের চেয়ে বেশি। পড়া শেষ না করে ৪৭ শতাংশ মেয়ে স্কুল ছাড়ে। ছেলেদের ক্ষেত্রে এই হার ৩৫ শতাংশ।
২০১৩ সালের লেবার ফোর্স সার্ভেতে দেখা যায়, শ্রমশক্তিতে ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের অংশগ্রহণ কম। ১৫-১৯ বছর বয়সীদের মধ্যে ২৮ লাখ (২ দশমিক ৮ মিলিয়ন) ছেলে এবং ১৯ লাখ (১ দশমিক ৯ মিলিয়ন) মেয়ে কাজ করছে অথবা কাজ খুঁজছে। এই প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন জাগে, এই বয়স-শ্রেণির মেয়েরা কেন ছেলেদের চেয়ে শ্রমশক্তিতে কম অংশ নেয়। তা ছাড়া এই মেয়েরা ঠিক কী ধরনের কাজে যুক্ত, সে সম্পর্কিত তথ্যের অভাব আছে। এই তথ্য থাকলে শ্রমশক্তিতে মেয়েদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর পদক্ষেপে তা ব্যবহার করা যেত।

দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশেও বাল্যবিবাহের প্রচলন আছে। বাল্যবিবাহ সম্পর্কে যেসব তথ্য আছে তাতে দেখা যায়, ওই সব দেশের সঙ্গে তুলনামূলক বিচারে বাংলাদেশে ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের অবস্থা বেশ শোচনীয়।

বিডিএইচএসের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৫-১৯ বছর বয়সী বিবাহিত কিশোরীদের জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী ব্যবহারের হার হতাশাজনক।

কন্যাশিশুদের সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য এবং কিশোরীদের স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় বিনিয়োগ তাদের জন্য জুতসই নীতি, কর্মসূচি ও বাজেট প্রণয়নে সাহায্য করবে। আর এভাবেই কন্যাশিশুর অধিকার প্রতিষ্ঠায় সরকারের অঙ্গীকার রক্ষা করা সম্ভব।

কিছু পরামর্শ

কিশোরীদের সঙ্গে সম্পর্কিত তথ্য-উপাত্তের প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে কিছু পরামর্শ দেওয়া হলো:

* সেসব বিষয় চিহ্নিত করা যেগুলো বিশেষ করে কিশোরীদের সঙ্গে সম্পর্কিত।

* কন্যাশিশুদের গুরুত্ব দিয়ে লিঙ্গভিত্তিক তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ, বিস্তারে জাতীয় সক্ষমতা ও ব্যবস্থা গড়ে তোলা। এ ক্ষেত্রে কন্যাশিশুদের জীবনের দ্বিতীয় দশকের তথ্য গুরুত্ব পাবে।

* নীতি ও প্রকল্পে জাতীয় প্রতিনিধিত্বমূলক তথ্য ব্যবহার। কিশোরীদের প্রয়োজন মেটাতে সম্পদ বরাদ্দের জন্য প্রচেষ্টা।

* কিশোরীদের স্বাস্থ্য ও অধিকার সুরক্ষা। এ ক্ষেত্রে সমন্বিত যৌনশিক্ষা; যৌন-প্রজনন স্বাস্থ্য, তথ্য ও সেবায় প্রবেশাধিকার; জীবন প্রভাবিত করার সিদ্ধান্তে অংশগ্রহণের সুযোগ এবং নাগরিক জীবনে অংশ নেওয়ার সক্ষমতা বাড়ানো যেতে পারে।

* কন্যাশিশুর উন্নয়নে বিনিয়োগের উপকারিতা তুলে ধরা। এই বিনিয়োগে কন্যাশিশুর পাশাপাশি তাদের পরিবার, সম্প্রদায় ও ব্যাপক অর্থে সমাজ উপকৃত হয়।

যৌথভাবে এ প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেে জাতিংসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) ও জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) ।