নরেন্দ্র মোদি ও ইমরান খান

ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার পর মস্কোর বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, আকাশপথ বন্ধ করে দেওয়াসহ নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে বিভিন্ন পশ্চিমা দেশ। রাশিয়াকে নানাভাবে কোণঠাসা করতে তারা যখন ব্যস্ত, তখন দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভারত ও পাকিস্তানের আচরণ কিছুটা ভিন্ন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

বিশ্লেষকদের ভাষ্য, ইউক্রেন নিয়ে চলমান উত্তেজনা কমানোর প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছে ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশই। তবে সহিংসতার দায় রাশিয়ার ওপর চাপানোর বিষয়টি সাবধানতার সঙ্গে এড়িয়ে গেছে তারা।

রোববার পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কোরেশির সঙ্গে ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্র কুলেবার টেলিফোনে কথা হয়। আলাপে যুদ্ধ বন্ধে পাকিস্তানের আহ্বানের বিষয়টি নতুন করে তুলে ধরেছেন কোরেশি। এ ছাড়া এ ইস্যুতে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে একাধিক বিবৃতি এসেছে।

রাশিয়া–ইউক্রেন সংকট নিয়ে পাকিস্তানের দেওয়া নানা বিবৃতির যে ভাষা, তার মিল রয়েছে সম্প্রতি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ভোটাভুটিতে ভারতের অবস্থান এবং রাশিয়া ও ইউক্রেনের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আলাপচারিতার সঙ্গে।

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে গত রোববার কথা বলেন নরেন্দ্র মোদি। সেখানে তিনি ইউক্রেনে ‘সহিংসতা’ বন্ধের প্রয়োনীয়তা তুলে ধরেন। তবে এর দায় রাশিয়ার ওপর চাপানোর বিষয়টি এড়িয়ে যান। দুদেশের শীর্ষস্থানীয় নেতার আলাপের পর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি বিবৃতি প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়, ‘অবিলম্বে সহিংসতা বন্ধে ও সংলাপে ফিরতে তিনি (মোদি) আবারও আহ্বান জানিয়েছেন এবং শান্তি ফিরিয়ে আনতে যেকোনো প্রচেষ্টায় অবদান রাখতে ভারতের সদিচ্ছা প্রকাশ করেছেন।’

এর দুদিন আগেই ইউক্রেনে পুরোদমে হামলা শুরু করে রাশিয়া। সে সময় রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গেও একই সুরে কথা বলেছিলেন মোদি। ইউক্রেন থেকে রাশিয়ার সেনা প্রত্যাহারে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের আনা খসড়া প্রস্তাবে ভোট দেওয়া থেকেও বিরত ছিল ভারত।

এদিকে চলমান সংকটের মধ্যে রাশিয়া সফরে যান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। সেখানে গ্যাস পাইপলাইনের একটি প্রকল্প নিয়ে পুতিনের সঙ্গে আলোচনা হয় তাঁর। পাশাপাশি আফগানিস্তানসহ আঞ্চলিক নানা বিষয়ে কথা বলেন তিনি।
পুতিন-ইমরান বৈঠকের পর একটি বিবৃতি প্রকাশ করে মস্কো। বিবৃতিতে ইউক্রেন সংকটের বিষয়টি পুরোপুরি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। পাকিস্তানও রুশ হামলার বিষয়টি সামনে আনতে বেশ সতর্কভাবে এগিয়েছে। ইউক্রেনের বর্তমান পরিস্থিতিকে শুধু ‘দুঃখজনক’ বলে আখ্যায়িত করেছে দেশটি।

এ বিষয়ে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বলা হয়, ‘সংঘর্ষে কারও স্বার্থ নেই বলে জোর দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। আর সংঘর্ষ বাধলে উন্নয়নশীল দেশগুলোর ওপরে সব সময় বড় অর্থনৈতিক ধাক্কা আসে। সংলাপ ও কূটনীতির মাধ্যমে বিবাদের সমাধানে পাকিস্তান বিশ্বাসী।’

প্রশ্ন হচ্ছে, ভারত ও পাকিস্তান—দুই দেশই কেন ইউক্রেন ইস্যুতে খোলাখুলিভাবে বাকচাতুরী করছে?

রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক দীর্ঘদিনের

যুগের পর যুগ ধরে ভারত ও রাশিয়ার সম্পর্ক গভীর। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এ সম্পর্কের মূলে রয়েছে রাশিয়া থেকে ভারতের অস্ত্র কেনার বিষয়টি। এ ছাড়া একাধিক খাতে দুই দেশের সংযোগ রয়েছে।
সুইডেনের স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এসআইপিআরআই) দেওয়া তথ্য বলছে, ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত রাশিয়ার রপ্তানি করা মোট অস্ত্রের ২৩ শতাংশই গেছে ভারতে। একই সময়ে ভারতের আমদানি করা অস্ত্রের ৪৯ শতাংশ এসেছে রাশিয়া থেকে।

আরও পড়ুন

একলা হয়ে পড়ছেন পুতিন

গত ডিসেম্বরে ভারত সফরে আসেন পুতিন। এরপর রাশিয়ার অত্যাধুনিক এস-৪০০ আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থার চালান ভারত হাতে পেতে শুরু করে বলে জানায় নয়াদিল্লি। এর আগেই এস-৪০০ কিনতে মস্কোর সঙ্গে চুক্তি করেছিল দিল্লি।

এদিকে রাশিয়ার সঙ্গে উষ্ণ সম্পর্কের মধ্যেই কয়েক বছর ধরে আরেক পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি এসেছে ভারত। চীনকে ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে কৌশলগত জোট ‘কোয়াড’–এ যোগ দিয়েছে দেশটি।

রাশিয়া–ইউক্রেন সংকটে ভারতের অবস্থান নিয়ে নয়াদিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের রুশ পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক শিক্ষক সঞ্জয় কুমার পান্ডে বলেন, ‘আমি বিষয়টি দেখছি ভারতের সঙ্গে রাশিয়ার দীর্ঘদিনের সম্পর্কের দিক দিয়ে। এ ছাড়া অস্ত্র সরবরাহে আমাদের নির্ভরশীলতাও একটি বিষয়। আর আমাদের বিশ্বাস, রাশিয়ার কিছু উদ্বেগ রয়েছে; যেগুলো আমলে নেওয়ার মতো।’

তবে ইউক্রেনের দুই অঞ্চলকে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেওয়া ও দেশটিতে হামলা শুরুর মতো রাশিয়ার পদক্ষেপকে ভারত সমর্থন করে না বলে উল্লেখ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক।

রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র—দুই দেশের সঙ্গেই ভারতের গভীর সম্পর্ক রয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন মস্কোতে নিযুক্ত ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত পিএস রাঘবন। তাঁর ভাষ্য, যখন লোকজন বলে ইউক্রেন সংকটে ভারত ‘পরিষ্কার অবস্থান’ নেয়নি, তাঁরা মূলত রাশিয়াকে নিন্দা না জানানোর বিষয়টির দিকে ইঙ্গিত করেন। তবে এটি রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র দুই পক্ষকে তুষ্ট করার মতো বিষয় নয়।

আরও পড়ুন

ইউক্রেন যুদ্ধে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমের ‘দ্বৈত নীতি’: সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনার ঝড়

পাকিস্তানের স্বার্থগুলো নতুন করে সাজানো
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে হামলা চালায় রাশিয়া। একই দিন মস্কো সফরে যান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। পুতিনের সঙ্গে তিন ঘণ্টা বৈঠক করেন। পাশাপাশি বসে ছবিও তোলেন তাঁরা। এ নিয়ে পাকিস্তানের অভ্যন্তরেই সমালোচনা চলছে।

কয়েক দশক আগেও স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালে রাশিয়ার সঙ্গে বৈরী সস্পর্ক ছিল পাকিস্তানের। সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ ছিল পাকিস্তান। আফগানিস্তানে সাবেক সোভিয়েত সেনাবাহিনীকে মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম সহযোগী ছিল দেশটি। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মস্কো–ইসলামাবাদ সম্পর্ক জোড়া লাগতে শুরু করেছে।

দুই যুগের বেশি সময় পর চলতি মাসে পাকিস্তানের কোনো প্রধানমন্ত্রী রাশিয়া সফর করলেন। এর আগে অবশ্য দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি ২০১১ সালে মস্কোতে তত্কালীন রুশ প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন।

আরও পড়ুন

পুতিন কি পারমাণবিক অস্ত্র বেছে নেবেন

গত ২৪ ফেব্রুয়ারি পুতিন–ইমরান বৈঠকের কেন্দ্রে থাকার কথা ছিল ‘পাকিস্তান স্ট্রিম’ গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্পের বিষয়টি। এ প্রকল্পের আওতায় দেশটির করাচি শহর থেকে পাঞ্জাব প্রদেশ পর্যন্ত ১ হাজার ১০০ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণের প্রস্তাব রয়েছে। বিশ্লেষকেরা বলেন, প্রকল্পটি চালু হলে পাকিস্তানে রাশিয়ার গ্যাস রপ্তানি না বাড়লেও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো পাকিস্তানে গ্যাস সরবরাহ শুরু করতে পারবে। এতে করে গ্যাসের চাহিদা মেটাতে রাশিয়ার ওপর আরও নির্ভরশীল হয়ে উঠবে ইউরোপ।

ইউক্রেনে রুশ হামলায় পাকিস্তানের করার তেমন কিছু নেই বলে মন্তব্য করেন ইসলামাবাদভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান জিন্নাহ ইনস্টিটিউটের পরিচালক সালমান জাইদি। তিনি বলেন, ‘অর্থপূর্ণ কোনো দিক দিয়ে ইউক্রেন সংকটের সঙ্গে পাকিস্তানের যেমন সংশ্লিষ্টতা নেই, তেমন দক্ষিণ এশিয়ারও নেই। এ অঞ্চলের নেতাদের বিবৃতিতে এমনটিই দেখা যায়।’