গান যেখানে শত শত মৃত্যুর কারণ

লেসোথোর জনপ্রিয় সংগীত ফামো পরিবেশন করছে একটি গানের দল
ভিডিও থেকে নেওয়া ছবি

গান হয়তো কারও মনের খোরাক, কারও বিনোদন। কারও হয়তো একসময় জীবিকার অবলম্বন হয়ে ওঠে সংগীতের পথচলা। এই পথচলায় থাকতে পারে প্রতিযোগিতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা। কিন্তু সেটা কখনো গোষ্ঠীগত যুদ্ধে রূপ নিতে পারে, তা সাধারণত কারও মনে আসবে না। কিন্তু আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলের রাজতন্ত্রের দেশ লেসোথোয় এমনটিই ঘটছে। হারমোনিয়ামনির্ভর ব্যতিক্রমী একধরনের সংগীত ঘিরে তারকা শিল্পীদের বিরোধ দেশটিকে আফ্রিকা মহাদেশের খুনের রাজধানীতে পরিণত করেছে। বিবিসির এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে সংগীত ঘিরে রক্তারক্তির এই আখ্যান।

‘হয়তো আমি নারী বলে বেঁচে গেছি’, শান্ত গলায় বললেন পুসেলেৎসো সিমা।

একসময়ের বলিষ্ঠ কণ্ঠের ছায়া তাঁর এই মৃদুস্বরে। তাঁর কণ্ঠ শুনতে আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চল ও অন্যান্য এলাকার হাজার হাজার ভক্ত বিয়ার হল ও স্টেডিয়ামে ছুটতেন।

লেসোথোর জনপ্রিয় সংগীত ফামোর রানি হিসেবে প্রশংসিত তিনি। নিজের ছোট্ট সিমেন্ট ব্লকে তৈরি ঘরের বারান্দায় বসে আছেন তিনি। সংগীতে বছরের পর বছর সাফল্য পাওয়া এই শিল্পীর ঘরে তাঁর কোনো ছোঁয়া নেই। তিনি বলেন, ‘এখানে সবাই একটি বন্দুকের মালিক হয়ে নিজের শৌর্য দেখাতে চায়।’

একসময়ের ভদ্রোচিত কবিতায় এতিম গ্রামের পর গ্রাম

সংগীত হিসেবে ফামোর শুরুটা একেবারেই ভদ্রোচিত। এর শুরুটা হয় পথিকদের ঐতিহ্যবাহী স্তবগানের মধ্য দিয়ে। শুরুতে কনসার্টিনা (একধরনের বাদ্যযন্ত্র) এবং পরে হারমোনিয়ামে (অ্যাকরডিয়ন) সুর তুলে এই গান গাওয়া হয়। স্তবগানগুলো ছিল অনেকটা স্বতঃস্ফূর্ত লোককবিতা বা র‍্যাপের মতো। দীর্ঘ সময় পশু চরানোর সময় রাখালেরা কিংবা লেসোথোর পাহাড়ে চরার সময় পর্যটকেরা এ ধরনের গান বাঁধতেন।

২০০৪ সালে একজন ফামো সংগীতশিল্পীর বিরুদ্ধে আরেকজনকে গুলি করার অভিযোগ ওঠে। এরপর থেকেই শুরু হয় প্রতিশোধ ও পাল্টা প্রতিশোধ নেওয়ার চক্র।

সঙ্গে শুরু হয় গানে গানে প্রতিপক্ষকে অপমান, হেয় করার রীতি। গত দুই দশকে বহু ফামো সংগীতশিল্পীকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। একই পরিণতি হয়েছে এই সংগীতের সঙ্গে সম্পৃক্ত শত শত প্রযোজক, ভক্ত ও ডিজে এবং সংগীতশিল্পীদের পরিবারের সদস্যদের।

এই সংগীতের পৃষ্ঠপোষকদের একজন সেবোনোমোইয়া রামাইনোয়ানে। নৃশংসতার ধরন বোঝাতে তিনি বলেন, ‘তারা বাড়িতে তোমার খোঁজে এল। দেখল বাড়িতে তুমি নেই। তারা তোমার স্ত্রীকে হত্যা করবে, তোমার সন্তানদের হত্যা করবে। তারা পরিবারের সব সদস্যকে মেরে ফেলবে। এই ফামো সংগীতের কারণে গ্রামের পর গ্রামে এখন এতিমদের বসবাস।’

প্রাণের ভয়ে অনেকেই বাড়িঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। লেসোথোর অধিকাংশই গ্রামীণ জনপদ। মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্যের দেশটিতে জনসংখ্যা ২০ লাখের মতো। স্থলবেষ্টিত দেশটির চারদিকেই দক্ষিণ আফ্রিকার সীমান্ত। জনসংখ্যা অনুপাতে হত্যাকাণ্ডের সংখ্যায় গত বছর বিশ্বে ষষ্ঠ অবস্থানে ছিল দেশটি। এর প্রধান কারণ সম্ভবত এই ফামো যুদ্ধ।

‘ঈর্ষা, ঈর্ষা ছাড়া আর কিছুই নয়’, এই হত্যাযজ্ঞের শুরুর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন সিমা। তিনি বলেন, ‘যখন শিল্পীরা নিজেদের প্রচারে নামে, তখন তারা অন্যদের জন্য অপমানজনক কলিতে ভরা গান গাইতে শুরু করল।’

অধিকাংশ ফামো তারকার মতো সিমার বেড়ে ওঠা ছিল কষ্টের, দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে তাঁকে। তিনি বলেন, ‘আমি খুব ছোটবেলা থেকেই গান গাইতে শুরু করি। আমি পশু চরাতাম। এটা অল্প বয়সী মেয়েদের কাজ নয়। কিন্তু আমি পশু চরানোর মাঠে ছেলেদের সঙ্গে মারামারি করতাম।’

নিজের ভাগ্যের খোঁজে বাড়ি ছাড়েন সিমা। দক্ষিণ আফ্রিকার স্বর্ণ ও হীরার খনিতে কাজ করতে লেসোথো ছেড়ে আসা হাজারো মানুষকে বিনোদন দিতে গান গাইতেন তিনি।

ফামোর উৎপত্তিটা বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি। মনে করা হয়, লেসোথোর ভাষা সেসোথোর ‘ওয়াফামোলা’ শব্দ থেকেই নামটা এসেছে। সংগীতের তালে নারীদের নাচের উচ্ছ্বসিত মুহূর্তে স্কার্ট ফোলানো বা দোলানো বোঝাতে শব্দটা ব্যবহার করা হয়।

সিমা নাচতে পারদর্শী। একটি ঘাসের স্কার্টে কোমর দোলাতে দোলাতে ঐতিহ্যবাহী লড়াইয়ের ছড়ি হাতে কসরত দেখাতেন। কঠোর মানসিকতার খনিশ্রমিকেরাও ছিলেন তাঁর দর্শক। তিনি বলেন, ‘তাঁরা খুবই পুলকিত হতেন। কিন্তু তাঁরা আমাকে ভয় পেতেন। তাঁরা ভাবতেন আমি তাঁদের মারব। যখন আমি মঞ্চ ছেড়ে যেতাম, আশপাশে না তাকিয়ে চেহারা গম্ভীর করে রাখতাম। কেউ আমার পাশে ঘেঁষতেন না।’

স্বদেশি তরুণ ও একসময়কার পশুপালক বেরেং মাজোরোকে সংগীতে আসতে উৎসাহিত করেছিলেন সিমা। মঞ্চে তিনি লেকাসে নামে পরিচিত, যার অর্থ ‘কফিন’। তিনি এখন অবসর যাপন করছেন। লেসোথোর রাজধানী মাসেরুর উপকণ্ঠে নিজের ছোট বাড়িতে বসে কথা বলছিলেন লেকাসে। তিনি বলেন, ‘গান গাওয়া মানে হলো প্রতিযোগিতা। প্রত্যেকেই জয়ী হতে চায়।’

দক্ষিণ আফ্রিকা ও লেসোথো—দুই দেশেই ফামো সংগীতশিল্পী ও তাঁদের ভক্তরা কয়েকটি গোষ্ঠীতে বিভক্ত। বিশেষ রঙের ঐতিহ্যবাহী কম্বল পরে নিজেদের একে অপর থেকে আলাদা রাখেন। তেরেনে গোষ্ঠীর রং হলুদ। এটা অন্যতম বড় গোষ্ঠী। সিখি গোষ্ঠীর কম্বলের রং আকাশি ও কালো। লেকাসে এই গোষ্ঠীর শিল্পী।

যখন সহশিল্পীদের কেউ হুমকি পেতেন, তখন লেকাসে আত্মগোপনে চলে যেতেন। যদিও তিনি তখন দক্ষিণ আফ্রিকায় বসবাস করছিলেন। তিনি সব সময় সঙ্গে একটি বন্দুক রাখতেন। কাউকে হত্যা করেছেন কি না, সে প্রশ্নের জবাব দেননি তিনি। হেসে প্রশ্নটি এড়িয়ে যান। কিন্তু লেকাসে বলেন, ‘আমি পাল্টা লড়াই করেছিলাম। কারণ, যখন আমি কাউকে দাফন করতে দেখি এবং জানলাম অন্য দলের হাতে সে খুন হয়েছে, তখন আমি ক্ষুব্ধ হতাম। এ জন্য আমাকে প্রতিশোধ নিতে হবে।’

গানের কলি যখন খুনের কারণ

লেসোথোয় ফিরে প্রতিশোধমূলক হামলার শিকার হন ফামো শিল্পী সালোপে মোহলোবুতি। ২০১০ সালে পাহাড়ি মাতেলিলে জেলায় নিজের নির্জন বাড়িতে তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়। নিজের শেষ গানে তিনি আরেক সংগীতশিল্পীর খুনিদের কটূক্তি করে বলেছিলেন, ‘ছোট বাচ্চা।’ ওই শিল্পী ছিলেন তাঁর কাজিন। গানের এই কলিতে ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁকেও হত্যা করা হয়।

সোলাপের ছেলে মালেফেৎসানের বয়স এখন ১৭ বছর। বাবার স্মৃতি হিসেবে গানটা নিজের মুঠোফোনে রেখেছেন। তবে ওই তরুণের ভাষ্য, সংগীতশিল্পী হওয়ার চেয়ে বরং তিনি পশুপালকই থাকতে চান। মালেফেৎসানে বলেন, ‘আমি এই গান তেমন একটা শুনি না। কারণ, এর শব্দগুলো খুবই উসকানিমূলক। পুরোটাই খুনোখুনি নিয়ে। আমি এসবে জড়াতে চাই না। এই গান আমার বাবাকে হত্যা করেছে।’

তবে সিমার মতো কিছু শিল্পী এই সহিংসতা থেকে নিজেদের দূরে রেখেছেন। গানে কখনো কাউকে অপমান করেননি বলে জানান তিনি। সিমা বলেন, ‘আমার জীবনের সবকিছু নিয়ে আমি গেয়েছি। আমার দাম্পত্য জীবন নিয়ে এবং যখন আমার সংসার ভেঙে যায়, সেটা নিয়েও। আমি আমার দাম্পত্য জীবনের ব্যর্থতা নিয়েও গান বেঁধেছি।’

মো–আফ্রিকা এফএমের উপস্থাপক সেপাং মাকাকোলে বলেন, ফামোর সঙ্গে জড়িত যে কেউ কিন্তু ঝুঁকিতে আছেন। এমনকি ডিজেও হত্যার শিকার হয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আপনি যখন রেডিওতে আছেন, আপনাকে সব গোষ্ঠীর গান পরিবেশনের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। আপনি যদি কোনো একটি গোষ্ঠীর গান বাদ দেন, তারা বলবে, তুমি আমাদের পছন্দ করো না। তখন তারা আপনাকে গুলি করবে।’

যদিও এখন খুনোখুনি আর শুধু সংগীতেই সীমাবদ্ধ নয়। দক্ষিণ আফ্রিকার লোভনীয় অবৈধ স্বর্ণের খনির নিয়ন্ত্রণ নিয়েও ফামো গোষ্ঠীগুলো লড়াই করছে। এসব খনিতে তাঁদের ভক্তরা কাজ করেন। শেষ বড়দিনে খনিশ্রমিক সেলো তাওতে তিন বছর পর লেসোথোয় আসেন স্ত্রী ও অল্প বয়সী দুই ছেলেকে দেখতে। কয়েক দিন পর নববর্ষ উৎসবে আরও তিন অতিথিসহ তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

তাওতের বন্ধুদের ধারণা, দলত্যাগের জন্য তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। কারণ, একটি ফামো গোষ্ঠী নিয়ন্ত্রিত খনি থেকে নিজের উপার্জন সঙ্গে নিয়ে আরেকটিতে গিয়েছিলেন তিনি। একই সপ্তাহে আরও তিন ব্যক্তি খুন হন। ধারণা করা হয়, এগুলোও ফামো–সংশ্লিষ্ট হত্যাকাণ্ড।

পুলিশের কাছ থেকে যায় অস্ত্র

একের পর এক হামলায় ক্ষুব্ধ ও আতঙ্কিত হয়ে পরবর্তী সময়ে প্রতিবাদ সমাবেশ করেন গ্রামবাসী। এসব খুনের কারণে বহু মানুষ তাঁদের ঘরবাড়ি ছেড়েছেন। স্থানীয় এক পাড়াপ্রধান জানান, সহিংসতার প্রতিবাদ করায় তাঁকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে। তাঁদের সুরক্ষা দিতে পুলিশ ব্যর্থ হয়েছে বলে অভিযোগ করেন অনেকে। পুলিশের বিরুদ্ধে এসব দুর্বৃত্তের সঙ্গে যোগসাজশেরও অভিযোগ রয়েছে।

মাফেতেং জেলার কেন্দ্রে অবস্থিত একটি থানা থেকে গত নভেম্বরে ৭৫টি বন্দুক খোয়া যায়। উপস্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মাইমানে মাফাথে বিবিসিকে বলেন, কর্মকর্তারা এসব অস্ত্র ফামো গোষ্ঠীগুলোর কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। পুলিশ মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা তাঙ্কি মোথাই বলেন, দায়িত্ব পালনরত কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এই অভিযোগের তদন্ত চলছে। তিনি বলেন, ‘অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে পুলিশের সম্পৃক্ততার বিষয়ে শূন্য সহনশীলতা নীতি নিয়েছে সরকার।’

এদিকে রাজনীতিবিদদের সঙ্গেও বিভিন্ন ফামো সংগীতগোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠতা দীর্ঘদিনের। সবচেয়ে বড় ও ভয়ংকর ফামো গোষ্ঠীগুলোর একটি তেরেনে। এই গোষ্ঠীর নেতা তেই সেহলানা চলতি মাসে মৃত্যুর আগপর্যন্ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গাড়ির চালক ছিলেন।
সেহলানাকে উত্তরসূরি মনোনীত করেন তেরেনের প্রতিষ্ঠাতা অন্যতম সেরা ফামো তারকা মোসোথো চাকেলা । যদিও সেহলানা নিজে কোনো সংগীতশিল্পী নন। এই গোষ্ঠীটি যে একটি অপরাধী চক্র চলতি বছরের শুরুতে তা অস্বীকার করেন তিনি। তাঁর দাবি ছিল, এটি একটি লাশ দাফন সংস্থা। শেষকৃত্য আয়োজনে তহবিল সংগ্রহের কাজ করেন এর সদস্যরা।

কখনো কাউকে হত্যার নির্দেশ দেওয়ার কথাও অস্বীকার করেন সেহলানা। তিনি বলেন, ‘একটি দলের নেতা হিসেবে আমরা এসব হত্যাকাণ্ড বন্ধের চেষ্টা করি। কেবল কিছু সময় আমি সেটা মানিয়ে রাখতে পারি না। কারণ, আমাদের সদস্যরা বলেন, আমরা যখন আক্রান্ত হই, তখন কেবল তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে পারি না।’

লেসোথোর উপস্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মাফাথে বলেন, পরিস্থিতির উন্নতির আশায় সেহলানাকে চাকরি দিয়েছে মন্ত্রণালয়। কারণ, হয়তো এসব লোকের কয়েকজনকে চাকরি দেওয়া হলে বাকিরাও চাকরি করার গুরুত্বটা বুঝতে পারবে। আর এসব হত্যাকাণ্ড বন্ধে সরকারকে সাহায্য করতে তারা জোর প্রচেষ্টা চালাবে সে আশা ছিল। কিন্তু সেহলানা এই সহিংসতার বলি হলেন।

একটি রাজনৈতিক দল আয়োজিত কনসার্টে গত ২ এপ্রিল তাঁকে অজ্ঞাত বন্দুকধারী গুলি করে। ধারণা করা হচ্ছে, হামলাকারী তেরেনের প্রতিপক্ষ গোষ্ঠীর সদস্য হতে পারেন। পরে হাসপাতালে মারা যান সেহেলানা।

সেহেলানার অনুসারীরা হামলাকারী সন্দেহে কয়েকজনকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করে। তবে কোনো ধরনের অভিযোগ আনা ছাড়াই পুলিশ সন্দেহভাজনদের ছেড়ে দেয়। অবশ্য পুলিশ বলছে, তারা এখনো বিষয়টি তদন্ত করে দেখছে।

একসময়ের তারকার নুন আনতে পান্তা ফুরায়

একসময় প্রতিটি হত্যার বদলা নিতে চাইতেন ফামো তারকা লেকাসে। এসব সহিংসতায় বিরক্ত হয়ে সম্প্রতি গান গাওয়াই ছেড়ে দিয়েছেন তিনি। লেকাসে বলেন, ‘যেসব মানুষ আমাকে গায়ক হতে তাড়া দিয়েছে, তাদের বিষয়ে আমি খুবই মর্মাহত, খুবই ক্ষুব্ধ। আমি আগে মারামারিতে জড়াইনি, কেউ আমার সঙ্গে মারামারি করেনি। কিন্তু আমি এখন গায়ক হওয়ার কারণে আমার অনেক শত্রু তৈরি হয়েছে।’

লেকাসে এখন নিজের ছোট্ট বাড়িতে বিনয়ী জীবন যাপন করছেন। তাঁর সম্বল একটি ছোট্ট ভুট্টাখেত আর কিছু মুরগি। সঙ্গী বড়সড়ো একটি কাছিম।

এখন সরাসরি ফামো কনসার্ট তেমন আয়োজন করা হয় না। এ ধরনের আয়োজনকে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ মনে করা হয়। ফামো রানি ৭৩ বছর বয়সী সিমা বলেন, ‘অন্তর্ঘাতে তারা আমাদের ব্যবসা ধ্বংস করে দিয়েছে।’

সংগীতে সফলতার পরও সিমার জীবনটা দুঃখের। তার তিন সন্তানের কেউই বেঁচে নেই। একজন জন্মের সময় মারা যায়। একজন মারা যায় অসুস্থতায়। অপরজন সঙ্গীর হাতে খুন হয়। নিজের খ্যাতির জন্য তিনি ডাকাতের কবলেও পড়েন। প্রিয় হারমোনিয়াম এবং নিজের গানের সিডির বেশির ভাগসহ তাঁর অনেক সম্পদ তারা চুরি করে নিয়ে গেছে।

যে নাচ সিমাকে এত খ্যাতি এনে দিয়েছে, সেই নাচ তিন নাতি–নাতনিকে নেচে দেখাতে বলেন তিনি। এতে যেন তার হারানো অতীত কিছুটা হলেও নতুন করে ধরা দেয়। বাতজনিত অসুস্থতার কারণে তিনি আর এখন ওভাবে নাচতে পারেন না। পুসেলেৎসো সিমা বলেন, ‘এটা হলো কোমর দোলানো এবং কাঁধ ঘোরানো। আমিই এই নাচের প্রচলন করি। ঠিক আমার মতো করে কেউ নাচটা পারে না।’

নাতি–নাতনি ও স্থানীয় কয়েকটি এতিম শিশুকে লালনপালনে হিমশিম খেতে হচ্ছে সিমাকে। তিনি বলেন, ‘যদি আমার বাদ্যযন্ত্রটা এখনো থাকত, তাহলে আমাদের গ্যাসের সংকট হতো না, খাবার ফুরিয়ে যেত না। তাদের জীবনে যা প্রয়োজন, সবই তারা পেত।’
নিজের একসময়ের শিষ্য ও সহতারকা লেকাসের মতো সিমাও সংগীতজীবনে জড়িয়ে পড়ার জন্য অনুশোচনা করছেন। তিনি বলেন, ‘আমার খুব কষ্ট লাগে। আমাদের কেউ কেউ সংগীতের ওপর ভরসা করে জীবিকা নির্বাহ করত। কিন্তু এখন আমাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়। আমি একজন তারকা সংগীতশিল্পী, অথচ আমার সম্পদ বলতে তেমন কিছু নেই। ফামো সংগীত আমার মন ভেঙে দিয়েছে।’