জি–৭ শীর্ষ বৈঠক
ভবিষ্যৎ মহামারি ঠেকাতে ধনী দেশগুলোর পরিকল্পনা
জাতিসংঘ বলছে, দ্রুত আরও টিকা দরকার। চলমান মহামারি মোকাবিলায় জি–৭ নেতাদের পরিকল্পনা নিয়ে প্রশ্ন।
করোনাভাইরাস মহামারির মতো জীবন ও জীবিকাবিধ্বংসী আর কোনো বৈশ্বিক মহামারি যাতে ভবিষ্যতে না হয়, তা ঠেকানোর লক্ষ্যে একটি পরিকল্পনা গ্রহণের ঘোষণা চূড়ান্ত করেছেন শিল্পোন্নত সাতটি দেশের জোট জি–৭–এর নেতারা। তবে জাতিসংঘ মহাসচিব টিকা উৎপাদন দ্বিগুণ করে তার ন্যায্যতাভিত্তিক বিতরণ নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছেন।
ইংল্যান্ডের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রান্ত কর্নওয়ালের কারবিস খাঁড়িতে জোটের শীর্ষ সম্মেলনের এই ঘোষণাকে কারবিস বে ডিক্লারেশন অন হেলথ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এই পরিকল্পনায় রয়েছে রোগনির্ণয়, চিকিৎসা এবং টিকা উদ্ভাবন ও অনুমোদনের সময়সীমা ১০০ দিনের মধ্যে নামিয়ে আনা, সম্ভাব্য সংক্রামক রোগের আবির্ভাবের ওপর নজরদারির জন্য বৈশ্বিক নেটওয়ার্ককে শক্তিশালী করা, জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের সক্ষমতা বাড়ানো, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংস্কার এবং তাকে শক্তিশালী করা। ঘোষণাপত্রে সংক্রামক রোগের ওপর নজরদারির এই ব্যবস্থাকে ‘প্যানডেমিক রাডার’ বলে অভিহিত করা হয়। প্রাণিবাহিত রোগের সংক্রমণ মানবদেহে ছড়িয়ে পড়ার আগেই যাতে তা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়, সে জন্য যুক্তরাজ্যের পিরব্রাইট ইনস্টিটিউটে একটি পশুর টিকা উদ্ভাবন ও উৎপাদনকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করার কথাও এই ঘোষণায় রয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানে অর্থায়ন করবে যুক্তরাজ্য সরকার এবং মেলিন্ডা ফ্রেঞ্চ গেটস ফাউন্ডেশন।
করোনার টিকা নিয়ে যে বৈশ্বিক সংকট তৈরি হয়েছে, তা মোকাবিলায় সম্মেলন থেকে আগামী বছরের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ১০০ কোটি ডোজ টিকা সরবরাহের ঘোষণা দেওয়া হয়। এই ১০০ কোটি ডোজের মধ্যে শীর্ষ বৈঠকের আগেই যুক্তরাষ্ট্র ৫০ কোটি এবং যুক্তরাজ্য ১০ কোটি ডোজ দেওয়ার কথা ঘোষণা দিয়েছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এর আগে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, বিশ্বজুড়ে টিকা দেওয়ার কাজ সম্পন্ন করতে ২০২৪ সাল পর্যন্ত লেগে যেতে পারে। তবে জি–৭–এর এই সম্মেলনে আগামী বছর, অর্থাৎ ২০২২ সালের মধ্যেই বিশ্বকে টিকায়িত করার কথা বলা হয়েছে।
আমেরিকার জন হপকিনস ইউনিভার্সিটির হিসাবে বিশ্বে এ পর্যন্ত করোনা সংক্রমিত হয়েছে সাড়ে ১৭ কোটির বেশি মানুষ। তাঁদের মধ্যে মারা গেছেন ৩৭ লাখের বেশি। বিশেষজ্ঞ মত হচ্ছে, জনগোষ্ঠীর ৭০ শতাংশকে টিকা দিতে পারলে এই ভাইরাসের ক্ষতি করার ক্ষমতা খর্ব হবে বা জনগোষ্ঠীর কথিত হার্ড ইমিউনিটি অর্জিত হবে।
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস জি–৭–এর পরিকল্পনাকে স্বাগত জানালেও সংকট মোকাবিলায় আরও টিকার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। সতর্ক করে তিনি বলেন, যদি উন্নয়নশীল দেশগুলোর জনগণকে দ্রুত টিকা দেওয়া না যায়, তবে করোনাভাইরাসের আরও রূপান্তর ঘটতে পারে এবং এ ভাইরাস নতুন টিকা প্রতিরোধী হয়ে উঠতে পারে। তিনি যুদ্ধকালীন অর্থনীতির কথা বিবেচনায় নিয়ে বিশেষ আর্থিক সহায়তার ওপরও জোর দিয়েছেন।
* উৎপাদিত টিকার এক-তৃতীয়াংশের বেশি কিনে নিয়েছে জি–৭–এর দেশগুলো। * আগামী বছরের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ১০০ কোটি ডোজ টিকা সরবরাহের ঘোষণা। * আগামী বছরের মধ্যে বিশ্বকে টিকার আওতায় আনার চিন্তা।
বিশেষজ্ঞদের মধ্যে টিকার চাহিদা ও বর্তমান উৎপাদনক্ষমতা এবং বিতরণব্যবস্থার সামর্থ্য বিচারে মোটামুটি যে মতৈক্য রয়েছে, তাতে বলা হয়, বিশ্বকে ঝুঁকিমুক্ত করার জন্য ১ হাজার কোটি থেকে ১ হাজার ১০০ কোটি ডোজ টিকা প্রয়োজন।
এ পর্যন্ত উৎপাদিত হয়েছে আড়াই শ কোটির মতো টিকা, যার এক-তৃতীয়াংশের বেশি কিনে নিয়েছে জি–৭–এর দেশগুলো, যাদের সম্মিলিত জনসংখ্যা মোট বৈশ্বিক জনসংখ্যার মাত্র ১৩ শতাংশ। বিপরীতে আফ্রিকার সাব-সাহারা অঞ্চলের দেশগুলো টিকা পেয়েছে মাত্র ২ শতাংশের কম। ইউনিসেফ জি–৭ নেতাদের প্রতি তাঁদের সংগ্রহে থাকা বাড়তি টিকা জরুরি ভিত্তিতে এসব দরিদ্র দেশকে দেওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছে।
আনুষ্ঠানিক ঘোষণা প্রকাশের আগেই জি–৭–এর পরিকল্পনার বিষয়ে সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন কিছুটা সাবধানবাণী দিয়ে বলেছেন, এই পরিকল্পনা যথেষ্ট নয়। তাঁর মতে, ২০২২ সালের মধ্যে বিশ্বকে ঝুঁকিমুক্ত করার মতো টিকা দিতে হলে আগামী কয়েক মাসে দরিদ্র দেশগুলোতে এর সরবরাহ আরও অনেক বেশি বাড়াতে হবে। এটি অর্জনের জন্য নতুন উৎপাদন সক্ষমতা প্রয়োজন এবং প্রতিটি মহাদেশে তা সরবরাহের কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশ্চাত্যের দেশগুলোর উদ্বৃত্ত দিয়ে কিংবা চলতি গ্রীষ্ম এবং তার পরের শরৎকাল পর্যন্ত তাদের অপেক্ষায় রেখে বিশ্বকে ঝুঁকিমুক্ত করা যাবে না। তিনি তাই জি–৭ দেশগুলোর প্রতি চলতি বছরেই অন্তত ১ হাজার ৬০০ কোটি মার্কিন ডলার এবং আগামী বছরে আরও তিন হাজার কোটি ডলার জোগান দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
যুক্তরাজ্যের দারিদ্র্যবিরোধী নাগরিক সংগঠন ওয়ান–এর প্রধান লিজ ওয়ালেস বলেছেন, টিকা ভাগাভাগির এই কাজ কোথাও তাড়াতাড়ি হচ্ছে না। এটা এখনই হওয়া দরকার।
গর্ডন ব্রাউন একই সঙ্গে বিশ্বজুড়ে সবার টিকার ব্যবস্থা করার উদ্যোগে চীন, রাশিয়াসহ জি–২০–এর দেশগুলোকেও যুক্ত করার কথা বলেছেন। তবে জি–৭–এর রাজনৈতিক আলোচ্যসূচি থেকে সে ধরনের সম্ভাবনার কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায় না। আলোচ্যসূচিতে অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবন, অর্থনীতিকে মহামারির মতো আকস্মিক দুর্যোগে টিকে থাকার মতো সক্ষম করে তোলা, পররাষ্ট্রনীতি, মুক্ত সমাজ এবং জলবায়ু ও প্রকৃতি সংরক্ষণের বিষয়গুলো আছে। পররাষ্ট্রনীতির আলোচনায় চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’–এর পাল্টা হিসেবে ‘বিল্ড ব্যাক বেটার ওয়ার্ল্ড’ উদ্যোগ নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র যে মুক্ত বিশ্বের নেতা হিসেবে আন্তর্জাতিক ভূমিকায় আবারও নেতৃত্বের ভূমিকা গ্রহণ করতে চলেছে, এই শীর্ষ বৈঠকে সে বার্তাই প্রাধান্য পাচ্ছে। চীনের ক্রমেই প্রভাবশালী হয়ে ওঠা এবং রাশিয়ার সঙ্গে বিদ্যমান রাজনৈতিক বিরোধ বৈশ্বিক স্বাস্থ্য দুর্যোগের ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলছে।
গতকাল শনিবার জি–৭–ভুক্ত দেশ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি, জাপান ও কানাডার নেতাদের সঙ্গে বিশেষ আমন্ত্রণে আলোচনায় অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও দক্ষিণ কোরিয়ার নেতারা এবং জাতিসংঘ মহাসচিব সশরীর অংশ নেন। আর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি অংশ নেন ভিডিও সংযোগে। এ ছাড়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান, আইএমএফ, বিশ্বব্যাংকের প্রধানেরাও ভিডিও সংযোগে অংশ নেন।
আজ রোববার ইশতেহার ঘোষণার মধ্য দিয়ে শীর্ষ সম্মেলন শেষ হবে। তবে চূড়ান্ত ইশতেহারে মহামারি মোকাবিলার বিষয়ে আর্থিক বিনিয়োগসহ আর কোনো পদক্ষেপের ঘোষণা থাকছে কি না, তা নিয়ে আলোচনা রয়েছে। আর সেটি না থাকলে চলমান মহামারি মোকাবিলায় এই শীর্ষ সম্মেলনের ফলাফল প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে।