কাজের জন্য ঘরের বাইরে বেরিয়েছিলেন প্রাণিবিদ ক্রিস্টোফার হ্যারল। প্রচণ্ড গরমে টিকতে না পেরে ছায়া খুঁজে নিতে হয় তাঁকে। পরে বরফে জমানো আঙুর খেয়ে কিছুটা ধাতস্থ হন। সমুদ্র নিয়ে পড়ে থাকা মানুষের সাধারণত তাপ, পানির সহ্যক্ষমতা বেশিই হয়। তিনি বিজ্ঞানী হোন, সাঁতারু অথবা নাবিক। মানুষ নিজেকে বাঁচাতে কোনো না কোনো কৌশল বের করে ফেলে, কিন্তু সমুদ্রের প্রাণীদের সে সুযোগ নেই—এ কথা যেন নিজেই নিজেকে শোনাচ্ছিলেন সামুদ্রিক প্রাণিবিদ ক্রিস্টোফার।
বিশ্ববাসীকে এক ভয়াবহ আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। এরই মধ্যে তা সত্যি হতে শুরু করেছে। আর ভ্যাঙ্কুভারে সমুদ্রসৈকতে যাঁরাই যাচ্ছেন, আঁতকে উঠছেন। এই সৈকতে এখন বাতাসে মাংস পচা গন্ধ আর পায়ের তলায় মৃত প্রাণীর শুকনা খোলসের খরখর শব্দ। ক্রিস্টোফার বলছিলেন, ঝিনুক, তারা মাছ আর শামুকগুলো গরম পানিতে সেদ্ধ হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এক সপ্তাহ ধরে কানাডায় অব্যাহত ভয়াবহ তাপমাত্রায় প্রাণ হারাতে পারে শতকোটির বেশি জলজ প্রাণী।
ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানে গত বৃহস্পতিবার প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ক্রিস্টোফার দলবলসহ যখন ভ্যাঙ্কুভারে সমুদ্রসৈকতে যান, তখন তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ১২২ ডিগ্রি ফারেনহাইটের বেশি অনুভব করছিলেন। আর ঝিনুকের মতো অনেক জলজ প্রাণীর চূড়ান্ত সহনীয় তাপমাত্রা ১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট। তা–ও সর্বোচ্চ কয়েক ঘণ্টার জন্য।
বাস্তুসংস্থানবিদ অ্যালিসা নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেন, ভ্যাঙ্কুভারের সৈকতে সাঁতার কাটতে পানিতে নামার আগে সামুদ্রিক প্রাণীর খোলস সরিয়ে হাঁটার পথ খুঁজে নিতে হয় তাঁকে।
গত সপ্তাহে কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়া প্রদেশের প্যাসিফিক নর্থওয়েস্ট এলাকায় তাপমাত্রা ৪৯ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। তীব্র দাবদাহে মারা গেছেন কয়েক শ মানুষ। একই সময় শুরু হয় ভয়াবহ দাবানল। এতে অনেকে এলাকা পুড়ে গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আর প্রাণীর মৃত্যুর ঘটনা প্রকাশ পাচ্ছে ধীরে ধীরে।
আসছে সপ্তাহে আরেকটি ভয়াবহ দাবদাহ শুরুর সতর্কতা দিচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমাঞ্চল এবং কানাডার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ওপর দিয়ে এই দাবদাহ বয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। সন্দেহ নেই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মুখে জলজ প্রাণীরা। তাদের না আছে ছায়া খুঁজে নেওয়ার সুযোগ, না সম্ভব সমুদ্রের পানি থেকে দৌড়ে স্থলভাগে বসবাসের শক্তি। এখন কথা হচ্ছে, নীরবে সয়ে যাওয়া ঝিনুকেরা প্রতিবাদ করতে জানে না এবং তারা মরে গেলে কী এমন ক্ষতিবৃদ্ধি?
শামুক ও ঝিনুক প্রজাতির জলজ প্রাণী পানি শোধক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। যত বেশি জলজ প্রাণী মারা যাচ্ছে, পানি তত দ্রুত মান হারাচ্ছে। ঝিনুকের প্রতি স্কয়ার মিটার আবাসস্থলে কয়েক ডজন প্রজাতির অন্য ক্ষুদ্র প্রাণীর আশ্রয়স্থল। সেই খুদে প্রাণীরা মনিবকে হারিয়ে উদ্বাস্তু হয়ে হয়তো মারা যায় আরও আগেই। কে রাখবে সে খবর! গত গ্রীষ্মে সামুদ্রিক শৈবাল অভিবাসনের ঘটনার খবরে বিস্মিত হয়েছিলেন অনেকেই। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অস্ট্রেলিয়ার গ্রেট ব্যারিয়ার রিফের প্রবালের ৩৫ শতাংশ ক্ষয় হয়ে গেছে বা বিলুপ্তির পথে থাকার খবর নিশ্চিত হওয়া গেছে ২০১৬ সালে। পানির তলায় থাকা অধিকাংশ সময় দেখতে না পাওয়া সালোকসংশ্লেষণকারী এ উদ্ভিদ শুধু মাছের খাবারই নয়, একই সঙ্গে পানির গুণগত মান রক্ষাকারীও। স্বাদু ও লোনাপানির বাস্তুতন্ত্রের এই পরিবর্তনের পেছনে দায়ী জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব।
সামুদ্রিক প্রাণিবিদেরা আশঙ্কা করছেন, হিট ডোমের প্রভাবে কানাডার প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে প্রাণ হারাতে পারে কয়েক শ কোটি জলজ প্রাণী। এই হিট ডোম তৈরি হয় বায়ুমণ্ডলে সাগরের উষ্ণ বায়ু আটকে।
প্রকৃতির এই পরিবর্তনগুলো আমাদের বিশেষ বিচলিত করে না, কেননা ওই মুহূর্তে এর প্রভাব তাৎক্ষণিকভাবে স্পষ্ট হয় না। যেমন কীটনাশকের ব্যবহারের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি অনুভব করতে প্রয়োজন হয় কয়েক বছর অথবা লোনাপানির চিংড়ির ঘের দেশি মাছ ও মাটির বাঁধের জন্য কতটা ক্ষতিকর, তা বুঝতে অপেক্ষা করতে হয় দু–একটি মৌসুম।
ক্রিস্টোফার বলছিলেন, প্রকৃতির চক্রের পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে না পারলে অচিরেই নিশ্চিহ্ন হবে অনেক অনেক প্রজাতির প্রাণ। আর আবহাওয়া যেভাবে বদলাচ্ছে, তাতে করে মানিয়ে নেওয়ার সম্ভাবনাও খুব কম। যেমন ঝিনুকের প্রজন্মের চক্রবৃদ্ধিকাল দুই বছর। তারা মাছ বেঁচে থাকে এক দশক পর্যন্ত। তাদের প্রজনন হার খুব ধীরগতির। ফলে সমুদ্রের পানির তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে এই প্রাণীরা হারিয়ে যেতে পারে চিরকালের জন্য।
সম্প্রতি বাংলাদেশের সমুদ্রসৈকতে একের পর এক ভেসে আসছে মৃত কাছিম, তিমি আর ডলফিন। কিছু মৃত কচ্ছপ ও ডলফিন কুকুরে খেয়ে ফেলছে। আর কিছু পচে ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ। সমুদ্রে শুধু আঘাতপ্রাপ্ত হয়েই ওরা মরে যাচ্ছে তা নয়। দূষণের মাত্রাই এর বড় কারণ বলে নিশ্চিত।
সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে কয়েক দফায় কয়লা ও তেলের জাহাজডুবির পর সেখানে বিপন্ন হয়েছে পরিবেশ ও প্রতিবেশ। এ বছরের মে মাসে সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের দাসের ভারনী এলাকার বনে আগুন লাগে। কয়েক দিনের সে আগুনে পুড়েছে সংরক্ষিত বনের কয়েক একরের বেশি জায়গার সুন্দরী, গেওয়া, গরানগাছসহ লতাগুল্ম।
এর পেছনে বাওয়াল-মৌয়ালদের ফেলে দেওয়া বিড়ি, সিগারেটের আগুনকে যেমন দায়ী করা হয়, তেমনি ইচ্ছে করে আগুন লাগানোর ঘটনাকেও সম্ভাব্য কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। পাশাপাশি তদন্ত কর্মকর্তারা বলছিলেন, পাতা পচে মিথেন গ্যাস তৈরি হয়ে আগুন লাগতে পারে। অগ্নিকাণ্ডের কারণ যা–ই হোক, যদি তা দাবানলে পরিণত হয়, এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।
আর সে আগুন থেকে সেখানকার জীববৈচিত্র্য বিপন্ন হওয়া খুব স্বাভাবিক ঘটনা। এরই মধ্যে এর যথেষ্ট উদাহরণও তৈরি হয়েছে। বন বিভাগের তথ্যমতে, গত প্রায় দুই দশকে ২৩ বার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। ২২ বারের অগ্নিকাণ্ডে ৭১ একর ৬৬ শতাংশ বনজ সম্পদ (সুন্দরী গাছসহ বিভিন্ন লতাগুল্ম) পুড়ে যায়, যার আর্থিক মূল্য ১৮ লাখ ৫৫ হাজার ৫৩৩ টাকা বলে জানিয়েছে বন বিভাগ। গাছপালার হিসাব তা–ও বের করা সম্ভব কিন্তু এ অগ্নিকাণ্ড বা তেল-কয়লার কার্গোর দুর্ঘটনায় যেসব প্রাণী বিপন্ন অবস্থায় পড়ে, তাতে যে প্রাকৃতিক ক্ষতি হয়, সে হিসাব বের করার মতো সক্ষমতা এখনো আমাদের নেই। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যখন তাপমাত্রা প্রতিদিনই অতীতের ইতিহাস ছাড়িয়ে যাচ্ছে, তখন সামান্য আগুনই যে আমাদের সুন্দরবনেও কখনো দাবানলে রূপ পাবে না, সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায় না।
২০২০ সালের অক্টোবরে প্রথম আলোর সম্পাদকীয়তে স্থান পেয়েছিল প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনের খবর। আশঙ্কা প্রকাশ করে বলা হয়েছিল, ‘পর্যটকদের অবাধ যাতায়াতে প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনের অস্তিত্ব ও জীববৈচিত্র্য যে মারাত্মক হুমকির মুখে, সে কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সে বিবেচনা থেকেই সম্ভবত সরকার সেখানে পর্যটকের সংখ্যা সীমিত রাখার উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে। কিন্তু এর আগেই কক্সবাজার থেকে সেন্টমার্টিন সরাসরি জাহাজ চলাচলের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।’
২০৪৫ সালের মধ্যে দ্বীপটি পুরোপুরি প্রবালশূন্য হতে পারে, এমন আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে আন্তর্জাতিক ওশান সায়েন্স জার্নাল-এ প্রকাশিত এক গবেষণা নিবন্ধে। এই দ্বীপে প্রবাল ছাড়াও রয়েছে বিলুপ্তপ্রায় জলপাই রঙের কাছিম, চার প্রজাতির ডলফিন, বিপন্ন প্রজাতির পাখিসহ নানা ধরনের প্রাণীর বাস। এ দ্বীপের প্রবাল বিক্রি এখনো চলছে অবাধভাবেই।
কানাডার ওই সমুদ্রসৈকতে ঝিনুকের খোলস সরিয়ে পথ করে নিতে হচ্ছে এখন। এ মাত্রা আরও প্রকট হবে কিছুদিনের মধ্যে। এমন পরিস্থিতি কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন বা কুয়াকাটায় তৈরি হলে সে দৃশ্য কেমন হবে!
গত গ্রীষ্মে সামুদ্রিক শৈবাল অভিবাসনের ঘটনার খবরে বিস্মিত হয়েছিলেন অনেকেই। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অস্ট্রেলিয়ার গ্রেট ব্যারিয়ার রিফের প্রবালের ৩৫ শতাংশ ক্ষয় হয়ে গেছে বা বিলুপ্তির পথে থাকার খবর নিশ্চিত হওয়া গেছে ২০১৬ সালে।
সামুদ্রিক প্রাণিবিদেরা আশঙ্কা করছেন, হিট ডোমের প্রভাবে কানাডার প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে প্রাণ হারাতে পারে কয়েক শ কোটি জলজ প্রাণী। এই হিট ডোম তৈরি হয় বায়ুমণ্ডলে সাগরের উষ্ণ বায়ু আটকে। সম্প্রতি বঙ্গোপসাগরে তৈরি হওয়া ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা বাড়ছে দ্রুত। প্রায় প্রতিবছরই বড় কোনো ঝড় হানছে আঘাত। ক্রিস্টোফার বা অ্যালিসার মতো সমুদ্র চেনা মানুষেরা দাবদাহ থেকে পালিয়ে বেঁচেছেন। প্রাণীদের পক্ষে তা সম্ভব নয়। আমরা যদিও বা কেউ কেউ পালিয়ে বাঁচতে পারি, তা হবে সাময়িক আর অচিরেই হয়তো আমাদেরও চিরতরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার তালিকায় লিখতে হবে পরিচিত অনেক প্রাণীর নাম। পরিবেশ রক্ষায় যাদের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি।
দৃশ্যটি ভাবতে ভালো না লাগলেও চেষ্টা করে আসুন একবার ভাবি। সমুদ্রসৈকতের সূর্যোদয় বা সূর্যাস্তের নান্দনিক দৃশ্য থেকে মাটিতে চোখ রাখলেই দেখা যাচ্ছে শত শত ঝিনুকের খোলস, যারা উত্তপ্ত পানিতে ঝলসে গেছে। তখনো হয়তো আমরা কবিতার আশ্রয় নিয়ে আবৃত্তি করব, ‘ঝিনুক নীরবে সহো’। কেননা আমরা এখনো ঠিক জানি না, এ ক্ষতির প্রভাব কতখানি ভয়াবহ!