উত্তর কোরিয়ার ‘করোনা-রহস্য’
কয়েক সপ্তাহ আগে উত্তর কোরিয়া প্রথম দেশটিতে করোনা শনাক্তের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়। কিন্তু এখন দেশটির সরকার দাবি করছে, উত্তর কোরিয়ায় করোনার প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তবে দেশটির করোনা পরিস্থিতির প্রকৃত চিত্র ‘রহস্য’ হিসেবেই রয়ে গেছে।
উত্তর কোরিয়ার করোনা পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে নানা সূত্র থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছে বিবিসি। প্রাপ্ত তথ্যের আলোকে বিবিসি উত্তর কোরিয়ার করোনা পরিস্থিতির প্রকৃত চিত্র বোঝার চেষ্টা করেছে।
প্রায় ১০ বছর আগে উত্তর কোরিয়া থেকে পালিয়ে যান কিম হোয়াং-সান। তিনি এখন দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলে থাকেন। তাঁর দুই সন্তান, নাতি-নাতনি ও ৮৫ বছর বয়সী মা উত্তর কোরিয়াতে আছেন। উত্তর কোরিয়া থেকে তাঁদের বের করে নিয়ে আসার আশা অনেকটাই ছেড়ে দিয়েছেন হোয়াং-সান।
উত্তর কোরিয়ায় থাকা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে গোপনে ফোনে কথা হয় হোয়াং-সানের। এই ফোনকলগুলো তাঁকে বেশ কষ্টেশিষ্টে স্থাপন করতে হয়। ফোনে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে কথা বলতে হয়। তিনি ফোনে কখনোই পাঁচ মিনিটের বেশি কথা বলেন না।
গত ১২ মে উত্তর কোরিয়া প্রথম করোনা শনাক্তের ঘোষণা দেয়। করোনা শনাক্তের তথ্য পিয়ংইয়ংয়ের প্রকাশ্যে স্বীকার করার ঘটনাকে বিরল হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
করোনা শনাক্তের বিষয়টিকে গুরুতর জাতীয় জরুরি অবস্থা হিসেবে বর্ণনা করে উত্তর কোরিয়া সরকার। একই সঙ্গে সরকার দেশজুড়ে কঠোর লকডাউনের নির্দেশ দেয়।
উত্তর কোরিয়া সরকারের প্রকাশ করা তথ্যই দেশটির প্রত্যেকটি প্রদেশে দ্রুত করোনা ছড়িয়ে পড়ার ইঙ্গিত দেয়।
উত্তর কোরিয়ায় থাকা পরিবারের সদস্যদের বরাত দিয়ে হোয়াং-সান বলেন, ‘তাঁরা আমাকে বলেছেন, সেখানকার অনেক লোক জ্বরে ভুগছেন।’
হোয়াং-সান বলেন, ‘আমি বুঝতে পেরেছি যে পরিস্থিতি সত্যিই খারাপ। তাঁরা বলছিলেন, কারও সঙ্গে দেখা হলেই লোকজন ওষুধের কথা জানতে চাইছিলেন। সবাই তাঁদের জ্বর কমানোর জন্য কিছু একটা উপায় খুঁজছিলেন। কিন্তু কেউ কিছু খুঁজে পাচ্ছিলেন না।’
উত্তর কোরিয়ায় কথিত জ্বরে ঠিক কত লোক মারা গেছে, তা পরিবারের সদস্যদের কাছে জিজ্ঞেস করার সাহস হয়নি হোয়াং-সানের। তিনি বলেন, এসব কথাবার্তা যদি ফাঁস হয়, তাহলে তাঁর পরিবারের সদস্যদের জীবন হুমকির মুখে পড়বে। তাঁদের হত্যাও করা হতে পারে।
উত্তর কোরিয়ার স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা খুবই দুর্বল। দেশটিতে করোনা পরীক্ষার উপায়-উপকরণেরও মারাত্মক অভাব রয়েছে।
সরকারি তথ্য অনুসারে, উত্তর কোরিয়ার জনসংখ্যার প্রায় ১৫ শতাংশ জ্বরে ভুগছেন।
উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-উন তাঁর দেশে ওষুধের ঘাটতি থাকার কথা স্বীকার করেছেন। তিনি দেশটির সেনাবাহিনীকে তাদের মজুত থেকে ওষুধ বিতরণের নির্দেশ দিয়েছেন।
হোয়াং-সান জানান, উত্তর কোরিয়ার হাসপাতাল ও ফার্মেসিগুলোতে কয়েক বছর ধরেই ওষুধের ঘাটতি রয়েছে।
দেশটির চিকিৎসকেরা রোগীদের ব্যবস্থাপত্র (প্রেসক্রিপশন) দিয়ে তাঁদের দায়িত্ব শেষ করেন। তারপর ওষুধ খুঁজে পাওয়া, তা কেনার দায়িত্ব রোগীদের। রোগীরা কোথায় কীভাবে ওষুধ পাবেন, তা ভাবা কর্তৃপক্ষের কাজ নয়।
পরিস্থিতি বোঝাতে হোয়াং-সান বলেন, ‘আপনার যদি অস্ত্রোপচারের জন্য চেতনানাশক প্রয়োজন হয়, তাহলে আপনাকে বাজারে যেতে হবে। চেতনানাশক সংগ্রহ করে আপনাকে হাসপাতালে ফিরে আসতে হবে। কিন্তু এখন বাজারে বিক্রেতাদের হাতেও তেমন ওষুধ নেই।’
হোয়াং-সানের পরিবারের সদস্যরা তাঁকে জানিয়েছেন, করোনা মহামারির প্রেক্ষাপটে উত্তর কোরিয়ার সরকার দেশটির জনসাধারণকে পাইনপাতা সেদ্ধ করে তার নির্যাস পান করতে বলছে। দেশটির রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম করোনার উপসর্গ উপশমে লবণপানিতে গার্গল করার পরামর্শ দিচ্ছে।
নাগি শফিক ২০০১ সাল থেকে উত্তর কোরিয়ায় ইউনিসেফের হয়ে কাজ করেছেন। সেখানে তিনি সবশেষ ছিলেন ২০১৯ সালে। তখন দেশটিতে ওষুধের ঘাটতি দেখেছেন তিনি। তাঁর ভাষ্যমতে, তখন দেশটিতে কিছু ওষুধ ছিল। কিন্তু তাঁর পরিমাণ ছিল খুব কম।
নাগি শফিক বলেন, উত্তর কোরিয়ায় যখন ওষুধ না থাকে, তখন দেশটির কর্তৃপক্ষ সনাতনী চিকিৎসা পদ্ধতিতে চলে যায়।
উত্তর কোরিয়া প্রায় সব ওষুধই চীন থেকে আমদানি করে। করোনার সংক্রমণ রোধে গত দুই বছর উত্তর কোরিয়া তার সব সীমান্ত বন্ধ রাখে। এ কারণে চীন থেকে উত্তর কোরিয়ায় ওষুধের সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়।
‘লিবার্টি ইন নর্থ কোরিয়া’ নামের সংগঠনের সোকিল পার্ক বলেন, তিনি জানতে পেরেছেন, উত্তর কোরিয়ায় এখন ওষুধের তীব্র সংকট চলছে। দেশটিতে ওষুধ ফুরিয়ে যাওয়ার পথে। যে ওষুধ আছে, তার দামও আকাশচুম্বী।
করোনার প্রাদুর্ভাব ঘোষণার দিন উত্তর কোরিয়ার সরকার জাতীয় লকডাউনের নির্দেশ দেয়। এ কারণে লোকজন খাদ্যের অভাবে পড়তে পারে বলে উদ্বেগ দেখা দেয়।
পর্যবেক্ষণ ওয়েবসাইট এনকে নিউজ দক্ষিণ কোরিয়ার সীমান্ত থেকে কিছু ছবি তুলেছে। এসব ছবিতে দেখা যায়, উত্তর কোরিয়ায় লকডাউন আরোপের পরের দিনগুলোতে মাঠে কাজ করছেন কৃষিশ্রমিকেরা।
তবে দেশটির রাজধানী পিয়ংইয়ংসহ যেসব এলাকায় করোনার সংক্রমণের হার সর্বোচ্চ, সেখানকার লোকজন তাঁদের বাড়িতে অবরুদ্ধ অবস্থায় রয়েছেন বলে জানা যায়।
উত্তর কোরিয়ার ভেতরে কী ঘটছে, সে–সংক্রান্ত তথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রে দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলভিত্তিক ওয়েবসাইট ডেইলি এনকের লি সাং-ইয়ংয়ের ‘নেটওয়ার্ক’ রয়েছে।
চীনা সীমান্তবর্তী হাইসান শহরের পরিস্থিতি সম্পর্কে লি সাং-ইয়ং বলেন, গত মে মাসে শহরটির লোকজনকে ১০ দিনের জন্য বাড়ি থেকে বের হতে দেওয়া হয়নি। যখন লকডাউন তুলে নেওয়া হয়, তখন দেখা যায়, খাবারের অভাবে দুর্বল হয়ে অনেক মানুষ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
করোনায় উত্তর কোরিয়ায় এখন পর্যন্ত মাত্র ৭০ জনের মৃত্যুর আনুষ্ঠানিক তথ্য পাওয়া গেছে। সে হিসাবে উত্তর কোরিয়ায় করোনায় মৃত্যুর হার শূন্য দশমিক ০০২, যা বিশ্বের মধ্যে সর্বনিম্ন।
উত্তর কোরিয়া-সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে ‘থার্টিএইট নর্থ’ নামের একটি প্ল্যাটফর্ম। প্ল্যাটফর্মটির বিশ্লেষক মার্টিন উইলিয়ামস বলেন, যে দেশটির স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা দুর্বল, যেখানে কাউকে টিকা দেওয়া হয় না, সেখানে করোনায় মৃত্যুর হার এত কম হতেই পারে না। এই পরিসংখ্যান ঠিক নয়।
মার্টিন উইলিয়ামসের পর্যবেক্ষণ হলো, উত্তর কোরিয়ায় করোনার সংক্রমণ-মৃত্যুর বিষয়ে জাতীয়ভাবেই মিথ্যা বা ত্রুটিপূর্ণ তথ্য দেওয়া হচ্ছে। দেশটির স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্মকর্তারাও শাস্তির ভয়ে করোনায় ঠিক কতজন মারা গেছেন, তা স্বীকার করতে চান না।
গত সপ্তাহে উত্তর কোরিয়া সরকার করোনা শনাক্তের সংখ্যা কমে যাওয়ার তথ্য দেয়। দেশটির রাষ্ট্রীয় সংবাদপত্রের সম্পাদকীয়তে দাবি করা হয়, কর্তৃপক্ষ করোনাভাইরাস দমন ও নিয়ন্ত্রণ করে ফেলেছে।
তবে গত বুধবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) জরুরি স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মাইক রায়ান বলেন, উত্তর কোরিয়ার করোনা পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে বলে তিনি আশঙ্কা করছেন।
মাইক রায়ান আরও বলেন, উত্তর কোরিয়া তার করোনা–সংক্রান্ত তথ্যে ডব্লিউএইচওর প্রবেশাধিকার দেয়নি। এ কারণে বিশ্বকে দেশটির পরিস্থিতি সম্পর্কে একটি সঠিক চিত্র প্রদান করা কঠিন হয়ে উঠেছে।
করোনার টিকা সরবরাহে উত্তর কোরিয়াকে একাধিকবার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল বলে জানান ডব্লিউএইচওর এই কর্মকর্তা। তবে এই প্রস্তাব দেশটি প্রত্যাখ্যান করে।
টিকাসহ অন্যান্য চিকিৎসাসামগ্রীর জন্য উত্তর কোরিয়া নিবৃত্তে তার প্রতিবেশী দেশ চীনের ওপর নির্ভর করছে বলে প্রতীয়মান হয়।
চীনা কাস্টমসের তথ্য অনুযায়ী, গত মার্চ থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চীন থেকে উত্তর কোরিয়ার আমদানি দ্বিগুণ হয়েছে। বিশেষ করে গত কয়েক মাসে হঠাৎ করে চীন থেকে উত্তর কোরিয়ার চিকিৎসাসামগ্রী আমদানি বেড়েছে।
চীনা কাস্টমসের তথ্য অনুসারে, গত এপ্রিলে প্রথম ব্যাচে চীন থেকে ১ হাজার ‘ভেন্টিলেটর’ আমদানি করেছে উত্তর কোরিয়া। এই ‘ভেন্টিলেটর’ দিয়ে অন্যান্য ছোট ধরনের অক্সিজেন চিকিৎসা-সংক্রান্ত যন্ত্রকেও বোঝায়।
গত জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চীন থেকে ৯ মিলিয়নের বেশি মাস্ক কিনেছে উত্তর কোরিয়া। এ ছাড়া দেশটি থেকে পিয়ংইয়ংয়ের আমদানি করা ওষুধ ও টিকার পরিমাণও বেড়েছে।
দক্ষিণ কোরিয়ার এক সরকারি কর্মকর্তার তথ্যমতে, সহায়তাসামগ্রী আনার জন্য গত ১৭ মে চীনে তিনটি কার্গো বিমান পাঠিয়েছে উত্তর কোরিয়া।
বিবিসি অবলম্বনে