করোনাভাইরাসকে বাঘের ভয় দেখাচ্ছেন সুগা

জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইয়োশিহিদে সুগা
ছবি: রয়টার্স

করোনাভাইরাসকে বাঘের ভয় দেখাচ্ছেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইয়োশিহিদে সুগা। প্রধানমন্ত্রীর সেই বাঘ হচ্ছে জরুরি অবস্থা। জরুরি অবস্থা ঘোষণার মধ্য দিয়ে সংক্রমণকে বাগে আনতে চাইছেন সুগা। তবে দুই দিন আগে সংবাদ সম্মেলনে এই পদক্ষেপ গ্রহণের সম্ভাবনা নিয়ে ইঙ্গিত দেন সুগা। এরপর থেকে জরুরি অবস্থার যেসব বৈশিষ্ট্য সরকারের পক্ষ থেকে তুলে ধরা হয়েছে, তাতে অনেকেই মনে করছেন সুগার সেই বাঘ হতে যাচ্ছে দন্তহীন বাঘ এবং করোনাভাইরাসের দাপট এর মধ্য দিয়ে সামাল দেওয়া সরকারের জন্য হবে কঠিন কাজ। অনেকেই বলছেন এ মুহূর্তে যা দরকার তা হলো অনেক বেশি কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ, ধরি মাছ না ছুঁই পানির মতো কোনো পদক্ষেপ নয়।

করোনাভাইরাস সামাল দেওয়ায় যেকোনো ত্রুটি—তা ভাইরাসের লাগামহীন বিস্তার কিংবা অর্থনীতির মারাত্মক ক্ষতি, যেটাই হোক না কেন, সুগার জন্য সেটি হয়ে উঠতে পারে বিদায়ঘণ্টা বাজার সংকেত।

সরকারের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে ৭ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার থেকে জরুরি অবস্থা কার্যকর হতে পারে, যার বিস্তৃতি অনেকটা সীমিত হলেও সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকবে।

প্রথমত, সমগ্র জাপান নয়, বরং টোকিও ও পাশের তিনটি জেলাই কেবল জরুরি অবস্থার আওতায় পড়বে। এ ছাড়া স্কুল-কলেজ যথারীতি চালু থাকবে এবং অফিস–আদালতও নিয়মিত বসবে। শুধু তাই নয়, এমনকি দোকানপাট ও পরিবহনব্যবস্থার ওপরও বাড়তি কোনো চাপ পড়বে না। কেবল পানশালা, রেস্তোরাঁ ও কারাওকে বারের মতো উপভোগ ও বিনোদনের জায়গাগুলোকে স্থানীয় সময় রাত আটটার মধ্যে দিনের ব্যবসা বন্ধ করে দিতে বলা হবে। বিদেশিদের জাপানে আসার ওপর আরও কিছুটা কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হবে।

এ রকম ঢিলেঢালা পদক্ষেপ সংক্রমণ সামাল দিতে কতটা সহায়ক হবে, তা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন করতে শুরু করেছেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বুধবার দ্বিতীয় দিনের মতো সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞদের একটি বৈঠকের আয়োজন করেছিল। বিশেষজ্ঞরা সেখানে আরও কঠোর ও আরও দীর্ঘ সময়ের জন্য প্রতিরোধ পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন।

গতকাল মঙ্গলবার সমগ্র জাপানে নতুন সংক্রমণ শনাক্ত করা হয়েছে ৪ হাজার ৯১৩টি এবং একই দিনে করোনাভাইরাস–সম্পর্কিত মৃত্যুর হিসাব হচ্ছে ৭৬টি। উভয় হিসাবই নতুন রেকর্ড।

তবে প্রধানমন্ত্রী সম্ভবত অর্থনীতির ওপর যেকোনো কঠোর পদক্ষেপের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে অনেক বেশি চিন্তিত। এর বাইরে অলিম্পিক নিয়ে দুশ্চিন্তাও তাঁর পিছু ছাড়ছে না। ফলে করোনাভাইরাসের বিস্তার বন্ধ করতে নেওয়া যেকোনো পদক্ষেপ সেসব দিকের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলুক, তিনি তা চাইছেন না। আর তাই কিছুটা রাখঢাক, কিছুটা পরোক্ষ উপায়ের আশ্রয় তাঁকে নিতে হচ্ছে।

এদিকে সরকারের এমন দোদুল্যমানতার সুযোগে জাপানে সমানে বেড়ে চলেছে ভাইরাসের সংক্রমণ। আজ বুধবার টোকিওতে ১ হাজার ৫৯২ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছেন। এই হিসাব হচ্ছে আবারও এক দিনের সর্বোচ্চ রেকর্ড এবং এর আগের রেকর্ড সংখ্যার চেয়ে ২৫০টির বেশি।

এদিকে দেশজুড়েও চলছে সংখ্যাগত রেকর্ডের ভাঙচুরের খেলা। গতকাল মঙ্গলবার সমগ্র জাপানে নতুন সংক্রমণ শনাক্ত করা হয়েছে ৪ হাজার ৯১৩টি এবং একই দিনে করোনাভাইরাস–সম্পর্কিত মৃত্যুর হিসাব হচ্ছে ৭৬টি। উভয় হিসাবই নতুন রেকর্ড। এদিকে মারাত্মক অবস্থায় থাকা রোগীর সংখ্যা একদিন আগের চেয়ে আরও ৪০টি বেড়ে ৭৭১-এ দাঁড়িয়েছে। ফলে হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোকে এখন নজিরবিহীন চাপের মুখে পড়তে হচ্ছে। অবস্থার দ্রুত উন্নতি না হলে হাসপাতাল সেবা ভেঙে পড়া নিয়ে উদ্বেগ বোধ করছেন চিকিৎসক ও সেবা কর্মীরা।

আবার জরুরি অবস্থা অর্থনীতির ওপর কতটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে, সেই হিসাব কষতেও পিছিয়ে নেই আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসার সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান। এরা বলছে জরুরি পদক্ষেপ এক মাস স্থায়ী হলে জাপানের অর্থনীতি বার্ষিক হিসাবে প্রায় এক শতাংশের কাছাকাছি সংকুচিত হতে পারে। অন্যদিকে চাকরিচ্যুত হতে পারেন প্রায় ৭৫ হাজার মানুষ।

এর বাইরে করোনা পরিস্থিতির অবনতি অব্যাহত থাকার কারণে যে অলিম্পিক ভন্ডুল হয়ে যেতে পারে, তা নিয়েও চিন্তিত সুগা প্রশাসন। ফলে দুই দিকের মধ্যে একটি ভারসাম্য টেনে দিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো জরুরি অবস্থা জারির পথে এগিয়ে যেতে হচ্ছে সরকারকে। এর পরিণতি শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়াতে পারে, তা হয়তো আঁচ করতে পারছে না কোনো পক্ষই।

প্রধানমন্ত্রীর জন্য আরেকটি মাথাব্যথা হচ্ছে, চলতি বছর শরৎকালে নির্ধারিত ক্ষমতাসীন দলের নেতৃত্বের নির্বাচন এবং এর ঠিক পরপর অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া নিম্নকক্ষ নির্বাচন। করোনাভাইরাস সামাল দেওয়ায় যেকোনো ত্রুটি—তা ভাইরাসের লাগামহীন বিস্তার কিংবা অর্থনীতির মারাত্মক ক্ষতি, যেটাই হোক না কেন, সুগার জন্য সেটি হয়ে উঠতে পারে বিদায়ঘণ্টা বাজার সংকেত। আর এ কারণেই হয়তো সিদ্ধান্তহীনতা থেকে ধরি মাছ না ছুঁই পানির মতো পদক্ষেপ গ্রহণের দিকে তাঁর হেঁটে যাওয়া।