জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইয়োশিহিদে সুগা
রয়টার্সের ফাইল ছবি

ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ানোর ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইয়োশিহিদে সুগা। তাঁর এই ঘোষণা অনেকটাই ছিল অপ্রত্যাশিত। কারণ, সম্প্রতি দলের সভাপতি নির্বাচনে নিজের অবস্থান অনেকটাই তিনি পোক্ত করে নিতে পেরেছিলেন। ফলে ধারণা করা হচ্ছিল নেতৃত্বের বদল জাপান শিগগিরই হয়তো না–ও দেখতে পারে।

জাপানের ক্ষমতাসীন উদার গণতন্ত্রী দল এলডিপির নেতা তিন বছরের জন্য নির্বাচিত হয়ে থাকেন। দলীয় নেতার পদে বহাল থাকা অবস্থায় সংসদে দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলে একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর পদেও তিনি বহাল হন। সুগা জাপানের প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করেছিলেন ২০২০ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর। এর আগে বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের ছেড়ে দেওয়া দলীয় সভাপতি পদে আবের অবশিষ্ট মেয়াদের জন্য তাঁকে নির্বাচিত করা হয়েছিল, যে মেয়াদ চলতি মাসে শেষ হবে। ফলে তিন বছরের পূর্ণ মেয়াদে দলীয় সভাপতির পদে আসীন হয়ে সম্ভব হলে আগামী তিন বছর রাষ্ট্র পরিচালনার হাল ধরার ইচ্ছা তিনি এর আগে ব্যক্ত করেছিলেন। ‘সম্ভব হলে’ বাক্যটি এখানে এ কারণে উল্লেখ করা হয়েছে যে প্রধানমন্ত্রীর পদ ধরে রাখতে হলে আরও যে একটি শর্ত তাঁকে পূরণ করতে হতো তা হলো, আগামী মাসে নির্ধারিত সংসদের নিম্ন কক্ষের সাধারণ নির্বাচনে দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা বজায় রাখা।

জাপানের রাজনীতিতে এলডিপির আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ ১৯৫৫ সালে, সেই সময়ের দুটি রক্ষণশীল দলের একীভূত হওয়ার মধ্য দিয়ে। তখন থেকে দল বলা যায় প্রায় টানা ক্ষমতা ধরে রেখেছে। মাঝে স্বল্প সময়ের বিরতিতে ১৯৯৩-১৯৯৪ সালে ১০ মাসের জন্য এবং ২০০৯ থেকে ২০১২ সালের শেষ দিক নাগাদ প্রায় ৩ বছরের জন্য দলকে ক্ষমতার বাইরে থাকতে হয়। ফলে ৬৬ বছরের ইতিহাসে বছর চার বাদ দিয়ে পুরো সময় ক্ষমতা ধরে রাখা হচ্ছে জাপানের রাজনীতিতে এলডিপির সবচেয়ে বড় সাফল্য। দলটি এই সাফল্য নিশ্চিত করে নিতে পেরেছে দেশের শিল্প ও বাণিজ্য খাত এবং আমলাতন্ত্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের মধ্য দিয়ে। এর ফলে জাপানের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার পেছনে দলটি বড় ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়। পাশাপাশি দলের জনসমর্থনের ভিত্তিও মজবুত করতে পেরেছে।

এলডিপির সভাপতি নির্বাচন দুই ধাপে হয়ে থাকে। শুরুতে দলের সাধারণ সদস্যরা নিজেদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেন। তবে সেই ভোটের মূল্যায়ন হয়ে থাকে অনেক কম। দ্বিতীয় পর্যায়ে দলের সাংসদদের দেওয়া ভোট ফলাফল নির্ধারণে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফলে সভাপতি নির্বাচন এগিয়ে আসতে থাকা অবস্থায় প্রার্থীরা মূলত সংসদ সদস্যদের দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করেন, তবে সেখানেও ভিন্ন আরেকটি হিসাব অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

এলডিপি একক একটি দল হলেও উপদলীয় রাজনীতি শুরু থেকেই দলকে নানাভাবে প্রভাবিত করে আসছে। এসব উপদল আবার গড়ে উঠেছে যতটা না আদর্শের ভিত্তিতে, তার চেয়ে অনেক বেশি আনুগত্যের মাপকাঠিতে। সময় ও পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে উপদলের সংখ্যার হেরফের হলেও মোটামুটি ৭ থেকে ১০টি উপদল অধিকাংশ সময়জুড়ে এলডিপিতে বিরাজমান ছিল। বলা বাহুল্য, সভাপতি নির্বাচনে সবচেয়ে বড় উপদল এবং সেই উপদলের নেতাকে কিং মেকারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখা যায়। ফলে প্রার্থীরা সাধারণত দেনদরবার করেন উপদলের নেতাদের সঙ্গে এবং তাঁদের আনুকূল্য লাভ করতে পারলে দলীয় সভাপতি পদে নির্বাচিত হওয়া সহজ হয়ে যায়।
প্রধানমন্ত্রী সুগা নিজে উপদলীয় রাজনীতির সঙ্গে সেভাবে যুক্ত না থাকলেও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় থাকার সুবাদে সবচেয়ে বড় উপদলের সমর্থন নিয়ে এক বছর আগে তিনি ক্ষমতাসীন হয়েছিলেন। এবারের নির্বাচনের আগেও প্রধান কয়েকটি উপদলের সমর্থন তিনি নিশ্চিত করে নিয়েছিলেন। ফলে অনেকেই ধারণা করেছিল, পূর্ণ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন হওয়া তাঁর জন্য হয়তো কঠিন হবে না। এ কারণেই দলীয় সভাপতির নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোয় সুগার দেওয়া আজকের ঘোষণা ছিল অনেকটাই অপ্রত্যাশিত। সিদ্ধান্তের পেছনের কারণ খুঁজে দেখার জন্য দৃষ্টি এখন যেদিকে আকৃষ্ট হচ্ছে, চলতি মাসের শেষে নির্ধারিত এলডিপির সভাপতি নির্বাচন সেটা নয়, বরং আরও এক মাস পরের সাধারণ নির্বাচন। সেই নির্বাচনে দলকে যেন বড় ধরনের সংকটের মুখে পড়তে না হয়, তা নিশ্চিত করে নিতেই নিজের সরে দাঁড়ানোকে সুগা সময়োচিত সিদ্ধান্ত হিসেবে হয়তো দেখে থাকবেন।

চলতি সপ্তাহের শুরুতে জাপানের প্রধান দুটি দৈনিক আসাহি ও মায়নিচি শিম্বুনের চালানো জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে সুগার প্রতি জনসমর্থনের হার এখন নেমে গেছে ৩০ শতাংশের নিচে, জাপানের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের গবেষকেরা যেটাকে বিপজ্জনক হার হিসেবে দেখে থাকেন। সুগার সরকার শুরু থেকেই জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেনি। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরিস্থিতি সামাল দেওয়ায় সরকারের তুলনামূলক ব্যর্থতাকে এর প্রধান কারণ হিসেবে দেখা হয়। টিকাদান কর্মসূচি চালু করতে সরকারের কালক্ষেপণ করোনার দ্রুত বিস্তারের পেছনে অবদান রেখেছে বলে নাগরিকদের অনেকে মনে করছেন। সেই সঙ্গে জরুরি অবস্থা নিয়ে সরকারের দোদুল্যমানতা পরিস্থিতি অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব অব্যাহত রাখে বলে ধারণা তাঁদের। জাপানের জনগণের বড় একটি অংশ এসবের জন্য মূলত সুগার প্রশাসনকে দায়ী করছেন।

সুগার নিজের জন্য জনপ্রিয়তা যাচাই করে দেখার বড় এক মাপকাঠি ছিল সপ্তাহ দুয়েক আগে অনুষ্ঠিত জাপানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর ইয়োকোহামার মেয়র নির্বাচন। সুগা নিজে ইয়োকোহামার একটি আসন থেকে নির্বাচিত সাংসদ। মেয়র নির্বাচনে তিনি যে প্রার্থীকে সমর্থন করেছিলেন, তিনি পরাজিত হলে সুগা হয়তো জনমত কোন দিকে যাচ্ছে, তার কিছুটা আঁচ পেয়েছিলেন। তবে চূড়ান্ত আঘাত এসেছে জাপানের প্রধান দুই পত্রিকার বাইরে আরও কয়েকটি জনমত জরিপের ফলাফল থেকে। এলডিপির ভেতরে বিশেষ করে তরুণ নেতৃত্ব মনে করছে, সুগাকে সামনে রেখে আগামী নির্বাচনে যাওয়া দলের জন্য বিপজ্জনক হয়ে দেখা দিতে পারে। ফলে শেষ রক্ষার একটি উপায় হিসেবেই নানা দিক থেকে এরা সুগার ওপর চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রেখেছিল এবং সেই চাপের মুখে সুগা সরে যাওয়ার ঘোষণা দিতে অনেকটা বাধ্য হন।

সুগার উত্তরসূরি হিসেবে দল কাকে বেছে নেবে, সেদিকে এখন সবার নজর। ইতিমধ্যে একাধিক প্রার্থী সামনে এগিয়ে এলেও উপদলীয় সমর্থনের নতুন বিন্যাস কী দাঁড়াতে পারে, তা এখনো পরিষ্কার নয়। প্রবীণ নেতৃত্ব সাধারণ নির্বাচনের হিসাবকে সামনে রেখে অপেক্ষাকৃত তরুণ কাউকে বেছে নিতে আগ্রহ প্রকাশ করে কি না, তা এখন দেখার বিষয়। সেটা করতে না পারলে অক্টোবরের নির্বাচনে বিপর্যয় এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব না–ও হতে পারে বলে অনেকেই মনে করছেন।