জাপানে করোনার মধ্যেই অলিম্পিক ঘিরে দোলাচল

করোনাভাইরাস মহামারি এখনো বিদায় নেয়নি। জাপানে গতকাল শনিবারের হিসাব, শুধু রাজধানী টোকিওতেই ২২৬ জন নতুন করে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। এক দিন আগে এ সংখ্যা ছিল ১৮৭। এ নিয়ে জাপানের রাজধানীতে সব মিলিয়ে করোনায় সংক্রমিত লোকজনের সংখ্যা এ পর্যন্ত ২২ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। তবে তারপরও করোনা যেন ধীরে মূল আলোচনার বাইরে সরে যেতে শুরু করেছে। দৈনিক সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় এখন আর করোনার নিয়মিত উপস্থিতি সেভাবে দেখা যায় না। টেলিভিশন সংবাদের অবস্থাও একই রকম। কেন এমন হচ্ছে, তার অবশ্য একাধিক কারণ আছে।

অনেকেই বলছেন, প্রায় সাত মাস ধরে চলা করোনার দাপটে মানুষ এখন ক্লান্ত, অবসন্ন। অন্য কিছু নিয়ে তাঁরা এখন কথা বলতে চাইছেন, অন্য কিছু তাঁরা এখন দেখতে আর শুনতে চাইছেন। ফলে এ অবস্থা অনেকটা যেন ভাগ্যের হাতে নিজেকে সঁপে দেওয়া। অর্থাৎ করোনা থেকে গেলেও এর আশঙ্কা নিয়ে মানুষ আর আগের মতো উদ্বিগ্ন নন।

দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, করোনার সঙ্গে বসবাস মানুষের শিখে যাওয়া। করোনাভাইরাসের চিকিৎসা নেই বলে শুরুতে বলা হলেও টিকা আবিষ্কার না হওয়া সত্ত্বেও মৃত্যুর সংখ্যা ক্রমে কমছে। প্রচলিত চিকিৎসাব্যবস্থার মধ্যেই করোনার নিরাময় রয়ে গেছে, এমনটি মনে করা হচ্ছে। আর এ কারণেই আক্রান্ত হলেও মানুষ এখন মারা যাচ্ছেন আগের চেয়ে অনেক কম। ফলে একধরনের নিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে মানুষের চিন্তাভাবনায়। আর এ ভাবনা মানুষের মনোবল চাঙা করে তুলছে।

এর বাইরে সর্বশেষ কারণ হলো, মানুষের মনে বেপরোয়া ভাব চলে আসা। এর পেছনেও আছে রোগের দীর্ঘ সময় ধরে উপস্থিতি বজায় থাকা। সামাজিক জীব মানুষ সমাজ থেকে দূরে সরে থাকাকে এখন আর বেঁচে থাকার বিকল্প হিসেবে দেখছেন না; বরং এটাকে গণ্য করছেন স্বাভাবিক জীবনের পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিবন্ধকতা হিসেবে। যেটাকে অবজ্ঞা করলেও ক্ষতি নেই। ফলে যেকোনো আলোচনার মূল বিষয় হিসেবে করোনার এখন আর নেই দাপট দেখানো উপস্থিতি। তবে তাই বলে যে করোনা একেবারেই আলোচনায় নেই, তা কিন্তু নয়। করোনা আছে পরোক্ষে হলেও, যেমনটা দেখা গেছে স্থগিত হয়ে যাওয়া ২০২০ অলিম্পিক নিয়ে সাম্প্রতিক কিছু মন্তব্য ও কথাবার্তায়।

করোনার কারণেই আধুনিক অলিম্পিকের ইতিহাসে নজিরবিহীন এক পদক্ষেপ নিতে হয়েছে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি (আইওসি) ও ২০২০ টোকিও অলিম্পিকের আয়োজক কমিটিকে। ভেন্যু ঠিক রেখে অলিম্পিকের আয়োজন তারা এক বছর পিছিয়ে দিয়েছে। তবে তা সত্ত্বেও নতুন সময়সূচি অনুযায়ী অলিম্পিক আদৌ অনুষ্ঠিত হতে পারবে কি না, সেই প্রশ্নের কিন্তু নিষ্পত্তি হয়নি। ফলে বাজারজুড়ে আছে নানা রকম আলাপ-আলোচনা, বাতাসজুড়ে কল্পনার গুঞ্জন। কেউ বলছেন, অলিম্পিক যে হবেই না, সেটা তাঁরা ধরে নিয়েছেন। অন্যরা আবার সীমিত আকারের অলিম্পিক গেমসের কথা বলছেন। বিষয়টি নিয়ে আয়োজকদের ভেতর থেকে প্রথম মন্তব্য করতে শোনা যায় আইওসির ভাইস প্রেসিডেন্ট জন কোটসকে। গত সোমবার বার্তা সংস্থা এএফপিকে তিনি বলেছেন, করোনা থাকুক বা না থাকুক, ২০২০ টোকিও অলিম্পিক সময়মতো অনুষ্ঠিত হবে। কোটস একই সঙ্গে ২০২০ টোকিও অলিম্পিকের জন্য আইওসির সমন্বয় কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করায় তাঁর মন্তব্য যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে। কোটস আরও বলেছেন, এই গেমস হবে করোনাভাইরাসকে জয় করার গেমস এবং সুড়ঙ্গের শেষে আলোর দেখা তিনি পাচ্ছেন। তবে সেই আলো ঠিক কোথা থেকে আসা, তার ব্যাখ্যা তিনি না দিলেও তাঁর এ মন্তব্যের পরপরই ২০২০ টোকিও অলিম্পিকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যরাও একই সুরে কথাবার্তা বলতে শুরু করেছেন।

আইওসি কর্মকর্তা ফরাসি বার্তা সংস্থার সামনে তাঁর অভিমত তুলে ধরার এক দিন পর জাপানের মন্ত্রিসভার টোকিও অলিম্পিকের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী সেইকো হাশিমোতো কথা বলেছেন। হাশিমোতো বিশ্বাস করেন, যেকোনো মূল্যে পরিবর্তিত সময়সূচি অনুযায়ী ২০২০ টোকিও অলিম্পিক অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত।

জাপানে অলিম্পিকের জন্য নতুন নির্মাণ করা স্টেডিয়াম
ছবি: এএফপি

টোকিওর গভর্নর ইয়ুরিকো কোইকেও এর ঠিক পরপর বলেছেন, তিনিও মনে করেন, যেকোনো উপায়েই হোক না কেন, আগামী বছর ২০২০ টোকিও অলিম্পিক অবশ্যই অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত। নেতৃত্বের পর্যায়ে আগামী বছর অলিম্পিকের আয়োজন নিয়ে দৃঢ়তা আছে। তবে জাপানের জনগণ কিন্তু অলিম্পিকের সম্ভাবনা ঠিক ততটা আস্থার সঙ্গে যাচাই করে দেখছেন না। সাম্প্রতিক কিছু জনমত জরিপে জাপানে অলিম্পিক নিয়ে জনসাধারণের মধ্যে উৎসাহে ভাটা পড়া লক্ষ করা গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, জাপানে প্রতি চারজনে মাত্র একজন মনে করেন যে আগামী বছর অলিম্পিক অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত।

এদিকে অলিম্পিকের আয়োজন সহজ করে তুলতে জাপান সরকার খেলাধুলার অনুষ্ঠানে দর্শকসংখ্যা সীমিত রাখা নিয়ে আরোপিত নিয়ন্ত্রণ শিথিল করে নেওয়ার চিন্তাভাবনা করছে। করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে সরকারের আরোপিত নিয়ন্ত্রণে নির্দিষ্ট কোনো ভেন্যুতে পাঁচ হাজারের বেশি দর্শকের উপস্থিতির অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। নিয়ন্ত্রণ অলিম্পিক পর্যন্ত বজায় থাকলে, আন্তর্জাতিক ক্রীড়া উৎসবের চাকচিক্য অনেকটাই তা ম্লান করে দেবে। আবার আর্থিক দিক থেকেও আয়োজকদের বিরাট ক্ষতির মুখোমুখি হতে হবে। সেই আশঙ্কা এড়িয়ে যেতে সরকার এখন কিছুদিনের মধ্যেই দর্শক নিয়ন্ত্রণ নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করছে।

করোনাভাইরাস বিদায় না নেওয়া সত্ত্বেও অলিম্পিকের আয়োজন নিয়ে নানা দিক থেকে ইতিবাচক মন্তব্য শোনা গেলেও আইওসির প্রেসিডেন্ট টমাস বাখ শেষ পর্যন্ত কিছুটা সতর্ক মন্তব্য করেছেন। আর তা নিয়ে টোকিও অলিম্পিককে ঘিরে দেখা দেওয়া অনিশ্চয়তা যেন দূর হয়েও হচ্ছে না। সুইজারল্যান্ডের লুজানে বুধবার আইওসির নির্বাহী বোর্ডের বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে বাখ বলেছেন, টিকা আবিষ্কারে অগ্রগতি এবং ভাইরাস শনাক্তের পরীক্ষা ত্বরান্বিত করার মধ্যে পুনর্নির্ধারিত সময়ে অলিম্পিক অনুষ্ঠিত হবে কি না, সেই প্রশ্নের সম্পূর্ণ উত্তর নেই। পরিবর্তিত সময়সূচি ঠিক রেখে অলিম্পিকের আয়োজন করতে হলে করোনাভাইরাসের কারণে দর্শকবিহীন অলিম্পিক হবে কি না, সেই প্রশ্নের জবাবে টমাস বাখ কিছুটা বিমূর্ত উত্তর দিয়েছেন। তাঁর কথা, ‘অনিশ্চিত এই সময়ে আগামীকাল আমাদের এই পৃথিবী দেখতে কেমন হবে, তা আমাদের জানা নেই। ফলে আজ থেকে ৩২০ দিন পর পৃথিবী কেমন হবে, সেটা আপনারা কীভাবে আমাদের কাছে জানতে চাইছেন?’

আইওসি প্রধানের এ মন্তব্য অলিম্পিক নিয়ে দেখা দেওয়া আশায় কিছুটা হলেও শীতল পানি ঢেলে দিয়েছে। তারপরও টোকিওর আয়োজকেরা মনে করছেন, পরিস্থিতির উন্নতি দ্রুতই দেখা যাবে এবং স্থগিত হয়ে যাওয়া টোকিও অলিম্পিকও দর্শকের উপস্থিতিতেই অনুষ্ঠিত হবে। করোনাভাইরাসের আঘাতে পিছিয়ে যাওয়া ২০২০ টোকিও অলিম্পিক নতুন নির্ধারিত সময়ে অনুষ্ঠিত হোক বা না হোক, ভাইরাস কিন্তু ইতিমধ্যে অলিম্পিকের ওপর ভিন্ন দিক থেকে বড় এক আঘাত হেনেছে। ২০১৬ রিও অলিম্পিকের সমাপনী অনুষ্ঠানে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে জনপ্রিয় ভিডিও গেমসের চরিত্র সুপার মারিওর বেশে উপস্থিত হয়ে সবাইকে চার বছর পর টোকিওতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। আবে আশা করছিলেন, ২০২০ অলিম্পিক তাঁর নিজের জন্য হবে আরেকটি মাইলফলক। তবে স্বাস্থ্যগত কারণে ক্ষমতা থেকে তাঁকে সরে দাঁড়াতে হওয়ায় সুপার মারিওর বেশে আবে এখন আর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে অতিথি আর দর্শকদের স্বাগত জানাতে সক্ষম হবেন না। এটুকু অন্তত করোনাভাইরাস ইতিমধ্যে নিশ্চিত করে দিতে পেরেছে।