তুরস্ক কেন কাবুল বিমানবন্দরের দায়িত্ব চায়

হামিদ কারজাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরছবি: রয়টার্স

আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সব সেনা প্রত্যাহার শুরুর পর থেকে দেশটিতে তালেবানের হামলা বেড়েই চলেছে। এতে আফগান বাহিনীর সঙ্গে তালেবানের লড়াইও তীব্র হয়েছে। এরই মধ্যে তালেবানের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, তারা দেশটির ৮৫ শতাংশ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে। গত শুক্রবার থেকে ৬ দিনে ৯টি প্রাদেশিক রাজধানী দখল করেছে তারা।

এই অবস্থায় বহির্বিশ্বের সঙ্গে দেশটির মূল প্রবেশদ্বার রাজধানী কাবুলের হামিদ কারজাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান থেকে মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনী বিদায় নেওয়ার পর ওই বিমানবন্দর সচল রাখতে এবং সুরক্ষা দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে তুরস্ক। এ নিয়ে একটি প্রস্তাবও যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তুলে ধরেছে আঙ্কারা।

তবে তুরস্ক যে হঠাৎ করেই এ প্রস্তাব দিয়েছে, এমনটা নয়। ছয় বছর ধরে আঙ্কারা ন্যাটোর নেতৃত্বাধীন প্রশিক্ষণ, উপদেশ ও সহযোহিতা বিষয়ক মিশনের অংশ হিসেবে কাবুলের ওই বিমানবন্দরে সামরিক ও লজিস্টিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে।

আফগানিস্তানে বর্তমানে ৫০০ তুর্কি সেনা রয়েছে। কিন্তু তারা সরাসরি সম্মুখযুদ্ধে যুক্ত নয়। তাদের কাজ ছিল কাবুলের ওই বিমানবন্দরের সামরিক শাখার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং আফগানিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া।

বিমানবন্দরটি বিশাল সামরিক ঘাঁটি হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু বিমানবন্দরটির নিরাপত্তা দেওয়ার সক্ষমতা আফগান সরকারের নিজের নেই। ২০০২ সাল থেকে বিমানবন্দরের এয়ার ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করছেন ন্যাটো সামরিক কর্মকর্তারা। দেশজুড়ে তালেবান ও আল-কায়েদাবিরোধী সামরিক অভিযানের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে বিমানবন্দরটি ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। তাই বিমানবন্দরটির নিরাপত্তা শুধু সামরিক বাহিনীর জন্যই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি এমন নয়, আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বেসরকারি মানবিক সহায়তা প্রদানকারী সংস্থারগুলোর কার্যক্রম চালানোর জন্য জরুরি।

বিমানবন্দরটির নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন কয়েকটি দেশ এরই মধ্যে সেখান থেকে তাদের দূতাবাস গুটিয়ে নেওয়ার কথা ভাবছে।

আফগানিস্তান থেকে সব সেনা প্রত্যাহারের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র তার ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘ যুদ্ধের অবসান ঘটাবে
ফাইল ছবি : রয়টার্স

কাবুলে থাকা ফ্রেডরিখ ইবার্ট ফাউন্ডেশনের পরিচালক মাগদালেনা ক্রিচনার আরব নিউজকে বলেছেন, ‘আমি মনে করি, মার্কিন বাহিনীর অনুপস্থিতিতে পুরো নিরাপত্তা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি ঘটবে। এমনকি বিমানবন্দরও হামলার শিকার হতে পারে।

গত জুন মাসের প্রথম দিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর শীর্ষ নেতাদের বৈঠক হয়। এরপর তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান হামিদ কারজাই বিমানবন্দরের নিরাপত্তা দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন।

ন্যাটো বাহিনীতে একমাত্র মুসলিম দেশ তুরস্ক। আফগানিস্তানের ওপর দেশটির দীর্ঘদিনের কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে। এই দুই দেশের মধ্যেই যে শুধু ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও নৃতাত্ত্বিক সম্পর্ক রয়েছে তা নয়, তালেবানের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক পাকিস্তানের সঙ্গেও তাদের একই ধরনের সখ্য রয়েছে। অতীতে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে গঠনমূলক আলোচনার পরিবেশ তৈরি করতে তুরস্ক কয়েকবার দেশ দুটির সরকারের মধ্যে শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজন করেছে।

আফগানিস্তানে কয়েক দশক ধরে চলা যুদ্ধের সমাপ্তি টানতে তুরস্ক বিভিন্নভাবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে বা বহুমুখী প্রচেষ্টা চালাছে, পাশাপাশি তালেবানসহ বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক এবং রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে এরদোয়ানের সরকার।

তালেবান এরই মধ্যে জানিয়ে দিয়েছে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বরের শেষে আফগানিস্তানে তুর্কি সেনাদের উপস্থিতি দেখতে চায় না।

আফগানিস্তানে বর্তমানে ৫০০ তুর্কি সেনা রয়েছে। কিন্তু তারা সরাসরি সম্মুখযুদ্ধে যুক্ত নয়। তাদের কাজ ছিল কাবুলের ওই বিমানবন্দরের সামরিক শাখার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং আফগানিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া। সরাসরি যুদ্ধে অংশ না নেওয়ার কারণেই ন্যাটোভুক্ত অন্যান্য দেশের তুলনায় তুরস্কের সঙ্গে তালেবানের তুলনামূলক ভালো সম্পর্ক রয়েছে। সম্প্রতি কাবুল ও তালেবানের মধ্যে শান্তি আলোচনার আয়োজনও করছে তুরস্ক। যদিও তালেবান এরই মধ্যে জানিয়ে দিয়েছে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বরের শেষে আফগানিস্তানে তুর্কি সেনাদের উপস্থিতি দেখতে চায় না।

আফগানিস্তানের সবচেয়ে বড় অনলাইন নিউজ সার্ভিস খামা প্রেস নিউজ এজেন্সি তালেবানের কাতার অফিসের বর্তমান মুখপাত্র সুহাইল শাহীনের একটি বিবৃতির বরাত দিয়ে একটি খবর প্রকাশ করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, বিমানবন্দরে দায়িত্ব নেওয়ার বিষয়ে তুরস্কের সিদ্ধান্তের নিন্দা জানিয়েছে তালেবান।

ন্যাটো শীর্ষ সম্মেলনে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সরাসরি বৈঠক করেন। ব্রাসেলস, বেলজিয়াম, ১৪ জুন, ২০২১
ছবি: রয়টার্স

বিবৃতি আরও বলা হয়, ২০ বছর ধরে তুরস্ক ন্যাটোর বাহিনীর অংশ হিসেবে এখানে রয়েছে। ২০২০ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি কাতারের রাজধানী দোহায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যে চুক্তি হয়, সেই অনুযায়ী তাদেরও (তুরস্ক) সেনা প্রত্যাহার করে নেওয়া উচিত। তিনি আরও বলেন, ‘তুরস্ক একটি বড় মুসলিম দেশ। আফগানিস্তানের সঙ্গে তাদের ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। ভবিষ্যতে দেশের নতুন ইসলামিক সরকারের অংশ হিসেবে তাদের সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠতা ও সুসম্পর্ক বজায় থাকবে।’

তুরস্ক কি কেবল ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক কারণেই আফগানিস্তানকে নিরাপত্তা দিতে চাইছে। ব্যাপারটা মনে হয় অতটা সরল নয়। কারণ, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান খোলাখুলি বলেছেন, তাঁর ইচ্ছা, মুসলিম বিশ্বে তুরস্কের প্রভাব বৃদ্ধি করা।

তবে তুরস্ক তাদের মিত্রদেশ পাকিস্তান ও কাতারের মাধ্যমে তালবানের কাছে বার্তা পাঠাচ্ছে যে তাদের ওই হুমকি থেকে সরে যেতে চাপ তৈরি করছে। তুরস্ক এ বিষয়ে তালবানের সঙ্গে সরাসরি কথা বলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। তবে বিশ্লেষকদের মত, তালেবান না চাইলে তুরস্ক সেখানে থাকতে পারবে না।

তুরস্কের সাবেক ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী ও আফগানিস্তানে নিযুক্ত ন্যাটোর সাবেক জ্যেষ্ঠ বেসামরিক প্রতিনিধি হিকমত সেটিন কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল–জাজিরাকে বলেন, তালেবান অনেক পাল্টে গেছে বলে দাবি করলেও তা কতটা, সেই উত্তর নেই। তিনি আরও বলেন, যেখানে তালেবানের রাজনৈতিক শাখা ঐকমত্যের ভিত্তিতে সমাধানের পক্ষে, সেখানে সামরিক শাখা সামরিক বিজয়ের পেছনে ছুটছে। তিনি বলেন, আফগানিস্তানের সমর্থন প্রয়োজন পড়বেই। পাশাপাশি দেশটিতে যে সরকারই আসুক না কেন, তাদের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাগবে। এটি এখনো অস্পষ্ট যে আফগানিস্তানে কট্টরপন্থীরা ক্ষমতায় এলে বিদেশি মিশনগুলো থাকবে কি না। কিন্তু একটি সচল বিমানবন্দর সবার জন্যই প্রয়োজন।

আফগানিস্তানকে ‘বোন’ মনে করে তুরস্ক। দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী হুলুসি আকর বলেন, ‘বিমানবন্দরটি অবশ্যই খোলা এবং চালু রাখতে হবে। এটি যদি চালু না থাকে, তাহলে দূতাবাসগুলো অন্যত্র গুটিয়ে নিতে হবে। আর এটি হলে আফগানিস্তান একা হয়ে যাবে।’ তিনি বলেন, আফগানিস্তানের শান্তি, স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে যা করণীয়, সব করা হবে। তবে প্রয়োজনীয় শর্তগুলো পূরণ হলেই তুরস্ক কাবুলের ওই বিমানবন্দরের দেখভালের দায়িত্ব নেবে।

তালেবান যোদ্ধারা ৬ দিনে দখল করে নিয়েছে ৯টি প্রাদেশিক রাজধানী
ছবি: রয়টার্স

গত জুনের শেষ সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সামরিক দপ্তর পেন্টাগনের একটি প্রতিনিধিদল আঙ্কারায় বৈঠক করে। ওই বৈঠকের পর এরদোয়ান বলেন, কাবুলের ওই বিমানবন্দরের সুরক্ষা দেওয়া এবং পরিচালনায় যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে কূটনৈতিক, লজিস্টিক ও আর্থিক সহায়তা চাওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে তুরস্ক পাকিস্তান ও হাঙ্গেরিকেও যুক্ত করতে চায়।

এ নিয়ে এখন আলোচনা চলমান। তবে তুরস্ক কি ন্যাটোর বাহিনীর হিসেবে, নাকি স্বতন্ত্র হিসেবে যেমনটা লিবিয়া, সিরিয়া বা ইরাকে আছে, তেমনভাবে আফগানিস্তানে থাকতে চায়, তা এখনো স্পষ্ট নয়। অবশ্য গত মাসের প্রথম সপ্তাহে পেন্টাগন এক পৃথক বিবৃতিতে জানিয়েছে, আফগানিস্তানে থাকা মার্কিন কূটনীতিকদের নিরাপত্তায় কিছু মার্কিন সেনা দেশটিতে থাকবে। একই সঙ্গে কাবুল বিমানবন্দরকে কীভাবে সুরক্ষা দেওয়া যায়, তা নিয়ে তুরস্কের সঙ্গে আলোচনা চলছে।

আর তুরস্কের সরকারপন্থী গণমাধ্যম ডেইলি সাবাহর খবরে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান সম্প্রতি বলেন, ন্যাটো সম্মেলনে বাইডেন ও এরদোয়ান একমত হয়েছেন যে ন্যাটো বাহিনী বিদায় নেওয়ার পর তুরস্ক কাবুল বিমানবন্দরের নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

গত বছরের ১২ সেপ্টেম্বর দোহায় আফগান সরকারের সঙ্গে বৈঠকে তালেবান প্রতিনিধিরা
ছবি: রয়টার্স

তুরস্কের আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক অধ্যাপক মেসুত হাক্কি কাসিন আল-জাজিরাকে বলেন, তুরস্ক ও তালেবান এই বিষয়ে একমত হবে যে ‘কূটনীতিতে অসম্ভব বলে কিছু নেই’। তাঁর যুক্তি হলো, সম্প্রতি ন্যাটোর নেতাদের শীর্ষ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে তুরস্ক ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র হলো পরাশক্তি, তুরস্ক নয়। নিজেদের অন্যতম স্বার্থেই তুরস্ক এখানে থাকতে চাইবে।

তুরস্কের এখানে থাকার মূল কারণ হলো ওয়াশিংটনকে খুশি করা উল্লেখ করে হিকমত সেটিন বলেন, এখানে তারা আফগানিস্তানকে নিয়ে আলোচনা করছে। অথচ আফগানিস্তান সরকার বা তালেবানের উপস্থিতি নেই।

নাম না প্রকাশের শর্তে তুরস্কের একটি সেনা সূত্র আল–জাজিরাকে জানায়, তুরস্কের বাহিনী আফগানিস্তানে আরও দুই বছর থাকতে পারবে। এরপর তাদের কী হবে, তার কোনো রূপরেখা নেই।

এখন কথা হলো, তুরস্ক কি কেবল ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক কারণেই আফগানিস্তানকে নিরাপত্তা দিতে চাইছে। ব্যাপারটা মনে হয় অতটা সরল নয়। কারণ, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান খোলাখুলি বলেছেন, তাঁর ইচ্ছা, মুসলিম বিশ্বে তুরস্কের প্রভাব বৃদ্ধি করা। এরই মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে তাঁর শাসনামলে মিডিয়া ও শিক্ষা প্রকল্পের মাধ্যমে তুরস্কের প্রভাব উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। উদাহরণ, ইরতু রুল নামের একটি নাটক পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে, যার মধ্য দিয়ে তুরস্কের প্রতি মানুষের জনপ্রিয়তা বেড়েছে।

২০১৯ সালের জুলাইয়ে আঙ্কারা রাশিয়ার কাছ থেকে এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা কেনে, যা মূলত ন্যাটোর সামরিক সরঞ্জামকে আঘাত করতে সক্ষম। তুরস্কের এই ব্যবস্থা কেনার কারণে ন্যাটোর অন্য সদস্যদেশগুলোর নিরাপত্তা হুমকির মুখে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

তা ছাড়া সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আঙ্কারা সৌদি আরবকে ‘কোণঠাসা’ করতে অনেকগুলো বিদেশ নীতি গ্রহণ করেছে। এর মধ্য দিয়ে তুরস্ক সুন্নি মুসলিম বিশ্বে নতুন নেতা হিসেবে আবির্ভূত হতে চাইছে। দেশটি আঞ্চলিক লড়াই, যেমন সিরিয়ায় সৌদি এবং তার মিত্রদেশগুলোর বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেয়। এবং কাতারের ওপর অবরোধ আরোপ থেকে শুরু করে সাংবাদিক জামাল খাসোগির হত্যাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ইস্যুতে রিয়াদের সমালোচনা করে আসছে। ভূরাজনৈতিকভাবে নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে যুক্তরাষ্ট্র–পরবর্তী আফগানিস্তানে তুরস্ক নিজেদের অবস্থান অব্যাহত রাখতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মার্কিন বাহিনীর বিদায়ের পর এরদোয়ান মুসলিম বিশ্বে সৌদি আরবের নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে নিজেদের সক্ষমতা তুলে ধরতে চান।

সিঙ্গাপুরের এস. রাজারত্নম স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের রিচার্স ফেলো আবদুল বাসিত ও অস্ট্রেলিয়ার ডেকিন ইউনিভার্সিটির আলফ্রেড ডেকিন ইনস্টিটিউট ফর সিটিজেনশিপ অ্যান্ড গ্লোবালাইজেশনের রিসার্চ ফেলো জাহিদ শাহাব আহমেদ যৌথভাবে আল–জাজিরার মতামত কলামে লিখেছেন, মার্কিন বাহিনীর বিদায়ের পর আফগানিস্তানে তুরস্ক তাদের সক্রিয়তা ধরে রাখতে পারলে ন্যাটোর দেশগুলোতে তাদের গুরুত্ব বাড়বে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের টানাপোড়েনের উন্নতি হবে বলে মনে হচ্ছে।

আফগানিস্তান থেকে মার্কিন বাহিনী প্রত্যাহারের ঘোষণার পর থেকে দেশটিতে সংঘাতের ঘটনা বেড়েই চলেছে। ৪ আগস্ট কাবুলে রাতের বেলা গাড়ি বোমা বিস্ফোরণ ঘটে
ছবি: রয়টার্স

২০১৯ সালের জুলাইয়ে আঙ্কারা রাশিয়ার কাছ থেকে এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা কেনে, যা মূলত ন্যাটোর সামরিক সরঞ্জামকে আঘাত করতে সক্ষম। তুরস্কের এই ব্যবস্থা কেনার কারণে ন্যাটোর অন্য সদস্যদেশগুলোর নিরাপত্তা হুমকির মুখে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এই কেনাকাটার ঘটনায় নিজেদের নাখোশ ভাব বোঝাতে যুক্তরাষ্ট্র তুরস্কের ওপর অবরোধ আরোপ করে। সিরিয়ায় কুর্দি বাহিনীর প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন রয়েছে। অথচ তুরস্ক এই বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে। আবার ২০১৬ সালে এরদোয়ানকে ক্ষমতাচ্যুত করতে সামরিক অভ্যুত্থানচেষ্টার নেপথ্যকারীদের তুরস্কের হাতে তুলে দিতে বারবার আহ্বান জানানো হলেও যুক্তরাষ্ট্র তা প্রত্যাখ্যান করে আসছে। এসব নিয়ে দুদেশের মধ্যে একটা টানাপোড়েন চলছে।

আবদুল বাসিত ও জাহিদ শাহাব আহমেদের মতে, কাবুল বিমানবন্দরকে স্বেচ্ছায় নিরাপত্তা প্রদানের মধ্য দিয়ে দেশটিতে পরোক্ষভাবে ন্যাটো বাহিনীর উপস্থিতি বজায় থাকছে। তুরস্ক আশা করছে, এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের উন্নতি হবে।
২০১৪ সালে ন্যাটো বাহিনীর বেশির ভাগ সেনা প্রত্যাহারের পরও আফগানিস্তানে তুরস্কের উপস্থিতি ছিল। ন্যাটোর রেজ্যুলুট সাপোর্ট প্রশিক্ষণ মিশনের মধ্য দিয়ে তুরস্কের এই উপস্থিতি আফগানিস্তানে নিজেদের গুরুত্ব বাড়াতে সহায়তা করেছে। তুরস্ক আশা করছে, এবারও মার্কিন বাহিনীর অনুপস্থিতিতে তারা একইভাবে সফল হবে।
তা ছাড়া ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর জন্য কাবুলের ওই বিমানবন্দরের কৌশলগত গুরুত্ব রয়েছে। এর মধ্য দিয়ে ভবিষ্যতে ন্যাটোর কূটনৈতিক উপস্থিতি থাকবে। আর তুরস্ক যদি এটি করতে পারে, তাহলে নিঃসন্দেহে অন্যান্য দেশের কাছে তুরস্কের মর্যাদা বাড়বে।