দণ্ডিতরা প্রকাশ্যে ঘুরছেন, নারী আইনজীবী-বিচারকেরা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন

২৭ বছর বয়সী আফগান প্রসিকিউটর ফারিশতা (ছদ্মনাম) এখন আত্মগোপনে আছেন
ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত ফারিশতা (ছদ্মনাম) আফগানিস্তানের প্রভাবশালী প্রসিকিউটর ছিলেন। অপরাধী, তালেবান জঙ্গি, দুর্নীতিগ্রস্ত আমলা ও নারী-শিশু নির্যাতনকারী পুরুষদের বিচারের আওতায় এনেছিলেন তিনি।

২৭ বছর বয়সী ফারিশতা এখন আত্মগোপনে আছেন। একজন পলাতক আসামি যেভাবে পালিয়ে বেড়ান, ফারিশতার অবস্থাও তেমন। তিনি অহরহ তাঁর অবস্থান পরিবর্তন করছেন। নিরাপত্তার জন্য তাঁর আসল নাম গোপন করে ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়েছে।

বিবিসি অনলাইনের বিশেষ এক প্রতিবেদনে বলা হয়, আফগানিস্তানের দক্ষিণ-পূর্ব পাকতিয়া প্রদেশের অধিবাসী ফারিশতা। ২০০১ সালে তালেবানের পতনের পরের সময়ে যেসব আফগান নারী পেশাগত সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হন, তাঁদের মধ্যে ফারিশতা একজন। তিনি আইন পেশার মাধ্যমে আফগানিস্তানের পুরুষশাসিত ও অতিরক্ষণশীল সমাজকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন।

বছর কয়েক আগে আফগানিস্তানের তৎকালীন আশরাফ গনি সরকারের অধীনে দেশটির অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসের প্রসিকিউটর হয়েছিলেন ফারিশতা।

আফগানিস্তানের একটি নিরাপদ স্থান থেকে ফারিশতা বিবিসিকে বলেন, ধর্ষণ, হত্যা ও পারিবারিক সহিংসতার জন্য অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করার পাশাপাশি সাজা নিশ্চিত করাই ছিল তাঁর পেশাগত কাজের অংশ। কাজটি ফারিশতার জন্য চ্যালেঞ্জিং ছিল বটে, কিন্তু এ কাজ তাঁকে প্রশান্তি এনে দিত।

গত ১৫ আগস্টের আগের মাসগুলোয় তালেবান আফগানিস্তানের একের পর এক এলাকা দখল করে। এ সময় তারা হাজার হাজার দুর্ধর্ষ অপরাধী, জঙ্গিসহ অনেক বন্দীকে কারাগার থেকে মুক্ত করে দেয়।

তালেবান যাঁদের কারাগার থেকে ছেড়ে দিয়েছে, তাঁদের মধ্যে মোহাম্মদ গুল অন্যতম। তিনি একাধিক আত্মঘাতী বোমা হামলার পরিকল্পনার অভিযোগে অভিযুক্ত।

প্রসিকিউটর হিসেবে ফারিশতা অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে গুলের বিরুদ্ধে অকাট্য তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করেন। তিনি গুলকে সফলভাবে বিচারের মুখোমুখি করেছিলেন। তাঁকে কারাগারে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলেন ফারিশতা।

১৫ আগস্ট রাজধানী কাবুলের পতন হয়। আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় তালেবানের হাতে। এ ঘটনার কয়েক দিন পরই ফারিশতাকে ফোন করেন গুল।

ফারিশতা বলেন, ‘গুল আমাকে বলেছিলেন যে তিনি আমার ওপর প্রতিশোধ নিতে আসছেন। আমি যেখানেই লুকিয়ে থাকি না কেন, রেহাই পাব না।’

গুলের এমন হুমকির পর থেকে ফারিশতা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। প্রসিকিউটর হিসেবে তাঁর বেতন নেই, নেই আয়ের অন্য কোনো উপায়। এই দুর্বিষহ অবস্থার ঠিক কীভাবে অবসান ঘটবে, তা-ও জানেন না তিনি। এ কারণে ফারিশতাকে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে দিন কাটাতে হচ্ছে।

ফারিশতা ও তাঁর সহকর্মীদের ভাষ্য, আফগানিস্তানে প্রসিকিউটর ও বিচারক হিসেবে নারীদের কাজ করার বিরুদ্ধে তালেবান। তারা বেশির ভাগ নারীকে কর্মক্ষেত্র থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চায়, যেমনটি তালেবান তাদের আগের শাসনামলে করেছিল।

ফারিশতার মতো নারীরা যে ভয় পাচ্ছেন, এর পেছনে যথেষ্ট ও যৌক্তিক কারণ রয়েছে।
তালেবানের ক্ষমতা দখল আসন্ন—এমন আশঙ্কার মধ্যে চলতি বছরের জানুয়ারিতে আফগান সুপ্রিম কোর্টের দুই নারী বিচারককে কাবুলে গুলি করে হত্যা করা হয়। এটা ছিল ‘টার্গেট কিলিং’। এই হত্যাকাণ্ডের জন্য তালেবানকে দায়ী করা হয়।

আশরাফ গনির সরকারের সময় আফগান বিচার মন্ত্রণালয়ে কাজ করতেন—এমন দুজন আইন কর্মকর্তাকে সম্প্রতি কাবুলে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ড প্রতিশোধমূলক ছিল বলে ধারণা করা হয়।

তালেবান ক্ষমতা দখলের পর দেশটির সব সরকারি কর্মীর জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে। কিন্তু তা সত্ত্বেও দেশটিতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও অপহরণের মতো ঘটনা ঘটে চলছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা এসব তথ্য জানিয়েছে।

আগস্টে আফগানিস্তানের ক্ষমতা তালেবানের হাতে যাওয়ার পর দেশটির কয়েক শ নারী বিচারক আত্মগোপনে চলে যান। মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোট চূড়ান্তভাবে আফগানিস্তান ছাড়ার সময় দেশটির অনেক নারী বিচারক দেশত্যাগের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। যাঁরা আফগানিস্তান ছাড়তে পেরেছেন, তাঁরা বেঁচে গেছেন। আর যাঁরা যেতে পারেননি, তাঁরা আফগানিস্তানে তাঁদের ভাগ্যের নির্মম পরিণতি ভোগ করার অপেক্ষায় আছেন।

তালেবান ক্ষমতা দখলের পর হাজারো বন্দীকে কারাগার থেকে মুক্ত করে দিয়েছে
ছবি: রয়টার্স

আফগানিস্তানের পারওয়ান প্রদেশের এক নারী বিচারক তাঁর অভিজ্ঞতার কথা জানাতে গিয়ে বলেন, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে তালেবান ও তাদের সহযোগীদের কাছ থেকে অনেক ফোন পেয়েছি। পেয়েছি হুমকি-ধমকি।’

পারওয়ান প্রদেশের এই নারী বিচারক সৌভাগ্যক্রমে দেশ ছাড়তে সক্ষম হয়েছেন। তিনি এখন যুক্তরাজ্যে আছেন।

২০১৮ সালে আফগান বিচার বিভাগে যোগ দেন এই নারী বিচারক। তিনি বলেন, তাঁর সম্পত্তিসহ সব জিনিস তালেবান জব্দ করেছে। এখন আফগানিস্তানে থাকা তাঁর আত্মীয়স্বজন তালেবানের হাতে নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন।

এই নারী বিচারক বলেন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আফগান নারী বিচারকেরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছিলেন। এখন তাঁরা যদি দেশ ছেড়ে চলে যান, তাহলে আফগান বিচার বিভাগের জন্য একটা বড় শূন্যতা তৈরি হবে।

আফগানিস্তানে এখনো প্রায় ২৩০ জন নারী বিচারক আত্মগোপনে আছেন বলে জানায় বিবিসি।

একাধিক আফগান নারী বিচারক ও তাঁদের পক্ষের অধিকারকর্মীর সাক্ষাৎকার নিয়েছে বিবিসি। এই সাক্ষাৎকারে পাওয়া তথ্যের আলোকে বিবিসি বলছে, আফগান নারী বিচারকদের ছেড়ে যাওয়া বাসভবনগুলোয় তালেবান তল্লাশি চালিয়েছে। বাসভবনগুলোয় ভাঙচুর চালানো হয়েছে। তাঁদের আত্মীয়স্বজনকে হুমকি-ধমকি দেওয়া হচ্ছে।

আগস্টে আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় তালেবানের হাতে
ছবি: রয়টার্স

অলাভজনক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব উইমেন জাজেসের (আইএডব্লিউজে) যুক্তরাজ্য প্রতিনিধি বিচারক আনিসা ধনজি বলেন, নারী বিচারক ও আইনজীবীদের ক্যারিয়ার শেষ। তাঁদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়েছে। নারী হিসেবে আফগানিস্তানে তাঁদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।

কাবুলে লুকিয়ে থাকা একজন আফগান নারী বিচারক আইএডব্লিউজেকে বলেন, সন্ত্রাসবাদের দায়ে তিনি এক আসামিকে দণ্ড দিয়েছিলেন। কিন্তু তালেবান তাঁকে মুক্তি দিয়েছে। মুক্তি পেয়েই এই আসামি তাঁকে হুমকি দেন। শুধু তা-ই নয়, তালেবান ওই আসামিকে বিচারক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে।

বিবিসি অনলাইন অবলম্বনে