যে নারীর হাত ধরে বদলে যাচ্ছে অস্ট্রেলিয়ার ধর্ষণ আইন

স্যাক্সন মুলিনস
ছবি: টুইটার থেকে সংগৃহীত

সালটা ২০১৩। অস্ট্রেলিয়ার সিডনি শহরের স্যাক্সন মুলিনসের বয়স তখন ১৮ বছর। সে বছর এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ তোলেন তিনি। বিষয়টি গড়ায় আদালতে। তবে শেষ পর্যন্ত রায় যায় মুলিনসের বিপক্ষে। আদালত জানান, শারীরিক সম্পর্কে আদৌ মুলিনসের সম্মতি ছিল না, তা বুঝতে পারেননি অভিযুক্ত ব্যক্তি।

ওই ঘটনার পর পাঁচ বছর গড়িয়েছে। আদালতের রায়ে মুলিনস হারলেও, নিউ সাউথ ওয়েলস প্রদেশে ধর্ষণসংক্রান্ত আইনে সংস্কার আনা হয়েছে। বলা হয়েছে, শারীরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একজনকে অবশ্যই মৌখিক বা অন্য কোনোভাবে সম্মতি জানাতে হবে। একে বলা হচ্ছে ‘হ্যাঁ–বোধক সম্মতি’ আইন।

চলতি মাসের প্রথম দিকে আইন সংস্কারের আগে আদালতে ধর্ষণের অভিযুক্তরা প্রমাণ করতে চাইতেন, শারীরিক সম্পর্কের সময় তাঁরা মনে করেছিলেন অভিযোগকারীর সম্মতি আছে। তবে এখন থেকে শারীরিক সম্পর্কের সময় কেউ চুপ থাকলেই তাঁর সম্মতি রয়েছে বলে ধরে নেওয়া যাবে না। তাঁকে মৌখিকভাবে ‘হ্যাঁ’ বলে বিষয়টি পরিষ্কার করতে হবে।

মুলিনসের মামলা যখন আদালতে ছিল, তখন নতুন এই আইনের অস্তিত্ব থাকলে হয়তো সাজার মুখে পড়তে হতো অভিযুক্তকে। মুলিনসের মতে, এই আইন ‘বহু মানুষের জন্য কিছুটা হলেও ন্যায়বিচার’ এনে দিয়েছে। তিনি বলেন, ‘এটা একটা স্বীকৃতি। যা ঘটেছিল তা খারাপ ছিল। আর এর ফলেই আমরা পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি।’

আদালতে পাঁচটি বছর

স্যাক্সন মুলিনসের মনে হয়েছে, ২০১৩ সালে ওই ঘটনায় যে তিনি সম্মতি জানাননি কিংবা অভিযুক্ত ব্যক্তিকে থামতে বলেননি, আদালতে সেটি প্রমাণ করার দায়িত্ব তাঁর। জুরিকে মুলিনস বলেছিলেন, তিনি নৈশ ক্লাবের ভেতরে বন্ধুর কাছে ফিরে যেতে চান, এটা শোনার পর ওই ব্যক্তি ‘হতাশ’ ও ‘আক্রমণাত্মক’ হয়ে ওঠেন। তিনি ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। বুঝে উঠতে পারেননি কী করবেন। তাই অভিযুক্ত ব্যক্তির কথামতো কাজ করেছিলেন।

জুরি অভিযুক্ত ব্যক্তিকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেন। তবে ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন তিনি। এবার বিচারের দায়িত্বে ছিলেন একজন বিচারক। দ্বিতীয় দফায় শুনানির পর নির্দোষ প্রমাণিত হন ওই ব্যক্তি।

সেদিন আদালতে অভিযুক্তের থেকে বড়জোর তিন চেয়ার দূরত্বে বসেছিলেন মুলিনস। রায় শোনার পর মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলেন। মুলিনসের ভাষায়, ‘রায়ের মাধ্যমে আমাকে ব্যক্তিগতভাবে আঘাত করা হয়েছিল বলে মনে হচ্ছিল। মন বলছিল, এটা আমি, যাকে কেউ বিশ্বাস করেনি।’

অভিযুক্তকে নির্দোষ ঘোষণার পর আবার আদালতে আপিল করতে যান মুলিনসের আইনজীবীরা। তবে ওই ব্যক্তিকে আবার বিচারের মুখোমুখি করা উচিত হবে না বলে মনে করেছিলেন আদালত। কারণ, এরই মধ্যে তিনি ১০ মাস কারাবন্দী ছিলেন, আর ২০১৩ সালের ঘটনার পর পাঁচ বছর গড়িয়েছে।

আদালতের দেওয়া সমাধানে ক্ষুব্ধ মুলিনস এবার সিদ্ধান্ত নেন প্রতিবাদ জানানোর। ২০১৮ সালে তিনি সম্প্রচারমাধ্যম অস্ট্রেলিয়ান ব্রডকাস্টিং করপোরেশনের ‘ফোর কর্নারস’ অনুষ্ঠানে তাঁর ঘটনা খুলে বলেন। সে সময় বিষয়টি অস্ট্রেলিয়ায় ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল।

সংস্কার হতে পারে ‘বৈপ্লবিক’

নিউ সাউথ ওয়েলসে গত নভেম্বরে ‘হ্যাঁ–বোধক সম্মতি’ আইনের বিল উত্থাপন করা হয়। জুনের শুরুতে আইনটি পাস হলো। ভিক্টোরিয়া প্রদেশও একই পথে হাঁটার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। আর তাসমানিয়া প্রদেশ এ–সংক্রান্ত আইনের পরিবর্তন এনেছে প্রায় ২০ বছর আগে।

ধর্ষণ আইনের বিষয়ে অস্ট্রেলিয়া এগিয়ে রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মুখপাত্র নিকিতা হোয়াইট। ফ্রান্স, জাপান এবং নিউইয়র্কসহ যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে এখনো ধর্ষণকে শারীরিক সম্পর্কের সময় জবরদস্তি কিংবা জবরদস্তির হুমকি হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়।
নিকিতা হোয়াইটের ভাষায়, ‘নিউ সাউথ ওয়েলসে যা হয়েছে, তা আসলেই বৈপ্লবিক। এর একটি বড় প্রভাব আসবে, বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়ার আশপাশের দেশগুলোতে। বিশ্বের অন্য দেশগুলোও অবশ্যই আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকবে।’

সমালোচকদের উদ্বেগ

অস্ট্রেলিয়ায় ধর্ষণ আইন সংস্কার বিপজ্জনক নজির স্থাপন করেছে বলে মনে করছেন কেউ কেউ। তাঁদের মতে, নতুন আইন অনুযায়ী, শারীরিক সম্পর্কের সময় একজন সম্মতি দিলেও পরে যেকোনো সময় তা অস্বীকার করতে পারেন। আর একবার শারীরিক সম্পর্কে সম্মতি দেওয়ার অর্থ এই না যে অন্য সময়েও তাঁর সম্মতি থাকবে।

নিউ সাউথ ওয়েলস বার অ্যাসোসিয়েশনের ভাষ্যমতে, নতুন আইনের ফলে ‘সমস্যা নেই এমন অন্তরঙ্গতা, বিশেষ করে যেগুলো পারস্পরিক সম্মানের সম্পর্কে হয়ে থাকে’, সেগুলোও অপরাধের আওতায় চলে আসবে। অনেকেই আবার বলছেন, এই আইনের অপব্যবহার করে অসন্তুষ্ট সাবেক সঙ্গীরা প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করতে পারেন।
অস্ট্রেলিয়ার প্রখ্যাত আইনজীবী মার্গারেট কানেনের মতে, ধর্ষণের অভিযোগ এনে যাঁদের ফাঁসানোর চেষ্টা করা হবে, এই আইনের মাধ্যমে তাঁদের নির্দোষ প্রমাণিত করতে আরও বেশি অপেক্ষা করতে হবে।

তবে এসব সমালোচনার অনেকগুলোকে ‘অযৌক্তিক’ আখ্যায়িত করেছেন স্যাক্সন মুলিনস। তাঁর ভাষ্য, সমালোচকেরা, বিশেষ করে আইনজীবীরা নতুন আইনের ফলে মর্মাহত। কারণ, তাঁদের এখন কিছুটা বেশি পরিশ্রম করতে হবে।

মুলিনস বলেন, অনেক বছর ধরেই তাসমানিয়ায় এই আইন কার্যকর রয়েছে, কারণ এর সুফল পাওয়া যাচ্ছে। আর যেসব শারীরিক সম্পর্কগুলোয় সম্মতি থাকে, তা আদালত পর্যন্ত গড়ায় না।

পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি ৬ জনে একজন নারী এবং ২৫ জনে একজন পুরুষ যৌন নির্যাতনের শিকার হন। তবে অস্ট্রেলিয়ার এ–সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলছে, বেশির ভাগ মানুষই পুলিশের কাছে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ করেন না। আর যেসব অভিযোগ আনা হয় তার মধ্যে মাত্র ১০ শতাংশ ক্ষেত্রে অভিযুক্তকে সাজা দেওয়া হয়।

এদিকে নতুন আইনটি তিন বছর পর পর্যালোচনা করে দেখা হবে বলে জানিয়েছেন নিউ সাউথ ওয়েলসের অ্যাটর্নি জেনারেল মার্ক স্পিকম্যান। তিনিও আইনটি নিয়ে সমালোচনাগুলো উড়িয়ে দিয়েছেন। বলেছেন, আইনটির সংস্কার একটি ‘সাধারণ’ বিষয়।

এটা কেবল শুরু

নিউ সাউথ ওয়েলসে ধর্ষণ আইন সংস্কারের পর বেশ খুশি স্যাক্সন মুলিনস। তিনি বলেন, ‘আমার সঙ্গে যা হয়েছে, সেগুলো তো আর বদলাতে পারব না। তবে নতুন আইনের ফলে, এটা যদি অন্য কারও ক্ষেত্রে বন্ধ হয়, তাহলে অবশ্যই এর একটি মূল্য রয়েছে। আমি গর্ববোধ করছি।’

মুলিনস জানিয়েছেন, তিনি থেমে থাকবেন না। পুরো অস্ট্রেলিয়ায় ধর্ষণ আইন সংস্কারে কাজ করবেন। তিনি বলেন, ‘ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচার পাচ্ছেন এটা বড় বিষয়। তবে এখনো অনেকে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। আর আমরা সেটাই বন্ধ করার চেষ্টা করছি।’