অনিশ্চয়তার মুখে ফিলিস্তিনিদের টিকা–ভাগ্য

করোনা ঠেকাতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইতিমধ্যে টিকা দেওয়া শুরু হয়েছে। এর মধ্যে জনসংখ্যা অনুপাতে সবচেয়ে বেশি টিকা দিয়েছে ইসরায়েল। এর ঠিক উল্টো চিত্র পাশের ভূখণ্ড ফিলিস্তিনে। সেখানে টিকা সরবরাহই হয়নি। সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে সম্প্রতি প্রতিবেদন করেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি—

পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড জবরদখল করে গড়ে তোলা ইসরায়েলের অবৈধ বসতি
ফাইল ছবি: রয়টার্স

করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) ঠেকাতে ইসরায়েল ইতিমধ্যে এক–চতুর্থাংশের বেশি জনগণকে অন্তত এক ডোজ করে টিকা দিতে সক্ষম হয়েছে, যা জনসংখ্যার অনুপাতে বিশ্বে সর্বোচ্চ। কিন্তু ইসরায়েল অধিকৃত পশ্চিম তীর ও গাজা ভূখণ্ডের পরিস্থিতি কী।
কত মানুষ টিকা পেল?

ইসরায়েলর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, তারা ১৯ ডিসেম্বর থেকে টিকা দেওয়া শুরু করেছে। এরই মধ্যে ৯০ লাখ জনগোষ্ঠীর ইসরায়েলে এক-চতুর্থাংশের বেশি মানুষ ফাইজারের টিকার প্রথম ডোজ নিয়েছেন। শুরুতেই বয়স্ক ও সর্বোচ্চ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকা লোকজনকে টিকা দেওয়া হয়। এখন ৪০ বা তারও বেশি বয়সের ব্যক্তিরা টিকা নিতে পারছেন।

এদিকে ইসরায়েল পশ্চিম তীর ও গাজায় সম্মুখসারির স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য ৫ হাজার টিকা পাঠাবে বলে জানিয়েছে। ইসরায়েলের অধিকৃত পূর্ব জেরুজালেমে সব ফিলিস্তিনিকে ইসরায়েলের পক্ষ থেকে টিকা দেওয়ার কথা। এর মধ্যে ফিলিস্তিনি ছয়টি হাসপাতালে কাজ করা স্বাস্থ্যকর্মীরাও রয়েছেন। তাঁদের অনেকেই পশ্চিম তীর ও গাজা থেকে আসেন। কারণ, এই ব্যক্তিরা ইসরায়েলে বিশেষ অনুমতিপ্রাপ্ত। তাঁরা ইসরায়েলকে কর দেন। তাই তাঁরা দেশটির স্বাস্থ্যবিমার সুযোগ-সুবিধা পান।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, পশ্চিম তীর, গাজা ও পূর্ব জেরুজালেমে ১ লাখ ৭৮ হাজার ৯০০ জনের বেশি মানুষ করোনায় সংক্রমিত হন। এর মধ্যে ২ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। করোনা শনাক্তের তুলনায় মৃত্যুহার ১ দশমিক ১ শতাংশ। অন্যদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, ইসরায়েলে মৃত্যুর হার শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ।

ফিলিস্তিনিরা কবে পাবেন টিকা

পশ্চিম তীরের একাংশের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের হাতে। ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তারা চারটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে টিকার বিষয়ে চুক্তি করছে। এর মাধ্যমে ৭০ শতাংশের বেশি মানুষকে টিকা দেওয়া যাবে। তবে কবে নাগাদ এ টিকা আসবে, তা স্পষ্ট নয়। তবে রাশিয়ার তৈরি টিকা স্পুটনিক–ভির ৫ হাজার ডোজ দ্রুতই আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। অন্যদিকে ইসরায়েলও ফিলিস্তিনকে ৫ হাজার ডোজ টিকা দেবে বলে জানিয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে কোভাক্স স্কিমের আওতায় প্রায় ২০ শতাংশ মানুষ টিকা পেতে পারেন বলে আশা করছেন ফিলিস্তিনবাসী। ডাব্লিউএইচওর উদ্যোগে গঠিত হয়েছে ‘কোভাক্স গ্লোবাল ভ্যাকসিন ফ্যাসিলিটি’। গরিব দেশগুলো যারা নিজেদের জন্য পর্যাপ্ত টিকা সংগ্রহ করতে পারবে না, তাদের জন্য আন্তর্জাতিক এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

টিকা বিতরণে বৈশ্বিক পরিকল্পনা

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিবিসিকে জানিয়েছে, কোভাক্স স্কিমের আওতায় ফিলিস্তিন যে টিকা পাবে, তা গাজা ভূখণ্ডে পাঠানো হবে। তবে টিকা পাঠাতে ওই এলাকায় ইসরায়েল ও মিসরের আরোপিত বিধিনিষেধের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। ২০০৭ সালে ফিলিস্তিনের কট্টরপন্থী সংগঠন হামাস এই এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর থেকে ইসরায়েল ও মিসর অবরোধ আরোপ করে। তবে হামাস কাতার থেকে টিকা পাচ্ছে বলে জানা গেছে।

অধিকৃত পশ্চিম তীরের ইসরায়েলি বসতি মালে আদুমিমে নতুন ঘর তোলার কাজ চলছে
ফাইল ছবি: রয়টার্স

ইসরায়েলে কর্মরত ফিলিস্তিনিদের কী হবে

প্যালেস্টিনিয়ান সেন্ট্রাল ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিকসের তথ্যমতে, ইসরায়েল ও পশ্চিম তীরে তাদের বসতিতে প্রায় ১ লাখ ৩৩ হাজার ফিলিস্তিনি কাজ করেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ অবকাঠামো নির্মাণ খাতের সঙ্গে যুক্ত। লকডাউনের কারণে তাঁদের অনেকেই চাকরি হারিয়েছেন।

ফিলিস্তিনিদের নিয়োগদাতা কিছু ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মীদের এই কর্মীদের টিকা দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে। এমন একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও ইসরায়েল বিল্ডার্স সমিতির সভাপতি রাউল স্রুগো বিবিসিকে বলেন, ‘আমি মনে করি, সব ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিকে, বিশেষ করে যাঁরা আমাদের সঙ্গে কাজ করেন, তাঁদের টিকা দিতে হবে।’
কয়েকজন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ সতর্ক করে দিয়ে বলছেন, ফিলিস্তিনে করোনার টিকাদান কর্মসূচি না চালালে ইসরায়েলে এই মহামারির বিস্তার ঠেকানো যাবে না। কারণ, নানা কারণে দুই ভূখণ্ডের মানুষকে একসঙ্গে থাকতে হয়।

ফিলিস্তিনে টিকা সরবরাহ কার দায়িত্ব

আমেরিকান ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ‘ফাইজার’ এর সহযোগিতায় ‘বায়োএনটেক’ নামের একটি জার্মান বায়োটিকনোলজি কোম্পানি করোনার টিকা তৈরি করেছে
ফাইল ছবি

জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা এক বিবৃতিতে বলেছে, গাজা ও পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের জন্য টিকা সরবরাহ করা ইসরায়েলের দায়িত্ব। জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী, সেখানে টিকা সরবরাহ না করা ‘নৈতিকতা ও আইনি’ দিক থেকে অগ্রহণযোগ্য। কিন্তু ইসরায়েলের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ইউলি এডেলস্টাইন বিবিসিকে বলেছেন, অসলোর শান্তি চুক্তি অনুযায়ী ফিলিস্তিনিদের স্বাস্থ্য–সংক্রান্ত দায়িত্ব তাদের নিজেদেরই নেওয়ার কথা জোরালো ও সুস্পষ্টভাবে বলা আছে।

তবে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে অসলো চুক্তির চাইতে আন্তর্জাতিক আইনই বেশি প্রযোজ্য হবে।

অসলো চুক্তির অন্য প্রসঙ্গগুলো টেনে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ জানায়, পাশাপাশি দুই ভূখণ্ডই এ মহামারি ও সংক্রামক রোগের বিষয়ে তথ্য আদান-প্রদান করতে পারে। এই রোগ প্রতিরোধে পরস্পরকে সহযোগিতা করতে পারে।