ক্ষমতার দ্বন্দ্বে লেবাননে দুর্দশা

লেবাননে সরকারের পতনের পরও থেমে নেই বিক্ষোভ ও সংঘর্ষ। বিক্ষোভের সময় সংঘর্ষ বেধে গেলে দাঙ্গা পুলিশকে লক্ষ্য করে পটকা নিক্ষেপ করেন বিক্ষোভকারীরা। গত সোমবার বৈরুতে পার্লামেন্টের কাছে।  ছবি: এএফপি
লেবাননে সরকারের পতনের পরও থেমে নেই বিক্ষোভ ও সংঘর্ষ। বিক্ষোভের সময় সংঘর্ষ বেধে গেলে দাঙ্গা পুলিশকে লক্ষ্য করে পটকা নিক্ষেপ করেন বিক্ষোভকারীরা। গত সোমবার বৈরুতে পার্লামেন্টের কাছে। ছবি: এএফপি

গত সপ্তাহে বৈরুত বন্দরে ভয়ংকর বিস্ফোরণের পর সেখানকার বাসিন্দারা নিদারুণ কষ্টে দিন কাটাচ্ছে। দেড় শতাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। আহত ছয় হাজারের বেশি। তিন লাখের মতো মানুষ গৃহহীন। বিস্ফোরণের এক দিন পর ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ নিজেদের সাবেক ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র লেবানন সফরে যান। সেখানে গিয়ে লেবাননের সাধারণ জনগণের পাশে দাঁড়ানোর কথা জানান। একই সঙ্গে দেশটির ক্ষমতাসীন রাজনীতিকদের উদ্দেশে কড়া বার্তা দেন। তিনি বলেন, লেবাননের মৌলিক প্রয়োজন দরকার। দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্ত রাজনৈতিক পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেন। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে রাজনৈতিক সংস্কার কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। এই কথাগুলো তিনি যখন বলছিলেন, তখন লেবাননের প্রেসিডেন্ট মিশেল আউন, প্রধানমন্ত্রী হাসান দিয়াব ও স্পিকার নাবিহ বেরি তাঁর পাশেই ছিলেন।

ব্যাপক জনরোষের মুখে গত সোমবার লেবাননের সরকার পদত্যাগের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী দিয়াব। লেবাননে ১৫টি ধর্মের মানুষের বাস। প্রায় ৭০ লাখ জনসংখ্যার মধ্যে ২০ লাখই সিরীয় আর ফিলিস্তিনের শরণার্থী। গৃহযুদ্ধ আর অসন্তোষ দেশটির ইতিহাসের সঙ্গে জুড়ে রয়েছে। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত রক্তক্ষীয় গৃহযুদ্ধ দেশটিকে একেবারে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্ত নিয়ে যায়। গৃহযুদ্ধ অবসানের পর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রচেষ্টায় ‘রাজনৈতিক ক্ষমতার ভাগাভাগি পদ্ধতির’ মাধ্যমে দেশটি পরিচালিত হয়ে আসছে। সেই অনুযায়ী দেশটি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন একজন খ্রিষ্টান। প্রধানমন্ত্রীর পদে আসবেন এক সুন্নি মুসলমান। আর স্পিকার হবেন শিয়া সম্প্রদায় থেকে। ক্ষমতার এই ভাগাভাগিকেই দেশটির উন্নয়নে প্রধান অন্তরায় হিসেবে দেখা যেতে পারে। কারণ, এসব নেতা নিজ নিজ স্বার্থ হাসিলের সর্বোচ্চ চেষ্টায় থাকেন। ফলে উন্নয়নের প্রচেষ্টা মুখথুবড়ে পড়ে।

দু–একটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। বছরের পর বছর লেবাননের মানুষ বিদ্যুৎ পাচ্ছে না। অনেক লেবানিজ মনে করে, পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সরবরাহে রাষ্ট্রের ব্যর্থতা দেশকে গভীরে সংকটে পতিত করেছে। দেশটির শিশুদের বেশি ব্যবহৃত শব্দগুলোর একটি ‘বিদ্যুৎ গেল’। রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রতিষ্ঠান ইডিএল বিদ্যুৎ দিতে না পারায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা কলকারখানাসহ গৃহস্থালির বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম বন্ধ হয়ে পড়ে থাকে। বছরে ২০০ কোটি মার্কিন ডলার ক্ষতি করে ইডিএল, যা লেবাননের ঘাটতি বাজেটের এক–তৃতীয়াংশ।

লেবাননের দাতাদের নিয়ে ২০১৮ সালে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে সম্মলেন হয়। সেখানে বিশ্বব্যাংক, পশ্চিমা ও আরব দেশগুলো আর্থিক ও অবকাঠামো উন্নয়ন এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর কাজে লেবাননকে সহায়তার জন্য কোটি কোটি মার্কিন ডলার অনুদান দিতে সম্মত হয়। তবে এ জন্য দেশের রাজনৈতিক সংস্কার জোরদার, বিদ্যুৎ খাতে একজন নিয়ন্ত্রক নিয়োগ, গ্রিড আধুনিকায়ন ও বিদ্যুতের দাম বানানোর কথা বলে তারা। কিন্তু দুই বছর পরও অর্থনীতি ধুঁকতে দেখে, কোথাও সংস্কারকাজ না হওয়ায় এবং কোন স্থানে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হবে, সেই বিষয়ে রাজনীতিকদের দর–কষাকষি দেখে দাতারা অনেকটাই হতাশ।

প্রেসিডেন্ট মিশেল আউদের প্রতিষ্ঠিত লেবাননে খ্রিষ্টানদের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল ফ্রি প্যাট্রিওটিক মুভমেন্ট (এফপিএম) খ্রিষ্টান অধ্যুষিত উত্তরাঞ্চল সেলাতায় বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে চায়। ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী ও পাবর্ত্যাঞ্চল সেলাতা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য অনুপযোগী। আন্তর্জাতিক দাতা গোষ্ঠী ও অন্যান্য দলও সেখানে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে রাজি নয়। সেখানে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ হলে বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে না। ফলে পুরো দেশের বিদ্যুৎ–সংকট মেটানো সম্ভব হবে না। কিন্তু এফপিএম গোঁ ধরে আছে, সেখানেই বিদ্যুৎকেন্দ্র বানাতে হবে। এই ঘটনা দাতাদের খুবই হতাশ করে।

গত বছরের অক্টোবরে বিদ্যুতের দাবিতে বৈরুতে বিশাল বিক্ষোভ হয়। ইডিএল কার্যালয়ে তারা হামলাও চালায়। এরপরও দেশটির রাজনীতিকেরা এখনো উপযুক্ত স্থানে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে পারেননি। গত জানুয়ারিতে সাদ হারিরি পদত্যাগের পর হাসান দিয়াব প্রধানমন্ত্রী হন। তিনি বিদ্যুৎ খাতসহ নানা সংস্কারের কথা বলেন। তাঁর সরকারের ১০০ দিনের মধ্যে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বিদ্যুৎ খাত ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনার কথা তুলে ধরে বিশ্বব্যাংক। নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রটি সেলাতার পরিবর্তে শিয়া অধ্যুষিত জাহরানিতে নির্মাণের কথাও বলে বিশ্ব প্রতিষ্ঠানটি। সব রাজনৈতিক পক্ষ সেটার পক্ষে মতও দেয়। বিষয়টি জানাজানি হওয়ায় এফপিএমের তীব্র বিরোধিতা করে। প্রেসিডেন্ট আউন সরকারের সিদ্ধান্ত পুনরায় পর্যালোচনার দাবি জানান। খ্রিষ্টান, সুন্নি ও শিয়া মুসলমান অধ্যুষিত এলাকায় তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কথা বলেন তিনি যার কাজ শুরু হয়নি। রয়টার্সের বিশ্লেষণ