জীবনযুদ্ধের মাঝেই জীবনের জয়গান

সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে বোমা হামলায় পা হারানো মুনজির আল-নাজ্জাল। এক পায়ে দাঁড়িয়ে বিকলাঙ্গ শিশুসন্তানকে দোল খাওয়ানোর ছবিটিই জিতে নিয়েছে এ বছরের ‘সিয়েনা ইন্টারন্যাশনাল ফটো অ্যাওয়ার্ড্স (এসআইপিএ)’ এর সেরা ছবির পুরস্কার।
ছবি: টুইটার থেকে নেওয়া।

‘হাসতে নাকি জানে না কেউ
কে বলেছে ভাই?
এই শোন না কত হাসির
খবর বলে যাই।
খোকন হাসে ফোকলা দাঁতে
চাঁদ হাসে তার সাথে সাথে…’
রোকনুজ্জামান খানের বিখ্যাত ‘হাসি’ কবিতার পঙ্‌ক্তি এটি। যেসব স্বভাবগত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে মানুষের জন্ম, সেসবের মধ্যে হাসি একটি। একবার ভাবুন তো, এখনো হাঁটতে শেখেনি, এমন শিশুর মিষ্টিমুখের হাসির কথা। এমন হাসি কাকেই–বা না আনন্দ দেয়; তা-ও যদি হয় বাবার কোলে ছোট্ট শিশুর হাসি। হ্যাঁ, বাবা-ছেলের অকৃত্রিম, ভুবনভোলানো, সেই সঙ্গে হৃদয়ভাঙা একটি হাসির ছবিই ক্যামেরাবন্দী হয়ে জিতে নিল রীতিমতো বর্ষসেরা ছবির মর্যাদা।

মেহমেত আসলান। তুরস্কের আলোকচিত্রী। যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার সীমান্তবর্তী তুর্কি প্রদেশ হতেইয়ের রেহানলি এলাকা থেকে ‘হার্ডশিপ অব লাইফ’ (জীবনের দুর্ভোগ) নামের ছবিটি তুলেছেন তিনি। ছবিটি ‘সিয়েনা ইন্টারন্যাশনাল ফটো অ্যাওয়ার্ডস (এসআইপিএ) ২০২১’ প্রতিযোগিতায় এ বছরের সেরা ছবির পুরস্কার জিতেছে।

ছবিতে দেখা যায়, বাড়ির আঙিনায় এক পা ও ক্রাচের ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে আছেন সিরীয় শরণার্থী মুনজির আল-নাজ্জাল। তিনি পাঁচ বছর বয়সী সন্তান মুস্তফাকে দুই হাতে আকাশে তুলে দোল খাওয়াচ্ছেন। তাঁর নেই এক পা। সন্তানের নেই দুই পা। শিশুটির দুই হাতের কনুই থেকে নিচের অংশও নেই। অস্বাভাবিক এমন শারীরিক অপূর্ণাঙ্গতাকে সঙ্গী করেই জন্ম ওর। কিন্তু তাতে কী! বাবার হৃদয়নিংড়ানো ভালোবাসায় আত্মহারা ছোট্ট মুস্তফা। এ যেন বাবা-ছেলের জীবনযুদ্ধে জীবনেরই জয়গান।

মুস্তফার মা-বাবা দুজনই সিরিয়ার নাগরিক। এখন পরদেশি। দীর্ঘ ১০ বছরের বেশি সময় ধরে যুদ্ধ চলছে সিরিয়ায়। একদিন সেখানে নার্ভ গ্যাস হামলার শিকার হন মুস্তফার মা জায়নেপ। আর বাবা শিকার হন বোমা হামলার। হামলা থেকে দুজনই বেঁচে গেছেন। তবে বড় রকমের চিকিৎসা ধকল সইতে হয়েছে মাকে। একসময় গর্ভে আসে মুস্তফা। ওষুধের তীব্র পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় সে জন্ম নেয় বিকলাঙ্গ হয়ে।

বিশ্বসেরা ছবিটির ক্যাপশনে লেখা ছিল, ভবিষতে মুস্তফার শরীরে বিশেষ ইলেকট্রনিক কৃত্রিম অঙ্গ স্থাপন করতে হবে। তবে দুর্ভাগ্যবশত, তুরস্কে এটি এখনো সহজলভ্য নয়।

‘সিয়েনা ইন্টারন্যাশনাল ফটো অ্যাওয়ার্ডস (এসআইপিএ) ২০২১’ প্রতিযোগিতার বিচারক প্যানেলের অন্যতম ‘নিউজউইক জাপান’-এর আলোকচিত্র বিভাগের পরিচালক কাটাওকা হিদেকো। তিনি বলেন, যদিও এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা বাবা আর শূন্যে ওড়া ছেলে—দুজনের মুখেই অনাবিল হাসি, তবু এর নিচে লুকিয়ে আছে যুদ্ধের ক্ষত, ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতার কালো ছায়া।
হিদেকো আরও বলেন, ‘বাবা-ছেলের এই আনন্দঘন ভালোবাসা আমার হৃদয়েও ক্ষণিকের জন্য দাগ কাটে। তবে দুজনের সামনে কী কঠিন জীবন অপেক্ষা করছে, তা ভেবে পরক্ষণে তা মিলিয়েও যায়। তাদের জীবনে যুদ্ধই বয়ে এনেছে এমন ভয়ানক পরিণতি।’

গণতন্ত্র ও মুক্তির আশায় প্রথম তিউনিসিয়ায় আরব বসন্তের (স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন) সূচনা ২০১০ সালের ডিসেম্বরে। সেই ঢেউ দ্রুতই আছড়ে পড়ে ইয়েমেন, সিরিয়া, লিবিয়া, মিসরসহ বিভিন্ন আরব দেশে। সিরিয়ায় বিক্ষোভ শুরু হয় ২০১১ সালের জানুয়ারিতে। ধীরে ধীরে তা গণ-আন্দোলনে রূপ নেয়। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের একগুঁয়েমিতে এ আন্দোলনই রূপ নেয় রক্তক্ষয়ী সংঘাতে, আরও পরে গৃহযুদ্ধে। এমনকি দেশটি হয়ে ওঠে দেশি-বিদেশি স্বার্থান্বেষী নানা পক্ষের রণক্ষেত্রে।

সিরিয়ায় চলমান গৃহযুদ্ধে নিহত হয়েছে আনুমানিক ছয় লাখ মানুষ। তাদের বড় অংশই বেসামরিক লোক। জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, যুদ্ধে বাস্তুচ্যুত হয়ে তুরস্ক, মিসর, ইরাক, জর্ডান, লেবাননসহ বিভিন্ন দেশে শরণার্থী হয়ে আশ্রয় নিয়েছে অন্তত ৫৬ লাখ মানুষ। এর প্রায় ২৫ লাখই শিশু।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ছবি প্রকাশকারী ওয়েবসাইট পেটাপিক্সেলের তথ্যমতে, অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ এসআইপিএ ফটোগ্রাফি প্রতিযোগিতায় ১৬৩টি দেশের আলোকচিত্রীরা অংশ নেন। বিচারক প্যানেলের সামনে জমা পড়ে হাজার হাজার ছবি। আর তা থেকেই সেরাদের সেরা ছবি হিসেবে তাঁরা বেছে নিয়েছেন সিরিয়ার ‘সীমাহীন যুদ্ধের’ (এনডলেস ওয়ার) ক্ষত বয়ে বেড়ানো বাবা-ছেলের ওই হাসিমাখা ছবিটি।

[তথ্যসূত্র: ওয়াশিংটন পোস্ট, দ্য নিউ আরব, দ্য গার্ডিয়ান ও এএফপি]