সিরিয়া, ইয়েমেন থেকে আমিরাতেও খাদ্যসংকট

লেবাননে দেখা দিয়েছে খাদ্যসংকট।ছবি: রয়টার্স

মহামারির কারণে গত বছরের পবিত্র রমজান মাস ছিল অন্যান্য বছরের তুলনায় আলাদা। এবারও মহামারির মধ্যেই এসেছে পবিত্র রমজান মাস। আরব ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে বিধিনিষেধ এখন কিছুটা শিথিল। তারপরও দুই দফা করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট সংকটের ধাক্কা সামলাতে গিয়ে এসব দেশের অনেক মানুষ রয়েছে খাদ্যসংকটে।

চরম খাদ্যসংকটে রয়েছে যুদ্ধবিধ্বস্ত ইয়েমেন ও সিরিয়া। এসব দেশে গত বছরের তুলনায় রুটি, ভাতের মতো প্রধান খাদ্যের দাম বেড়েছে ২২২ শতাংশ থেকে ৪১৭ শতাংশ। এমনকি আরবের ধনী দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতেও দেখা দিয়েছে খাদ্যসংকট। হু হু করে বাড়তে থাকা খাদ্যের দামে উদ্বিগ্ন আরব আমিরাত সরকারও।

জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) হিসাবে বিশ্বে ৯৬ কোটি মানুষের কাছে সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার মতো পর্যাপ্ত খাবার নেই। তাদের মধ্যে ৬ কোটি ৪০ লাখ মানুষ আরবের ১২টি দেশে ছড়িয়ে রয়েছে। এসব আরব দেশের প্রতি ছয়জন অধিবাসীর মধ্যে একজন খাদ্যসংকটে রয়েছে। যুদ্ধ ও অর্থনৈতিক সংকটের কারণে আরবের অনেকের জীবনে ক্ষুধা চলমান সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব দেশের সরকারও খাদ্যের চড়া দাম নিয়ে উদ্বিগ্ন।

সিরিয়া ও ইয়েমেনে খাদ্যসংকট বেশি। এসব দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী ক্ষুধার্ত। তাদের কাছে খাবার নেই। সিরিয়ার প্রধান খাবার রুটি, ভাত, তেল, চিনি, ডালের দাম গত ফেব্রুয়ারি মাসে আগের বছরের তুলনায় ২২২ শতাংশ বেশি বেড়েছে। ইয়েমেনে জাতিসংঘ দুর্ভিক্ষের হুঁশিয়ারি দিয়েছে। ত্রাণ সংস্থাগুলো বাজেটে রেশনের বরাদ্দ কমিয়েছে। দুই দেশেই জ্বালানি সংকট রয়েছে। এতে দাম বেড়েছে।

ইয়েমেনের এক শিশু।
ছবি: রয়টার্স

সিরিয়ার অনেক বাসিন্দার কাছে মাংস এখন বিলাসবহুল পণ্য। মাংস তাদের হাতের নাগালের বাইরে। দুগ্ধজাত পণ্য ও ফলেরও একই অবস্থা। সরকারের ভর্তুকিতে দেওয়া কম খরচের রুটি কিনতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় মানুষকে। যুদ্ধের আগে সিরিয়া নিজেদের প্রয়োজন মেটানোর মতো গম উৎপাদন করতে সক্ষম ছিল। বার্লিনের হমবোল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের গত বছরের প্রকাশিত সমীক্ষা বলছে, স্যাটেলাইট ডেটায় দেখা গেছে, সিরিয়ায় ২০১০ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ৯ লাখ ৪৩ হাজার হেক্টর কৃষিজমি হারিয়ে গেছে। অর্থাৎ ২০ শতাংশ কৃষিজমি কমেছে।

এ তো গেল সিরিয়ার কথা। অন্য দেশগুলো আরও নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে। গত বছর লেবাননে টমেটো, শসা, সবজি ও টোস্ট করা রুটি দিয়ে তৈরি মধ্যপ্রাচ্যের বিশেষ ফেটুস নামের এক বাটি সালাদের দাম ছিল ৬ হাজার পাউন্ড বা প্রায় ৩৪০ টাকা। আর্থিক সংকট শুরুর পর মুদ্রার মান কমেছে প্রায় ৯০ শতাংশ। গত বছর দেশটিতে খাবারের দাম বেড়েছে ৪১৭ শতাংশ।

লেবাননে বেশির ভাগ খাবারই আমদানি করা হয়। তবে স্থানীয় পণ্যগুলোর দামও বেড়েছে। ফেটুস নামে ওই সালাদের দাম এখন ১৮ হাজার পাউন্ডের বেশি। তার মানে গত বছরের তুলনায় দাম বেড়েছে প্রায় তিন গুণ। বৈরুতে আমেরিকান ইউনিভার্সিটির হিসাব বলছে, পুরো রমজান মাসে স্যুপ, সালাদ ও মুরগির মাংস দিয়ে তৈরি সাধারণ ইফতারের পেছনে খরচ হয় ৬ লাখ ৭৫ হাজার পাউন্ড। লেবাননের সুপারমার্কেটগুলোতে রান্নার তেলের মতো খাদ্য উপকরণের দামের ভর্তুকি নিয়ে গোলমাল চলছে। সশস্ত্র পাহারার মধ্যে থেকে অনেক দোকানে পণ্য বিক্রি চলছে। ১৩ এপ্রিল খাদ্য বিতরণের সময় এক ব্যক্তি নিহত হন।

জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) হিসাবে বিশ্বে ৯৬ কোটি মানুষের কাছে সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার মতো পর্যাপ্ত খাবার নেই। তাদের মধ্যে ৬ কোটি ৪০ লাখ মানুষ আরবের ১২টি দেশে ছড়িয়ে রয়েছে। এসব আরব দেশের প্রতি ছয়জন অধিবাসীর মধ্যে একজন খাদ্যসংকটে রয়েছে।

মিসরে বছরে ১ কোটি ৩০ লাখ টন গম আমদানি করা হয়। প্রতি টনে খরচ পড়ে ২০০ ডলার। এ বছরের শুরুতে খরচ বেড়ে হয়েছে ২৪০ ডলার। রপ্তানিতে রাশিয়ার নতুন কর আরোপের কারণে এই খরচ বেড়েছে। মিসরের অর্থমন্ত্রী বলেছেন, দেশটির সরকার এই ইস্যুতে রাশিয়ার সঙ্গে নতুন চুক্তির কথা ভাবছে। দেশটিতে চালের দামও বেশি।
২০১৪ সালের পর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত মিসরে খাবারের দাম সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। সৌদি আরবে মুদ্রাস্ফীতির প্রধান কারণ হলো খাবারের দাম। ফেব্রুয়ারিতে দেশটিতে খাবারের দাম বেড়েছে ১১ শতাংশ।

মিসরে রুটির দোকানে লম্বা লাইন।
ছবি: এএফপি

সংযুক্ত আরব আমিরাত বিশ্বের ধনী দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। দেশটির সচ্ছল নাগরিকেরা ইফতারের জন্য মাথাপিছু ১০০ ডলার ব্যয় করেন। তবে এ রকম ধনী দেশেও মন্ত্রীরা খাবারের দাম নিয়ন্ত্রণের চিন্তা করছেন। সংযুক্ত আরব আমিরাত এখন মরুভূমিতে টমেটোসহ বিভিন্ন খাবার উৎপাদন করে। তবে দেশটি এখনো ৯০ শতাংশ খাবার আমদানি করে থাকে। রমজান মাসে বিভিন্ন মুদিদোকানে ছাড় দিয়ে পণ্য বিক্রির নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

আরব দেশগুলোর মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাতের অবস্থা তুলনামূলক ভালো হলেও অন্যান্য দেশের পরিস্থিতি খুবই খারাপ। চলমান এই খাদ্যসংকটে এসব দেশের দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। তাদের দিন কাটছে অনাহারে, অর্ধাহারে। দ্য ইকোনমিস্ট অবলম্বনে।