ইউক্রেন পাচ্ছে আরও অস্ত্র ও গোলাবারুদ

ইউক্রেনকে আরও ৮০ কোটি ডলারের সামরিক সহায়তা যুক্তরাষ্ট্রের। মারিউপোল শহর ধ্বংসস্তূপ।

রাশিয়ার হামলায় ধসে গেছে ভবনের অংশবিশেষ। গতকাল ইউক্রেনের কিয়েভে।
ছবি: এএফপি

ইউক্রেন সংকট সমাধানে কূটনীতির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে শুরু থেকেই। বিভিন্ন সময় এ তৎপরতা খানিকটা এগোলেও বড় কোনো সাফল্য এখনো আসেনি। এ পরিস্থিতিতে ইউক্রেনে সামরিক সহায়তা জোরদার করছে পশ্চিমা বিশ্ব। মঙ্গলবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ঘোষণা দিয়েছেন, ইউক্রেনকে আরও ৮০ কোটি মার্কিন ডলারের সামরিক সহায়তা দেওয়া হবে। আর ইউক্রেনের প্রতিবেশী পোল্যান্ডে আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ‘স্কাই সেবার’ মোতায়েন করছে যুক্তরাজ্য।

এ ছাড়া রাশিয়ার আক্রমণ ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ত্র প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে নতুন করে অস্ত্র কেনার প্রস্তুতি নিচ্ছে ইউরোপের দেশগুলো। ড্রোন, ক্ষেপণাস্ত্র ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা কিনতে নতুন করে পদক্ষেপ নিচ্ছে তারা।

এমন সময় এসব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, যখন ইউক্রেনে হামলা অব্যাহত রেখেছে রাশিয়া। গতকাল কিয়েভে আবাসিক ভবনে ক্ষেপণাস্ত্রের ধ্বংসাবশেষের আঘাতে অন্তত একজন নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া দেশটির চেরনিহিভ শহরে বৃহস্পতিবার থেকে পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় কমপক্ষে ৫৩ জন নিহত হয়েছেন। আর খারকিভের নিকটবর্তী মেরেফা শহরে গোলার আঘাতে নিহত হয়েছেন ২১ জন।

ইউক্রেনে রুশ অভিযান শুরুর আগে থেকেই দেশটিকে সামরিক সহায়তা দিয়ে আসছিল যুক্তরাষ্ট্র। ইউক্রেনকে গত ফেব্রুয়ারিতে ৩৫ কোটি ডলারের অস্ত্র দেয় যুক্তরাষ্ট্র। এরপর গত সপ্তাহে ২০ কোটি ডলারের সামরিক সহায়তার অনুমোদন দেন বাইডেন। সর্বশেষ মঙ্গলবার নতুন করে ৮০ কোটি ডলারের সামরিক সহায়তার ঘোষণা করা হলো। এ অর্থ ব্যয় হবে ইউক্রেনের জন্য বরাদ্দ করা ১ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের তহবিল থেকে। মঙ্গলবার ওই তহবিলে স্বাক্ষর করেন বাইডেন।

অনলাইনে যুক্ত হয়ে মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে ভাষণ দেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। ওই ভাষণে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র যে সাহায্য দিয়েছে, তাতে তিনি কৃতজ্ঞ। কিন্তু তাঁর দেশের জন্য আরও সাহায্য দরকার। এরপরই ৮০ কোটি ডলারের সামরিক সহায়তা ঘোষণা করেন বাইডেন।

যেসব অস্ত্র দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র

এই ৮০ কোটি ডলারের সামরিক সহায়তার মধ্যে কী কী রয়েছে, এর তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে হোয়াইট হাউসের ওয়েবসাইটে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, স্টিংগার নামে ৮০০টি আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা, ভূমি থেকে আকাশে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম দুই হাজার জ্যাভলিন ক্ষেপণাস্ত্র ইউক্রেনে পাঠানো হবে। এ ছাড়া গোলাবারুদ, সাঁজোয়া যান–বিধ্বংসী অস্ত্র, ড্রোন, রাইফেল, পিস্তল, মেশিনগান, শটগান, রকেট ও গ্রেনেড লঞ্চর দেওয়া হবে। এসব অস্ত্র পাঠানোর ঘোষণা দিয়ে বাইডেন বলেন, এর আগে ইউক্রেনকে এ ধরনের সহায়তা দেওয়া হয়নি। তিনি বলেন, প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি যে সহায়তা চেয়েছেন, তারই পরিপ্রেক্ষিতে এসব দেওয়া হচ্ছে।

এর আগে ইউক্রেনে ৬০০টি স্টিংগার, ২ হাজার ৬০০ জ্যাভলিন, ৫টি এমআই-১৭ হেলিকপ্টার, তিনটি পেট্রলবোটসহ গোলাবারুদ, গ্রেনেড লঞ্চার ও অন্যান্য অস্ত্র পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

পোল্যান্ডে ব্রিটিশ ক্ষেপণাস্ত্রব্যবস্থা

গতকাল বৃহস্পতিবার যুক্তরাজ্য ইউক্রেনের বন্ধুরাষ্ট্র পোল্যান্ডে আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা স্কাই সেবার মোতায়েনের ঘোষণা দিয়েছে। পূর্ব ইউরোপের নিরাপত্তা জোরদার করতে পশ্চিমা দেশগুলোর সামরিক জোট ন্যাটো যে পদক্ষেপ নিয়েছে, তার অংশ হিসেবে স্কাই সেবার মোতায়েন করা হচ্ছে।

এর আগে ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, এ ক্ষেপণাস্ত্রব্যবস্থা দিয়ে টেনিস বল আকারের বস্তুও ঠেকিয়ে দেওয়া সম্ভব। এমনকি শব্দের বেগে চলা বস্তুকেও থামিয়ে দিতে পারবে স্কাই সেবার। তবে ঠিক কবে স্কাই সেবার মোতায়েন করা হবে, তা জানা যায়নি। এ প্রসঙ্গে ব্রিটিশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেন ওয়ালেস বলেন, ‘আমরা মধ্যপাল্লার স্কাই সেবার মোতায়েন করতে যাচ্ছি পোল্যান্ডে। এ ছাড়া সেখানে ১০০ সেনা মোতায়েন করা হবে। রাশিয়া যাতে আর কোনো আগ্রাসন চালাতে না পারে এবং আমরা যে পোল্যান্ডের পাশে আছি, সেটা নিশ্চিত করতে সেখানে আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা মোতায়েন করা হচ্ছে।’

যুক্তরাজ্য, যুক্তরাজ্য ছাড়াও ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দিচ্ছে ন্যাটো জোটের জার্মানি, ফ্রান্স, বেলজিয়ামসহ বিভিন্ন দেশ। এ ছাড়া ইউক্রেনের সামরিক খাতে সহায়তা করতে ইউরোপীয় ইউনিয়নও অর্থ দিচ্ছে।

অস্ত্রের খোঁজে ইউরোপ

এদিকে রুশ হামলার কারণে নতুন করে অস্ত্রের দিকে ঝুঁকতে হচ্ছে ইউরোপের দেশগুলোকে। এ দেশগুলো যাদের কাছ থেকে অস্ত্র কিনে থাকে, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সরকার ও যেসব মার্কিন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে অস্ত্র কেনে, তাদের কাছে নতুন করে চাহিদাপত্র পাঠাচ্ছে ইউরোপের দেশগুলো।

যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান লকহিড মার্টিন করপোরেশনের সঙ্গে একটি চুক্তি করতে যাচ্ছে জার্মানি। এ চুক্তির মাধ্যমে ৩৫টি এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান পাবে জার্মানি। এ চুক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে বলে জানিয়েছে একটি সূত্র। এ ছাড়া ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থাও কিনছে জার্মানি।

ইউক্রেনের প্রতিবেশী পোল্যান্ড যত দ্রুত সম্ভব রিপার ড্রোন কিনতে চায়। যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে এ অস্ত্র কিনতে জোর তৎপরতা চালাচ্ছে দেশটি। এ ছাড়া পূর্ব ইউরোপের আরও কয়েকটি দেশ অস্ত্র কিনতে জোর তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। এ–সংক্রান্ত দুটি সূত্র বলেছে, দেশগুলো স্টিংগার ও জ্যাভলিন কেনার চেষ্টা করছে।

এ ছাড়া রাশিয়ার হামলার কারণে সামরিক খাতে ব্যয় বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে জার্মানি, সুইডেন ও ডেনমার্ক। ইউরোপে নতুন করে যে নিরাপত্তাসংকট দেখা দিয়েছে, তা কাটিয়ে উঠতে এসব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দপ্তর পেন্টাগনের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি মারা কারলিন বলেন, ইউরোপের মিত্ররা প্রতিরক্ষা ব্যয় দ্বিগুণ করছে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো বিদেশিদের কাছে অস্ত্র বিক্রি করতে গেলে পেন্টাগনের অনুমোদন নিতে হয়। ফলে ইউরোপের অস্ত্রের চাহিদাপত্রের অনুমোদন দিতে পেন্টাগনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রতি সপ্তাহে বৈঠক করতে হচ্ছে। এ জন্য পেন্টাগনকে নতুন একটি দল গঠন করতে হয়েছে।

মস্কো-ওয়াশিংটন বাগ্‌যুদ্ধ

কূটনীতি ও সামরিক তৎপরতার পাশাপাশি পশ্চিমাদের সঙ্গে রুশ কর্তৃপক্ষের বাগ্‌যুদ্ধও বাড়ছে। মঙ্গলবার হোয়াইট হাউসের এক অনুষ্ঠান শেষে জো বাইডেন বলেন, ‘আমি মনে করি, তিনি (ভ্লাদিমির পুতিন) একজন যুদ্ধাপরাধী।’

এত দিন বাইডেন প্রশাসন কখনোই পুতিনকে ‘যুদ্ধাপরাধী’ হিসেবে আখ্যা দেয়নি। কিন্তু মঙ্গলবার খোদ বাইডেনই আক্রমণ শাণালেন। তাঁর এ মন্তব্য প্রসঙ্গে হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি জেন সাকি বলেন, ‘তিনি (বাইডেন) মন থেকে এ কথা বলেছেন এবং টেলিভিশনে যা দেখছেন, তাই বলেছেন।’

তবে বাইডেনের এমন মন্তব্যের পরপরই এর ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে রাশিয়া। ক্রেমলিন বলেছে, বাইডেনের এ মন্তব্য ‘অগ্রহণযোগ্য এবং ক্ষমার অযোগ্য’।

মস্কোর এমন প্রতিক্রিয়ায় থেমে যাননি বাইডেন। গতকাল পুতিনকে একজন খুনি স্বৈরশাসক বলে আখ্যা দিয়েছেন।

মারিউপোলে ধ্বংসস্তূপ

ইউক্রেনের যে শহরগুলোয় সবচেয়ে বেশি হামলা চালানো হচ্ছে, সেগুলোর অন্যতম মারিউপোল। স্থানীয় সময় বুধবার সেখানে একটি থিয়েটারে হামলা চালানো হয়। সেখানে এক হাজারের বেশি মানুষ আশ্রয় নিয়েছিলেন। গতকাল পর্যন্ত ওই ধ্বংসস্তূপ থেকে প্রায় দেড় শ মানুষকে জীবিত উদ্ধার করা গেছে। তবে এখনো কতজন নিখোঁজ রয়েছেন, তা জানা যায়নি। পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোর খবরে বলা হয়েছে, এ শহরের প্রায় ৯০ শতাংশ ভবন ধ্বংস হয়েছে রুশ বাহিনীর হামলায়।

রুশ হামলার কারণে এ শহর ছেড়েছেন ৩০ হাজার মানুষ। আর ইউক্রেন ছেড়েছেন ৩২ লাখ মানুষ। এ শরণার্থীদের মধ্যে ১৮ লাখই পাড়ি জমিয়েছেন পোল্যান্ডে। জার্মানিতে পাড়ি জমিয়েছেন প্রায় দুই লাখ। এ ছাড়া ইউরোপের অন্যান্য দেশে আশ্রয় নিয়েছেন ইউক্রেনীয়রা।

এদিকে ইউক্রেনের বিভিন্ন এলাকা থেকে জনসাধারণকে বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিতে ও ত্রাণ সরবরাহ চালু রাখতে ৯টি নিরাপদ পথ সৃষ্টির ব্যাপারে সম্মত হয়েছে ইউক্রেন ও রাশিয়া। যেসব শহর থেকে জনসাধারণকে বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে মারিউপোলও রয়েছে। যদিও এ নিয়ে ভিন্ন কথা বলেছেন প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি। তিনি বলেন, রাশিয়ার হামলার কারণে এ সিদ্ধান্ত কাজে আসেনি।

তবে এর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছে রাশিয়া। এ ছাড়া ইউক্রেনীয়দের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ও ত্রাণ সরবরাহ কার্যক্রম চালু রাখতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে একটি খসড়া প্রস্তাব উত্থাপন করতে যাচ্ছে খোদ রাশিয়া। আজ শুক্রবার এ ইস্যুতে ভোট অনুষ্ঠিত হবে। তবে কূটনীতিকেরা বলছেন, এ প্রস্তাব পাস হবে না। কারণ, ইউক্রেন থেকে রুশ সেনাদের সরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে রাশিয়া কিছু উল্লেখ করেনি খসড়া প্রস্তাবে।