ইউক্রেন সংকট জার্মানির রাজনীতিকে পাল্টে দিল

রাজধানী কিয়েভসহ ইউক্রেনের সর্বত্র ভারী অস্ত্রে সজ্জিত রুশ সেনাদের দেখা যাচ্ছে
ছবি: রয়টার্স

ইউক্রেন সংকটে জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজকে নিয়ে জার্মানি ও ইউরোপীয় রাজনীতিকেরা সংশয়ে ছিলেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের বড় দেশ জার্মানি শেষ পর্যন্ত কতটা এগোতে পারবে, তা নিয়ে ভাবনা ছিল। মনে করা হয়েছিল, শেষ পর্যন্ত রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের প্রচ্ছন্ন হুমকির মুখে চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজের নতুন জোট সরকার হয়তো জার্মানির যুদ্ধে না জড়ানোর নীতিতে অটল থাকবে!

না, তা হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর জার্মান রাজনীতির জন্য এই সিদ্ধান্ত ছিল সময়ের দাবি। গতকাল রোববার ছুটির দিনে বার্লিনের বুন্দেসটাগ বা জার্মানির পার্লামেন্টে ইউক্রেন সংকট নিয়ে বিশেষ অধিবেশন বসেছিল। জার্মান পার্লামেন্টের সেই বিশেষ অধিবেশনে চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ একটি স্মরণীয় ভাষণ দিয়েছেন। তিনি পার্লামেন্টে বলেছেন, ‘আমরা রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে সহিংসতার ব্যবহার কখনোই মেনে নেব না। এই যুদ্ধ রাশিয়ার জনগণের নয়, এই যুদ্ধ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের। তাঁর মতো যুদ্ধবাজের জন্য সীমারেখা স্থির করার প্রয়োজন।’

ওলাফ শলৎজ পুরোনো সংশয় ঝেড়ে সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে একাধিক নতুন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। নতুন অবরোধব্যবস্থা ঘোষণাসহ ইউক্রেনের জন্য অস্ত্র, জার্মান সেনাবাহিনীর সম্প্রসারণ এবং জার্মানির জন্য নতুন জ্বালানিনীতির ঘোষণা দিয়েছেন।
চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজের নতুন গঠিত তিনদলীয় জোট সরকার চেয়েছিল, একটি প্রগতিশীল সরকার হিসেবে যুদ্ধ নয়, পারস্পরিক সহযোগিতার নীতিতে এগিয়ে যাবে। কিন্তু ইউক্রেনকে লক্ষ্য করে ভ্লাদিমির পুতিন সর্বগ্রাসী যুদ্ধ জার্মানির পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষানীতিতে নতুন যুগের সূচনা হলো।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অপরাধ বোধ থেকে জার্মানির রাজনীতিতে প্রতিবেশী দেশগুলো ছাড়াও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন বা এখনকার রাশিয়ার রাজনীতির বিষয়ে একটি সমীহের নীতি মেনে চলার প্রবণতা লক্ষ করা যেত। কয়লা, গ্যাস ও তেল—এই তিন জ্বালানির জন্য রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল জার্মানি। তাই জার্মানি রাজনীতিকদের রাশিয়ার প্রতি সমীহ করে রাজনীতি করার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। জার্মানির এই সমীহ করে চলার রাজনীতি, অনেক ক্ষেত্রেই দুর্বল রাজনীতি বলে সমালোচনা হচ্ছিল। অবশেষে সেই খোলস থেকে বের হয়ে এসেছেন জার্মান রাজনীতি আর নতুন চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ।

সেনাবাহিনীর জন্য বিশাল বিনিয়োগ ও ২০২২ সালের অর্থ বাজেট বাড়ানোসহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিল জার্মানির সরকার। রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের কড়া সমালোচনা করে চ্যান্সেলর শলৎজ ইউরোপের নিরাপত্তার ওপর জোর দেওয়ার কথাও বলেছেন।
জার্মান পার্লামেন্টের এই বিশেষ অধিবেশনে ওলাফ শলৎজ রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধসহ ইউরোপীয় সংহতি এবং ইউক্রেনের জন্য অস্ত্র সরবরাহের বিষয়টি ব্যাখ্যা করেন। তিনি শুধু ইউক্রেনের জন্য অস্ত্রই নয়, নিজ দেশের সেনাবাহিনীর সম্প্রসারণ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রায় ৮০ বছর পর আগামী বাজেটে প্রতিরক্ষা খাতে ১০ হাজার কোটি ইউরো বিনিয়োগের ঘোষণা দেন। জার্মান সংসদে ইউক্রেন প্রশ্নে এত দিন নীরবে থাকা বাম দলের সাংসদেরাও চ্যান্সেলরের এ ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছেন। পার্লামেন্টে সাবেক চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলের দল বা প্রধান বিরোধী ক্রিশ্চিয়ান গণতান্ত্রিক দলের প্রধান ফ্রেডরিখ মার্জ এ ঘোষণাকে ঐতিহাসিক বলে মত প্রকাশ করছেন। শুধু দক্ষিণপন্থী কট্টরবাদী এএফডি বা অলটারনেটিভ ফর ডয়চেল্যান্ড দলটি, চ্যান্সেলের ওলাফ শলৎজের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানায়নি।

জার্মানি ন্যাটো জোটের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য হওয়া সত্ত্বেও আগে এই প্রতিরক্ষা জোটের বিষয়ে নিরুৎসাহ লক্ষ করা যেত। যুক্তরাষ্ট্র সব সময় তার যুদ্ধনীতি বা অস্ত্র বিক্রির অর্থনৈতিক স্বার্থে ইউরোপের বন্ধুদের সহযোগিতা ও ইউরোপের মাটিতে ন্যাটো জোটের প্রসার ঘটাতে চেয়েছে। বিগত সময়গুলোতে আফগানিস্তান, কুয়েত বা ইরাকের যুদ্ধে যেতে অসম্মতির জন্য ইইউ বা ন্যাটো জোটের বড় সদস্যদেশ জার্মানি ও ফ্রান্স যুদ্ধবাজ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তিরস্কৃত হয়েছে। কিন্তু ইউক্রেনের যুদ্ধ পরিস্থিতি বা রাশিয়ার আগ্রাসী হামলা জার্মান বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাজনীতির হিসাব–নিকাশ পাল্টে দিল।