মহাকাশে অস্ত্র প্রতিযোগিতা নিয়ে নতুন উত্তেজনা

মহাকাশে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে কৃত্রিম উপগ্রহ ধ্বংস করেছে রাশিয়া।
ছবি: এএফপি

আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের নভোচারীরা ১৫ নভেম্বর সকাল সাতটার দিকে সতর্কবার্তা পান। জানতে পারেন, তাঁদের দিকে ধেয়ে আসছে ধ্বংস হয়ে যাওয়া কৃত্রিম উপগ্রহের কিছু বর্জ্য। তাঁরা দ্রুত গিয়ে আশ্রয় নিলেন দুটি ক্যাপসুলের ভেতর। উদ্দেশ্য যেকোনো দুর্ঘটনা ঘটলে দ্রুত আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন ছাড়তে পারেন।

আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে বর্তমানে সাতজন ক্রু রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে চারজন যুক্তরাষ্ট্রের, একজন জার্মানির ও দুজন রাশিয়ার নাগরিক। ওই সময় তাঁরা জঞ্জালের উৎস বিষয়ে কিছু জানতেন না। কিন্তু এখন সবাই জানেন, মহাকাশে এ বর্জ্য সৃষ্টি হয়েছে সোভিয়েত যুগের গোয়েন্দাগিরির কাজে ব্যবহৃত (কসমস-১৪০৮) একটি কৃত্রিম উপগ্রহ ধ্বংসের ফলে। এই উপগ্রহটি রাশিয়ান অ্যান্টি-স্যাটেলাইট অস্ত্রের (এএসএটি) পরীক্ষায় লক্ষ্যবস্তু হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল।

আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন (আইএসএস)।
ছবি: রয়টার্স

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, রাশিয়ার এই বেপরোয়া পরীক্ষার ফলে মহাকাশে দুই টন জঞ্জাল তৈরি হয়েছে। এগুলো ৫০০ কিলোমিটার উচ্চতায় প্রদক্ষিণ করছে। এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৫০০টির বেশি গতিবিধি অনুসরণযোগ্য ধ্বংসাবশেষ তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া কয়েক হাজার ধ্বংসাবশেষ তৈরি হয়েছে। এই ধ্বংসাবশেষগুলো সবার জন্যই হুমকিস্বরূপ।

ইকোনমিস্ট তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, আমেরিকা যে সত্য বলছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। উপগ্রহ এবং মহাকাশের ধ্বংসাবশেষ নজরদারি করতে কাজ করে যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালির স্টার্টআপ লিওল্যাবস। তারা রাশিয়ার কৃত্রিম উপগ্রহ ধ্বংস হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।

যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ করেছে, উপগ্রহ ধ্বংসকারী ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার আগে তাদের জানায়নি মস্কো। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন এক বিবৃতিতে বলেছেন, বিপদ শেষ হয়নি এবং এসব ধ্বংসাবশেষ মহাকাশে কর্মকাণ্ডের জন্য হুমকি হিসেবে থাকবে।
তবে রাশিয়া ১৫ নভেম্বর ভোরে সতর্ক করে বলেছিল, মস্কো থেকে ৮০০ কিলোমিটার দূরে প্লেসেটস্ক থেকে তারা একটি রকেট উৎক্ষেপণ করবে। এর আগে ওই স্থান থেকে কৃত্রিম উপগ্রহ–বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র নুডলের পরীক্ষা চালিয়েছিল দেশটি।

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতিঃপদার্থবিদ জোনাথন ম্যাকডোয়েল কৃত্রিম উপগ্রহের ডেটাবেইস সংরক্ষণ করেন। তিনি একটি ডায়াগ্রাম টুইট করেন, যাতে রকেট উৎক্ষেপণের সময়ের সঙ্গে কসমস-১৪০৮ উপগ্রহের আঘাতের সম্পর্ক দেখানো হয়।
রাশিয়ার পক্ষ থেকে শুরুতে অবশ্য এ পরীক্ষার বিষয়টি স্বীকার করা হয়নি। তবে গত সপ্তাহ থেকে রাশিয়া যেভাবে ইউক্রেন সীমান্তে সেনা জড়ো করছে, তার সঙ্গে এ পরীক্ষার যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়।

রাশিয়ার এই তৎপরতার নিন্দা করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, পৃথিবী নিম্ন কক্ষপথে মহাকাশের এসব জঞ্জাল কৃত্রিম উপগ্রহগুলোর ঝুঁকি বাড়িয়ে দেবে। উপগ্রহ বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে মহাকাশচারীদের হুমকির মধ্যে ফেলার জন্য মস্কোকে অভিযুক্ত করেছে ওয়াশিংটন। এ ঘটনায় নিন্দা ও ক্ষোভ জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এ বিষয়ে যুক্তরাজ্যও নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছে।

মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র নেড প্রাইস এ বিষয়ে বলেন, রাশিয়া যে পরীক্ষা চালিয়েছে, তা বিপজ্জনক ও দায়িত্বজ্ঞানহীন। নেড প্রাইস বলেন, রাশিয়ার এ আচরণ মহাকাশের দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতাকে বিপন্ন করে তুলেছে। এর জবাব দিতে যুক্তরাষ্ট্র তার অংশীদার ও মিত্রদের সঙ্গে কাজ করবে।

এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়, রাশিয়ার এ পদক্ষেপ মহাকাশে ক্রমবর্ধমান অস্ত্র প্রতিযোগিতার বিষয়ে উদ্বেগ পুনরুজ্জীবিত করবে। লেজার অস্ত্র থেকে শুরু করে অন্যদের কক্ষপথ থেকে দূরে সরিয়ে দিতে সক্ষম স্যাটেলাইট পর্যন্ত সবকিছুতেই প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করবে।

এর আগে ২০০৭ সালে চীনের একটি কৃত্রিম উপগ্রহ বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার সময় সবচেয়ে বেশি মহাকাশ বর্জ্য তৈরি হয়েছিল। এ ঘটনায় ১০ হাজারের বেশি বর্জ্য মহাকাশে ছড়িয়ে পড়ে, যার মধ্যে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ তিন হাজার বর্জ্যের গতিবিধি নজরে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র।

নাসার মানব মহাকাশযান প্রোগ্রামের সাবেক প্রধান এবং স্পেসএক্সের বর্তমান নির্বাহী বিল গার্স্টেনমায়ার বলেন, ‘দীর্ঘ সময় ধরে ওই বর্জ্যগুলো আমাদের মাথাব্যথার কারণ ছিল। এখন আমাদের আবার নতুন বর্জ্য নিয়ে ভাবতে হবে।’

যুক্তরাষ্ট্রের স্পেস কমান্ড সূত্র বলেছে, মহাকাশে সৃষ্ট জঞ্জালগুলো আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন, মহাকাশে মানব মিশন পরিচালনাসহ কৃত্রিম উপগ্রহগুলোর জন্য মারাত্মক ঝুঁকি সৃষ্টি করবে।

২০১৯ সালে ভারতও এ ধরনের কৃত্রিম উপগ্রহ বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছিল। তাতে অবশ্য কম বর্জ্য সৃষ্টি হয়েছিল। তাতে ঝুঁকির পরিমাণও কম ছিল। তবে তা নিয়ে নিন্দার ঝড় বয়ে যায়। মহাকাশে এ ধরনের পরীক্ষা নিষিদ্ধ করার বিষয়ে কথা ওঠে। এ বিষয়ে অবশ্য ১৯৬৭ সালে স্বাক্ষরিত একটি মহাকাশ চুক্তি রয়েছে। সে চুক্তি অনুযায়ী, অন্য দেশের কার্যকলাপে সম্ভাব্য ক্ষতিকর হয়ে উঠতে পারে, এমন কিছু করার আগে সে দেশের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। ১৯৭২ সালের মহাকাশ দায়বদ্ধতা নীতি অনুযায়ী, মহাকাশ বর্জ্যে কোনো সমস্যা হলে তার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। তবে মহাকাশে অস্ত্রের পরীক্ষা নিষিদ্ধ করার জন্য সুনির্দিষ্ট আলোচনা এখনো গতি পায়নি।

রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার ঘটনাটি যদি আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার দিকে না নিয়ে যায়, তারপরও একে উসকানি হিসেবে দেখবে অনেক দেশ। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি ও জাপান এর প্রতিক্রিয়া জানাবে। তবে, এই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন সরাসরি ঝুঁকির মুখে নেই। স্টেশনের কিছু অংশ বন্ধ রাখা হয়েছে।

তবে মহাকাশচারীরা কাজে ফিরেছেন। মহাকাশ স্টেশনের নভোচারীদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন রাশিয়ার নভোচারী কর্নেল আন্তন শকাপলরভ। তাঁর মাতৃভূমির এহেন কর্মকাণ্ডে মহাকাশে তাঁদের প্রতিক্রিয়া জানা যায়নি।

তবে যুক্তরাষ্ট্র যে আশঙ্কার কথা বলছে, তা উড়িয়ে দিয়েছে রাশিয়ার মহাকাশ সংস্থা রসকসমস। সংস্থাটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তাদের মূল অগ্রাধিকার ছিল আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের নভোচারীদের নিরাপত্তা দেওয়া।

*ইকোনমিস্ট, এএফপি ও বিবিসি অবলম্বনে মিন্টু হোসেন