আবার অশান্ত দার্জিলিং

গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার নেতা বিমল গুরুং
ছবি: ভাস্কর মুখার্জি

আবার অশান্ত হয়ে পড়েছে পশ্চিমবঙ্গের শৈল শহর দার্জিলিং। এত দিন দার্জিলিংকে পৃথক গোর্খাল্যান্ড রাজ্য গড়ার দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে আসছিল গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা। সেই মোর্চারই প্রধান বিমল গুরুং নেমেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গড়া জিটিএ বা গোর্খাল্যান্ড টেরিটরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ঘোষিত নির্বাচনের বিরোধিতায়।

নির্বাচন কমিশন আগামী ২৬ জুন এই জিটিএর নির্বাচনের দিন ঘোষণা করেছে। এর প্রতিবাদে বুধবার সকালে দার্জিলিংয়ের সিংমারির দলীয় কার্যালয়ের কাছে পৃথক একটি মঞ্চ বানিয়ে আমরণ অনশন শুরু করেছেন বিমল গুরুংসহ দলের অন্যরা।

অনশনে বসে বিমল গুরুং বলেছেন, ‘রাজ্য সরকারের কাছে আমরা যে দাবিনামা পেশ করেছিলাম, সে ব্যাপারে রাজ্য সরকার কোনো উচ্চবাচ্য করেনি। তাই আমরা ঘোষণা দিয়েছি, আমাদের দল জিটিএ নির্বাচনে অংশ নেবে না। আমরা জিটিএর নির্বাচনে অংশ নেব না।’

বিমল গুরুং আরও বলেছেন, ‘আমার সর্বস্ব চলে গেছে গোর্খাদের দাবি আদায়ের আন্দোলনে। এখন অবশিষ্ট রয়েছে প্রাণটুকু। এবার তাই সেই প্রাণটুকুকে বিলিয়ে দেব গোর্খাদের দাবি আদায়ের আন্দোলনে।’

আশির দশকে দার্জিলিংকে পৃথক গোর্খাল্যান্ড রাজ্য করার দাবিতে জিএনএলএফ নেতা সুভাষ ঘিসিং আন্দোলনে নামেন। উত্তাল হয় দার্জিলিং। আজও দার্জিলিং শান্ত হয়নি।

আশির দশকে দার্জিলিংকে পৃথক গোর্খাল্যান্ড রাজ্য করার দাবিতে জিএনএলএফ নেতা সুভাষ ঘিসিং আন্দোলনে নামেন। উত্তাল হয় দার্জিলিং। আজও দার্জিলিং শান্ত হয়নি। একই ধারায় পৃথক গোর্খাল্যান্ড রাজ্যের দাবিতে আন্দোলন চলছে এখনো। গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার নেতা বিমল গুরুং সেদিন গোর্খা ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্টের (জিএনএলএফ) কাউন্সিলর হয়ে দলীয় প্রধান সুভাষ ঘিসিংয়ের সঙ্গে বিরোধ করে দল ছেড়ে গড়েছিলেন গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা।

আবার বাম ফ্রন্টের আমলে যখন বিমল গুরুংরা দার্জিলিংকে অশান্ত করে তুলেছিলেন, তখন মমতা এসে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁদের পাশে। ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনেও বিমল গুরুংরা মমতার পাশে ছিলেন। কিন্তু মমতা বিমল গুরুংয়ের ছায়াসঙ্গী বিনয় তামাংকে বাগিয়ে নেন। বিনয় রাজ্য সরকারের সঙ্গে আঁতাত করে পৃথক গোর্খ্যাল্যান্ডের দাবি থেকে সরে আসেন। হাত মেলান রাজ্য সরকারের সঙ্গে। মমতাও পুরস্কার দেন বিনয় তামাংকে। জিটিএর চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেন তাঁকে। পাহাড় থেকে বিমল গুরুংকে তাড়িয়ে দেওয়া বা গ্রেপ্তার করার জন্য তৎপর হয়ে ওঠেন মমতা। যেমনটা সুভাষ ঘিসিংকে পাহাড় থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন বিমল গুরুং। এবার তিনিই আন্দোলনে নেমেছেন।

সেই ১৯৮০ সালে পৃথক গোর্খাল্যান্ড রাজ্যের দাবিতে দার্জিলিংয়ে জিএনএলএফ নেতা সুভাষ ঘিসিং প্রথম আন্দোলন শুরু করার পর ১৯৮৮ সালের ২২ আগস্ট সেদিনের বাম ফ্রন্ট সরকার, জিএনএলএফ ও কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যস্থতায় গড়া হয় পৃথক স্বশাসিত সংস্থা ‘দার্জিলিং গোর্খা পার্বত্য পরিষদ’। এর চেয়ারম্যান করা হয় সুভাষ ঘিসিংকে। পরবর্তী সময়ে এ পরিষদের নির্বাচনে তিনিই চেয়ারম্যান হন। অন্যদের মধ্যে কাউন্সিলর হন বিমল গুরুং।

একসময় সুভাষ ঘিসিংয়ের সঙ্গে মতবিরোধের জেরে বিদ্রোহ করেন বিমল গুরুং। এরপর ২০০৭ সালের ৭ অক্টোবর বিমল গড়েন গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা। এরপর মোর্চা পৃথক গোর্খাল্যান্ড রাজ্যের দাবিতে আন্দোলন করে অশান্ত করে তোলে দার্জিলিং। আর দার্জিলিং থেকে প্রকারান্তরে তাড়িয়ে দেওয়া হয় সুভাষ ঘিসিংকে। তিনি গিয়ে আশ্রয় নেন জলপাইগুড়িতে। এরপর আর তিনি ঠাঁই পাননি দার্জিলিংয়ে। মারাও যান জলপাইগুড়িতেই।

সুভাষ ঘিসিংয়ের বিদায়ের পর বিমল গুরুংয়ের আন্দোলন থামাতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা এগিয়ে আসেন। কথা দেন, দার্জিলিংয়ে ফিরিয়ে আনবেন শান্তি। এরপর মমতার উদ্যোগেই ২০১১ সালের ১৮ জুলাই সেই ১৯৮৮ সালের ধাঁচে গড়া হয় জিটিএ বা গোর্খাল্যান্ড টেরিটরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন। এর চেয়ারম্যান হন বিমল গুরুং আর কাউন্সিলর হন বিনয় তামাং। এবার ইতিহাসের পথ ধরে জনমুক্তি মোর্চার নেতা বিনয় তামাং বিদ্রোহ করে বসেন বিমল গুরুংয়েরই বিরুদ্ধে। ছাড়েন বিমল গুরুংয়ের সংস্রব। বিমল গুরুংয়ের অফিস দখল করে নামিয়ে দেওয়া হয় তাঁর ছবি। ওড়ানো হয় দলের নতুন পতাকা। আর এই কাজে বিনয় তামাংয়ের পাশে এসে দাঁড়ান মমতা। তাঁকে জিটিএর চেয়ারম্যান করেন। মুছে যেতে শুরু করে বিমল গুরুংয়ের নাম।

এই পৃথক গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে ২০১৭ সালের জুন থেকে ১০৭ দিন একটানা বন্‌ধের পর ২৭ সেপ্টেম্বর বন্‌ধ্‌ প্রত্যাহার করে নেন গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার সভাপতি বিমল গুরুং। যদিও জনমুক্তি মোর্চার বিদ্রোহী নেতা বিনয় তামাং মুখ্যমন্ত্রী মমতার ডাকে সাড়া দিয়ে বন্‌ধ্‌ প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন আগে। মমতাও বিমল গুরুংকে প্রত্যাঘাত করে সহযোগিতা করেন বিনয় তামাংকে। এবার সেই দার্জিলিংয়ে আবার পৃথক গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছেন বিমল গুরুং। আর আন্দোলন শুরু হয়েছে দার্জিলিংয়ের স্বশাসিত পরিষদ জিটিএর নির্বাচনের বিরোধিতা করে।