এক ‘সুপারমম’ বাঘিনীর গল্প

গত সপ্তাহান্তে মারা যায় ‘কলারওয়ালি’
ছবি: এএফপি

ভারতের ‘সুপারমম’ বাঘিনী কোনো সাধারণ বাঘিনী ছিল না।

বাঘিনীটি ভারতে ‘কলারওয়ালি’ নামে পরিচিত ছিল। দেশটির অন্যতম জনপ্রিয় এই বাঘিনীটি ১৬ বছর বয়সে গত সপ্তাহান্তে মারা যায়।

ভারতের মধ্যপ্রদেশের পেঞ্চ টাইগার রিজার্ভ পার্ক ছিল বাঘিনীটির বসতি। এই অভয়ারণ্যের হালচাল পরিবর্তনে বাঘিনীটি বড় ভূমিকা পালন করে।

বাঘিনীটির গলায় ২০০৮ সালে প্রথম রেডিও-কলার বসানো হয়েছিল। মূলত তার পর থেকেই তাকে ‘কলারওয়ালি’ নামে ডাকা শুরু হয়।

‘কলারওয়ালি’ তার জীবদ্দশায় ২৯টি শাবকের জন্ম দেয়। এক বিশেষজ্ঞের মতে, এতগুলো শাবকের জন্ম দেওয়াও বিরল ঘটনা। বাঘিনীটি একটি সমৃদ্ধ উত্তরাধিকার রেখে গেছে।

‘স্পাই ইন দ্য জঙ্গল’ নামের বিবিসি ওয়াইল্ডলাইফ তথ্যচিত্রে উঠে আসার পর ভারতের অন্যতম বিখ্যাত বাঘিনী হয়ে ওঠে ‘কলারওয়ালি’।

তথ্যচিত্রটি প্রচারিত হওয়ার পর পেঞ্চ পার্কে দর্শনার্থীদের আগমন অনেক বেড়ে যায়। এই দর্শনার্থীদের অনেকেরই আগ্রহের মূলে ছিল ‘কলারওয়ালি’। প্রকৃতিবিদ প্রবীর পাতিল এমনটাই জানান।

বার্ধক্যজনিত জটিলতায় গত শনিবার সন্ধ্যায় ‘কলারওয়ালি’ মারা যায়। তার মৃত্যুর খবর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও স্থান পায়।

প্রকৃতিবিদ, বন কর্মকর্তা, বন্য প্রাণী ফটোগ্রাফারদের কাছে এই বাঘিনীটি অত্যন্ত প্রিয় একটি প্রাণী ছিল। কারণ, তাঁরা তাঁদের চোখের সামনেই বাঘিনীটিকে পেঞ্চ পার্কে বেড়ে উঠতে দেখেছেন।

বাঘিনীটির জন্ম ২০০৫ সালে। জন্মের পর তার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘টি-১৫’। রেডিও কলার লাগানোর পর সে হয়ে যায় ‘কলারওয়ালি’। এই রেডিও কলারের মাধ্যমে বাঘিনীটিকে কয়েক বছর ধরে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ হয়েছিল।

বন্য প্রাণীপ্রেমীদের অনেকে বাঘিনীটিকে আদর করে ‘মাতরম’ বা ‘শ্রদ্ধেয় মা’ বলে ডাকতেন। অনেকগুলো শাবক জন্ম দেওয়ার জন্যই তাকে এই নামে ডাকা হতো।

প্রকৃতিবিদ প্রবীর পাতিল বলেন, কলারওয়ালির জন্মের আগে পেঞ্চ পার্কে বাঘের দেখা মেলা ছিল ভার। কিন্তু অচিরেই সে এই পার্কের সবচেয়ে বেশি দেখা দেওয়া বাঘে পরিণত হয়।

বন্য প্রাণী সংরক্ষণবাদী বিবেক মেনন এই বাঘিনীটিকে ‘পেঞ্চের মুখ’ বলে অভিহিত করেন। বিবেক মেননের মতে, বাঘিনীটির স্বভাব-প্রকৃতি এমন ছিল, যা দর্শনার্থী ও ফটোগ্রাফারদের আকৃষ্ট করত।

মোহাম্মদ রফিক শেখ একজন প্রকৃতিবিদ। তিনি পেঞ্চের দোরগোড়াতেই বেড়ে উঠেছেন। তিনি বলেন, পেঞ্চে আসা দর্শনার্থীদের খুব কমই হতাশ করত কলারওয়ালি।

রফিক শেখ বলেন, কলারওয়ালি ছিল একটি বন্ধুসুলভ প্রাণী। সে কোনো ভয় ছাড়াই পর্যটকদের গাড়ির খুব কাছাকাছি চলে আসত।

প্রকৃতিবিদ প্রবীর পাতিল বলেন, কলারওয়ালি নানাভাবে বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিল। সে তার নিজস্ব এলাকা ছেড়ে অন্যত্র খুব কমই গিয়েছে। মৃত্যুর আগপর্যন্ত সে দাপিয়ে বেরিয়েছে পেঞ্চেই।

প্রবীর পাতিল বলেন, কলারওয়ালি আকার-আকৃতিতে এতটাই বড় ছিল যে অন্য বাঘেরা তার সঙ্গে লড়াই করতে ভয় পেত। কখনো কখনো পেঞ্চে আসা অন্যান্য অভয়ারণ্যের কর্মকর্তারা কলারওয়ালির আকারের কারণে তাকে একটি পুরুষ বাঘ বলে ভুল করতেন।

কলারওয়ালি মোট ২৯টি শাবকের জন্ম দেয়। যার মধ্যে ২৫টি বেঁচে যায়। ভারত তো বটেই, সম্ভবত বিশ্বেও এটি একটি রেকর্ড।

কলারওয়ালির প্রথম তিনটি শাবক নিউমোনিয়ায় মারা যায় ২০০৮ সালে। বাকি শাবকগুলোকে কলারওয়ালি লালন-পালন করে বড় করে তোলে।

বেশির ভাগ বাঘিনী তাদের শাবকদের দুই বছরের বেশি সময় ধরে নিজেদের সঙ্গে রাখে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কলারওয়ালি ছিল ব্যতিক্রম। সে তার শাবকদের আগেই স্বাধীনভাবে বড় হতে উৎসাহিত করে। যেখানে প্রচুর শিকার ছিল, সেখানে শাবকদের ছেড়ে দিত সে।

পেঞ্চ টাইগার রিজার্ভ পার্কের পশুচিকিত্সক অখিলেশ মিশ্র। তিনি বেশ কয়েকবার কলারওয়ালির চিকিৎসা করেন। তিনি বলেন, কলারওয়ালি শক্তিশালী মা ছিল। সে কখনো কখনো তার শাবকদের খাওয়ানোর জন্য দিনে দুটি শিকার করত।

পেঞ্চ যে একটি টাইগার রিজার্ভ পার্কে পরিণত হয়েছে, তার জন্য কলারওয়ালিকে কৃতিত্ব দেন বিবেক মেননের মতো বন্য প্রাণী সংরক্ষণবাদীরা। তিনি বলেন, এই পার্কে বাঘের সংখ্যা বাড়িয়েছে কলারওয়ালি। এখন পার্কে যে বাঘ আছে, তা তার উত্তরাধিকারের অংশ। তার বংশধরেরাও পার্কে বাঘের সংখ্যা বাড়াচ্ছে।

গত রোববার রিজার্ভের একটি খোলা মাঠে কলারওয়ালির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হয়। পার্কের কর্মী, প্রকৃতিবিদ ও স্থানীয় লোকজন শোকার্ত হয়ে তাকে ফুল দিয়ে শেষবিদায় জানায়।

রিজার্ভের কর্মীরা কলারওয়ালিকে নিয়ে একটি ভিডিও তৈরি করেছেন। এই ভিডিওর পর্দায় ভেসে উঠতে দেখা যায় ‘প্রিয় কলারওয়ালি’ শব্দ।

প্রকৃতিবিদ রফিক শেখ বলেন, ‘সে (কলারওয়ালি) একটি পূর্ণ ও সুখীজীবন কাটিয়ে গেছে। আমরা তার মৃত্যুতে শোকাহত। কিন্তু সে আমাদের হৃদয়ে বেঁচে থাকবে।’

বিবিসি অনলাইন অবলম্বনে