ভারত
এবার এল ‘গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ডের’ রাজনীতি
তিপ্রা জনগোষ্ঠী ভারতের ত্রিপুরার বাইরেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় আছে আসাম ও মিজোরামে। আছে বাংলাদেশেও। গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ডের দাবি নিয়ে উদ্বেগ অঞ্চলজুড়ে।
দাপ্তরিকভাবে ত্রিপুরা ভারত রিপাবলিকের অংশ—যেখানে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাই এখন প্রশাসন চালান। কিন্তু ত্রিপুরার তিপ্রারা প্রদ্যোত কিশোর দেববর্মাকে ‘মহারাজা’ই মনে করে। বাংলাদেশে ‘টিপরা’ শব্দটি প্রচলিত হলেও ত্রিপুরায় তা আসলে ‘তিপ্রা’। ভারতীয় ক্ষুদ্র এই রাজ্যে তিপ্রাদের ওপর প্রদ্যোতের প্রভাব জাদুর মতো কাজ করছে এবং আশপাশের অঞ্চলে গভীর এক রাজনৈতিক তাৎপর্য নিয়ে হাজির হচ্ছে সেটা। ত্রিপুরাকে কেন্দ্র করে ‘গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ড’ গড়তে চান প্রদ্যোত। তাঁর এই আহ্বান রাজ্য-ত্রিপুরা এবং তার বাংলাভাষীদের গভীর উদ্বেগে ফেলেছে। বাংলাদেশকেও ভাবাচ্ছে সেখানকার অনাগত পরিস্থিতি।
হারানো রাজবংশের নতুন ‘মহারাজা’
ত্রিপুরার অতীত রাজপরিবারের সর্বশেষ বংশধর প্রদ্যোত। তাঁর বাবা কীর্তি বিক্রম কিশোর মাণিক্য, ত্রিপুরা রাজবংশের ১৮৫তম এবং শেষ রাজা। সেই সিলসিলায় প্রদ্যোত বংশের ১৮৬তম প্রধান। প্রদ্যোতের দাদা কিশোর দেববর্মার আমলেই এই রাজ্য ভারতভুক্ত হয়। এ সময় ত্রিপুরা চালাতেন মূলত তাঁর মা কাঞ্চন প্রভা দেবী। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম পুরোনো রাজবংশ এটা। শত শত বছরের জীবন্ত ইতিহাস রয়েছে এ বংশের। এক কালে খাসিয়া পাহাড় থেকে উত্তর আরাকান পর্যন্ত ছিল তাদের প্রভাব। তিপ্রাদের সেই স্মৃতির প্রতীক প্রদ্যোত। সেই সূত্রেই তিনি এই জনগোষ্ঠীর সর্বশেষ ‘মহারাজা’। তবে এই মহারাজা গতানুগতিক নন, আমলাতান্ত্রিকও নন। ত্রিপুরার প্রান্তিক অঞ্চল পর্যন্ত ট্রাইবালদের সঙ্গে তাঁর যোগসূত্র আছে। বোঝা যায়, পরিবারের সামন্ততান্ত্রিক খোলস ছেড়ে রাজনীতি করা তাঁর বিশেষ লক্ষ্য ছিল। কেবল স্মৃতির মাঝে থাকতে চান না এই যুবক। নিজেকে ‘রাজনীতিবিদ’ও বলতে নারাজ। ‘অ্যাকটিভিস্ট’ বললে খুশি হন।
‘তিপ্রা মথা’র নাটকীয় আবির্ভাব
প্রদ্যোতকে ২০১৯-এ রাজ্য কংগ্রেসের সভাপতি করেছিলেন রাহুল গান্ধী। এর আগে ছাত্ররাজনীতি করেছেন তিনি। সাংবাদিকতাও করেছেন। দ্য নর্থইস্ট টুডে নামে তাঁর একটা সংবাদমাধ্যম ছিল। প্রদ্যোতের পিতার আমল থেকে এই পরিবার কংগ্রেসভুক্ত। রাজা কীর্তি কংগ্রেস থেকে লোকসভার সদস্য ছিলেন চারবার। প্রদ্যোতের বোন ‘রাজকুমারী’ প্রজ্ঞা গত লোকসভা নির্বাচন করেছেন কংগ্রেস থেকেই। কিন্তু রাজ্য কংগ্রেসের সভাপতি হওয়ার বছরই প্রদ্যোত দলটি ছাড়েন। তাঁর অভিযোগ, জাতীয় দলগুলো অঞ্চলকে তাদের মতো করে দেখতে চায়। প্রদ্যোত চাইছেন ত্রিপুরার মতো প্রান্তিক অঞ্চলের ক্ষমতায়ন। বিশেষ করে ট্রাইবালদের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব। তারই জের, কংগ্রেস ছাড়ার পরই তিনি পাহাড়ি-ত্রিপুরায় কম্পন তুলেছেন।
উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোর ভোটে কংগ্রেসের নিরাপদ এলাকা ছিল বহুকাল। সেটা ভাঙতেই এনআরসি-কার্ড নিয়ে আসে বিজেপি। এসব এলাকার ট্রাইবালরা তাতে একাত্মতা প্রকাশ করে। কিন্তু বিজেপি যখন এনআরসির পাশাপাশি নতুন নাগরিকত্ব আইনে হিন্দুদের ওসব অঞ্চলে নাগরিকত্ব দিতে চেয়েছে, তখন এনআরসির বিরোধিতায় নামে স্থানীয় ওই সমর্থকেরাই।
কংগ্রেস জাতীয়ভাবে এনআরসির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। এতে প্রদ্যোত দেববর্মার সায় ছিল না। কারণ, তাতে তিপ্রা সমাজে তাঁর অবস্থান থাকে না। তিনি নিজেও চান উত্তর-পূর্ব ভারতে এনআরসি হোক। এভাবেই তাঁর কংগ্রেসজীবনের ইতি ঘটে। এরপর গত ফেব্রুয়ারিতে ইন্ডিজিনিয়াস প্রোগ্রেসিভ রিজিওনাল অ্যালায়েন্স (‘টিআইপিআরএ’ বা তিপ্রা) নামে একটা দল গড়েন প্রদ্যোত। সংক্ষেপে ডাকা হচ্ছে ‘তিপ্রা মথা’ বলে। মথা অর্থ ‘ঐক্য’। তিপ্রা-মথা নামের ব্যঞ্জনা ত্রিপুরার ট্রাইবাল সমাজে ইতিমধ্যে ইতিবাচক আবেদন তুলেছে। নবীন দল হিসেবে তিপ্রা ত্রিপুরার ভেতর-বাইরে সব জায়গার ত্রিপুরিদের নিয়ে গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ড করতে চায়। যার ভরকেন্দ্র হবে ত্রিপুরার এখনকার স্বশাসিত ‘এডিসি এলাকা’। প্রদ্যোতের এই আওয়াজের পরই ত্রিপুরার ভেতর-বাইরে ত্রিপুরিদের পাড়ায় পাড়ায় এখন রাজনৈতিক আলোচনার মূল বিষয় তিপ্রা-মথা।
প্রথম নির্বাচনেই প্রদ্যোতের বাজিমাত
প্রদ্যোত কংগ্রেস ছাড়ায় বিজেপি উল্লসিত ছিল। কিন্তু প্রদ্যোত-ঝড়ে প্রথমেই সর্বনাশ হয় তাদের। রাজ্যে ট্রাইবালদের স্বশাসিত যে কাউন্সিল রয়েছে, স্থানীয়ভাবে যাকে বলা হয় ‘এডিসি এলাকা’, তার নির্বাচনে প্রদ্যোতের দল তিপ্রা-মথা ২৮টি আসনের ১৮টিতেই জিতে গেছে। ‘ত্রিপুরা ট্রাইবাল এরিয়াস অটোনোমাস ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিলে’র ওই নির্বাচনে বিজেপির প্রধান প্রতিপক্ষ ছিল তিপ্রা-মথা। রাজ্যে বিজেপিই ক্ষমতায়। কিন্তু তিপ্রা-মথার সামনে শক্তভাবে দাঁড়াতে পারেনি তারা। মাত্র ৯টি আসন পেয়েছে। সব আসন মিলে তারা প্রদত্ত ভোটের ১৯ ভাগ পেয়েছে। তিপ্রা-মথা একাই ৩৭ ভাগ ভোট পায়।
নির্বাচনে বড় সর্বনাশ হয়েছে বামেদের। তারা মাত্র ১৫ ভাগ ভোট পায়। অথচ স্বশাসিত এই কাউন্সিলে দুই দশক ধরে তারা ক্ষমতায় ছিল। এই কাউন্সিল করেছিল তারাই। সব মিলিয়ে ৩৯ বছর বয়সী এডিসি এলাকায় ২৮ বছর বামেরা সেখানে শাসন করেছে। ২০১৮ সালের আগে পুরো ত্রিপুরাও তারা শাসন করেছে ২৫ বছর। ত্রিপুরায় বামপন্থার শুরুও ট্রাইবাল এরিয়ায়, বাংলাভাষীদের মাঝে নয়। দশরথ দেববর্মা সেই সংগঠনের গোড়াপত্তন করেছিলেন। কিন্তু কালে কালে বাম দলের নেতৃত্বে বাংলাভাষীদের আধিপত্য বেড়েছে। তাতে দূরত্বে সরেছে পাহাড়িরা। দশরথের পর ট্রাইবাল কোনো বামপন্থী আর এখানে মুখ্যমন্ত্রী হননি। বামেদের শাসনে অনেক উন্নয়ন হয়েছে পাহাড়ি এলাকায়। কিন্তু পরিচয়ের রাজনীতির হাওয়ায় এখন এই জনপদ মহারাজা প্রদ্যোতের অধীনে চলে এল এখন।
স্বশাসিত ট্রাইবাল কাউন্সিল ত্রিপুরার প্রায় ৬৮ ভাগ ভূমি নিয়ে গঠিত। তবে তিপ্রারা সমগ্র ত্রিপুরার জনসংখ্যার তিন ভাগের এক ভাগ মাত্র। প্রদ্যোতের লক্ষ্য এখন ট্রাইবাল কাউন্সিলের বাইরের তিপ্রাদের দিকে। তাঁর কথা ‘আমি প্রত্যেক তিপ্রাকে সঙ্গে চাই’।
তিপ্রা জাতীয়তাবাদের জোয়ার তুলে প্রদ্যোত আসলে বিজেপির ট্রাইবাল মিত্রদের রাজনীতিই ছিনতাই করলেন। তিপ্রাল্যান্ড দাবিটি এত দিন বিজেপির ভোটসঙ্গী ‘ইন্ডিজিনাস পিপলস ফ্রন্ট অব ত্রিপুরা’ বা আইপিএফটিরই মূল অ্যাজেন্ডা ছিল। ত্রিপুরার পাহাড়ে পাহাড়ে বামেদের নিশ্চিহ্ন করতে বিজেপি আইপিএফটিএফকে দিয়ে সেখানে পৃথক রাজ্যের প্রত্যাশা ছড়ায়। কিন্তু আগরতলাকেন্দ্রিক বাংলাভাষীদের ভোট যাতে বড় অঙ্কে ছুটে না যায়, সে জন্য এই দাবির প্রতি তারা এখন পক্ষপাত দেখাচ্ছে মৃদু ভঙ্গিতে। প্রদ্যোত চাইছেন সেই শূন্যতা সজোরে পূরণ করতে।
বাংলাভাষী আর তিপ্রাদের মধ্যে নতুন বিভেদ রেখা
প্রদ্যোত চারদিকে বার্তা দিচ্ছেন, মাণিক্য বংশের আমলে ত্রিপুরার সব জনজাতি বেশ সুরক্ষিত ছিল। কেন্দ্র ও রাজ্যের পরের শাসকেরা সেই সুদিন নষ্ট করেছে। এখন তিনি ত্রিপুরার রাজনীতিকে দিল্লি ও আগরতলার আধিপত্য মুক্ত করতে চান। তাঁর এই কথায় বিদ্যুৎ আছে। সেই বিদ্যুতের ঝলকে আকৃষ্ট হচ্ছে তিপ্রা তারুণ্য। যারা ৮০-৯০ ভাগই রাজনৈতিক কাঠামোর বাইরের মানুষ। তিপ্রা-মথার হয়ে ট্রাইবাল কাউন্সিলে যে ১৮ জন জিতলেন, তাঁদের মধ্যে ৪২ বছর বয়সী প্রদ্যোতই বয়োজ্যেষ্ঠ। এই দলের শক্তি ও দুর্বলতা উভয়ই প্রদ্যোত। তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির তথ্য নেই। সন্ত্রাসী কোনো ভাবমূর্তিও নেই। উপরন্তু তিনি ট্রাইবালদের স্বশাসনের কথা বলছেন গণতান্ত্রিক কাঠামোর আওতায়। ফলে প্রদ্যোতকে মোকাবিলায় বিজেপি থেকে বামফ্রন্ট—কারও হাতে বিশেষ কোনো অস্ত্র নেই। কিন্তু বাংলাভাষী সমাজে তাঁর ভোট নেই। বাংলাভাষীদের বাদ দিয়েই ত্রিপুরার ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবছেন তিনি। ‘নিজের মানুষ’ বলতে তাঁর আছে কেবল তিপ্রারা। প্রদ্যোত সচেতনভাবে এই তথ্যও আড়াল করেন, মাণিক্য বংশের শেষ রাজারাই ত্রিপুরায় বাংলাভাষীদের আগমনকে উৎসাহিত করেছিলেন ধান আবাদ বাড়াতে। বাংলার সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সাতবার অতিথি করেছিল ওই রাজবংশ। আগরতলায় তাদের প্রাসাদের নামও রবীন্দ্রনাথেরই দেওয়া। মাণিক্যদের রাজ্যে তিপ্রাদের সঙ্গে বাংলাভাষীদের ঐতিহাসিক বন্ধনের সাক্ষী এসব। যদিও এখন ভোটের অঙ্কে হিংসা-বিদ্বেষ মেশানো পরিচয়ের রাজনীতির কদর বেশি। প্রদ্যোত অবশ্য তাঁদের রাজনীতিকে ওভাবে শনাক্ত করতে অনিচ্ছুক। এই জুনে কারাভান ম্যাগাজিনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তাঁর মন্তব্য: ‘আমরা তিপ্রাদের ওপর সংঘটিত পুরোনো অন্যায়ের ভারসাম্য খুঁজছি মাত্র।’ জাতীয় দলগুলোকে ভোট না দিলে এলাকায় উন্নয়ন হয় না—এই প্রশাসনিক সংস্কৃতিরও বিরুদ্ধে তিনি। তাঁর ভাষায়, ‘জাতীয় অর্থ’ নিতে গিয়ে আমরা জাতির পরিচয় ও ভূমি ছেড়ে দিয়েছি। এভাবেই উত্তর-পূর্বাঞ্চল বদলে গেছে।
ছোট রাজ্য হলেও রাজনৈতিক সহিংসতায় ভারতে ত্রিপুরার কুখ্যাতি কম নয়। প্রদ্যোত উত্তপ্ত ঐতিহ্যে নতুন ধারার সূত্রপাত ঘটিয়েছেন। তিনি সচরাচর কংগ্রেস, কমিউনিস্ট এবং বিজেপি—কারও বিরুদ্ধে তেমন কিছু বলেন না, বরং তাঁর দল কী করতে চায় সেদিকেই জোর দেন। তাঁর ভাষায়, এভাবে নতুন ধারার এক ‘পজিটিভ রাজনীতি’র চেষ্টায় আছেন তিনি। তবে জনজীবনের আর্থসামাজিক সমস্যার মোকাবিলায় প্রদ্যোত ঠিক কী করতে চান, সেসব বিস্তারিত কোনো কর্মসূচি আকারে নেই তাঁর কাছে। তাঁর তিপ্রাল্যান্ডেরও কোনো বাস্তব চেহারা তিনি এখনো স্পষ্ট করেননি। পরিচয়বাদী রাজনীতির প্রধান সুবিধা এটাই। জনগণকে বিশেষ আবেগের মোহে সঙ্গে রাখা যায়। বাস্তব কোনো কর্মসূচি না দিলেও চলে। তা ছাড়া প্রদ্যোত নিজে বক্তৃতা-বিবৃতিতে উসকানিমূলক না হলেও তাঁর কর্মীরা প্রতিপক্ষকে অনেক জায়গাতেই আক্রমণ করছে। রীতিমতো শরণার্থীশিবির খুলে আক্রান্তদের আশ্রয় দিতে হয়েছে। এ রকম পরিস্থিতি আগামী বিধানসভার আগে অনেক উত্তেজক রূপ নেবে বলে রাজ্যবাসীর শঙ্কা। প্রদ্যোত অবশ্য জানিয়ে রেখেছেন, তিপ্রাল্যান্ড পেলে তিনি আর রাজনীতিতে থাকবেন না। তাঁর এই ঘোষণাতেও মিশে আছে পরিচয়ের রাজনীতির গভীর ভাবাবেগ।
সবার নজর ২০২৩-এর ভোটের দিকে
নতুন দল গড়ার সময় প্রদ্যোতের সঙ্গে হেভিওয়েট কোনো রাজনীতিবিদ ছিল না। এখন ট্রাইবাল সমাজে তাঁর সর্বগ্রাসী আবেদন। পুরোনো তিপ্রা রাজনীতিবিদেরা ধীরে ধীরে যুক্ত হচ্ছে নতুন দলে। ত্রিপুরায় সবার চোখ ২০২৩-এর দিকে। ওই বছর বিধানসভা নির্বাচন হবে। কংগ্রেস, বামফ্রন্ট এবং বিজেপির ত্রিমুখী গণিতের অনেক হিসাব এখন আর মিলছে না প্রদ্যোতের আবির্ভাবে। প্রদ্যোতকে ঘিরে ভবিষ্যতে ট্রাইবাল দলগুলোর একটা জোট হবে বলেই অনুমান করা যায়। এর বিপরীতে থাকবে কংগ্রেস ও তৃণমূল। বর্তমান শাসক দল বিজেপি এবং অতীতের শাসক বামেরাও পৃথক পৃথক অবস্থান থেকে প্রদ্যোতকে মোকাবিলার কৌশল খুঁজছে। এ রকম সমীকরণে প্রদ্যোত হয়তো কেন্দ্রের সঙ্গে এবং পাশাপাশি রাজ্যের বাঙালি নেতাদের সঙ্গে দর-কষাকষি করে বিধানসভায় তিপ্রাদের জন্য বাড়তি সংরক্ষণ আদায় করতে চাইবেন। ৬০ সদস্যের বিধানসভায় প্রায় অর্ধেক আসন ট্রাইবালদের প্রভাবে আছে। তার মধ্যে ২০টি তাদের জন্যই সংরক্ষিত। পাহাড়ি দলগুলোকে এক ছাতার নিচে আনতে পারলে প্রদ্যোতের পক্ষেÿরাজনীতিতে বাংলাভাষী নেতাদের কোণঠাসা করা কঠিন হবে না। সেই দূরবর্তী প্রস্তুতি হিসেবেই এডিসি এলাকায় সদস্য হিসেবে ভোটে জিতেও প্রদ্যোত সেখানে মুখ্য নির্বাহী সদস্য বানিয়েছেন দলের পূর্ণচন্দ্র জমাতিয়াকে। অথচ সবাই ধরে রেখেছিল, তিনিই কাউন্সিলে মুখ্য পদে বসবেন। বোঝা যায়, মহারাজা দুই বছর পরের অধ্যায় নিয়ে ভাবছেন। যদিও তাঁর ভরসা কেবল রাজ্যের ৩১ ভাগ ভোট। বাংলাভাষী বাকি ভোটারদের দিকে বামফ্রন্ট, বিজেপি এবং কংগ্রেসের পর নতুন করে নজর বাড়াচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের ‘দিদি’র দল। তবে ২০২৩-এ ত্রিপুরার ভোটের আগ পর্যন্ত ভারতজুড়ে আরও ৯ রাজ্যে নির্বাচন হবে। তত দিনে ত্রিপুরায় ভোটের রসায়ন কী দাঁড়াবে, সেটা এখনই অনুমান করা শক্ত।
গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ডের দাবি ভাবাচ্ছে অঞ্চলজুড়ে অনেককে
তিপ্রা জনগোষ্ঠী ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের বাইরেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় আছে আসাম ও মিজোরামে। আছে বাংলাদেশেও। প্রদ্যোতের গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ডের আওয়াজ তাই বাংলাদেশের কানেও এসেছে। ত্রিপুরার তিন দিকেই বাংলাদেশ। এ দেশেও লক্ষাধিক তিপ্রা আছে। সমগ্র তিপ্রা জনগোষ্ঠীর ১০ ভাগের ১ ভাগ হবে সেটা। গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ডের রাজনীতি নিয়ে প্রদ্যোত কতটা সিরিয়াস, সেটা ভবিষ্যতে বোঝা যাবে। গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ড বলতে তিনি ভৌগোলিক কিছু বুঝিয়েছেন নাকি সাংস্কৃতিক কিছু—সেটাও স্পষ্ট হওয়া বাকি। কিন্তু ভবিষ্যতে এটা বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে নতুন এক উত্তেজক উপাদান হওয়ার শঙ্কা থাকছেই। এর বাইরে প্রদ্যোতের সফলতা উত্তর-পূর্ব ভারতে বাংলাভাষী-বৈরিতার পালেও বাতাস জোগাতে পারে।
আলতাফ পারভেজ: দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক