করোনায় ভারতের ধনকুবেরেরা কে কোথায়

গৌতম আদানি ও মুকেশ আম্বানি

বৈশ্বিক করোনাভাইরাস মহামারির কেন্দ্র হয়ে ওঠা ভারতে এখন চলছে জীবন বাঁচানোর লড়াই। সে লড়াইয়ে যাঁদের হাতে অর্থ আছে, তাঁরা লাখ লাখ রুপি খরচ করে উড়োজাহাজ ভাড়া করে পাড়ি জমিয়েছেন বিদেশে। এ তালিকায় বিত্তশালীদের পাশাপাশি বলিউড তারকারাও রয়েছেন।

দেশটির শীর্ষস্থানীয় ধনকুবেরদের অনেকে দেশে থাকলেও বড় বড় শহরের আবাস ছেড়ে তাঁরা আশ্রয় নিয়েছেন কম ঘনবসতির এলাকাগুলোতে। আবার কেউ কেউ বাসভবনে পরিবারের সদস্য ও জরুরি প্রয়োজনের কর্মীদের নিয়ে সুরক্ষাবলয় তৈরির চেষ্টা করছেন।

ভারতীয় বিত্তবানদের লাখ লাখ টাকা খরচ করে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধান শুরু হয়েছিল কিছুদিন আগেই। গত মার্চের মাঝামাঝিতেও ভারতে এক দিনে শনাক্ত করোনা রোগীর সংখ্যা ছিল ২০ হাজারের কাছাকাছি।

তারপর দেশটিতে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে সংক্রমণ। এক মাসের মধ্যেই দিনে আক্রান্তের সংখ্যা তিন লাখের কাছাকাছি পৌঁছে যায়। গত সপ্তাহে দেশটিতে দৈনিক শনাক্ত রোগীর সংখ্যা সাড়ে তিন লাখের বেশি হয়। এর মধ্যে এক দিন চার লাখ করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে দেশটিতে।

করোনার সংক্রমণে বিপর্যস্ত ভারত। আহমেদাবাদের একটি হাসপাতালের বাইরে
ছবি: রয়টার্স

করোনার এ ধাক্কায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে ভারতের স্বাস্থ্যব্যবস্থা। সবচেয়ে বেশি বেসামাল দিল্লির হাসপাতালগুলোতে নতুন রোগী ভর্তি দুষ্কর হয়ে পড়ে। সেখানে অক্সিজেনের অভাবে অনেক রোগীর মৃত্যু হয়। অক্সিজেন ও হাসপাতালের শয্যার সন্ধান চেয়ে আকুতিতে ভরে ওঠে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো। হাসপাতালে অক্সিজেনের অভাবে মৃত্যু ঘটেছে কর্ণাটক রাজ্যেও। অন্যান্য শহরেও টালমাটাল অবস্থা তৈরি হয়েছে।

করোনার এই বিধ্বংসী রূপের মধ্যে ভারতীয় অনেক ধনকুবের ও বিত্তশালীরা লাখ লাখ রুপি ব্যয়ে ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও ভারত মহাসাগরীয় দেশগুলোতে যাওয়ার জন্য ভাড়ায় ফ্লাইট বুকিং দিতে থাকেন। এ পরিস্থিতি নিয়ে নয়াদিল্লিভিত্তিক বেসরকারি বিমান পরিবহন প্রতিষ্ঠান ক্লাব ওয়ান এয়ারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রজন মেহরা আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গকে বলেন, ‘শুধু অতিধনীরাই নন, যাঁদেরই সামর্থ্য আছে তাঁরাই ব্যক্তিগতভাবে উড়োজাহাজ ভাড়া করছেন।’

গত মাসে ভারতে করোনা পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকলে উড়োজাহাড় ভাড়া করে দেশ ছাড়ার হিড়িক পড়ে
ছবি: রয়টার্স

বলিউড তারকাদের অনেকে মালদ্বীপসহ বিভিন্ন দেশে গেছেন। করোনা পরিস্থিতি গুরুতর হওয়ার পর গত মাসের শেষ দিকে কানাডা, হংকং, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাজ্যসহ ডজনখানেকের বেশি দেশ ভারত থেকে ভ্রমণে বিধিনিষেধ আরোপ করে।

এর মধ্যে মালদ্বীপের পক্ষ থেকে বলা হয়, গত ২৭ এপ্রিল থেকে ভারতীয়দের জন্য সব জায়গায় ভ্রমণ বন্ধ হবে, তাঁরা শুধু গুটিকয় রিসোর্ট–সংবলিত দ্বীপে ঘুরতে পারবেন। আর এতেই শেষমুহূর্তে ভাড়া করা বিমানে দেশটিতে যাওয়ার তোড়জোড় লেগে যায়।

এর আগে ভারতে কাতার এয়ারওয়েজের কার্যক্রম পরিচালনায় নেতৃত্ব দিয়ে আসা মেহরা বলেন, ‘বিধিনিষেধ আরোপের আগে আগে লন্ডন ও দুবাইয়ে যাত্রীদের ঢল নামে। নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার আগে মালদ্বীপও হয়ে ওঠে বহু মানুষের গন্তব্য।’ তাঁর দেওয়া তথ্যমতে, নয়াদিল্লি থেকে দুবাইয়ের ফ্লাইটে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং ও অন্যান্য ফিসহ খরচ পড়ে ১৫ লাখ রুপি পর্যন্ত। সেখানে প্রাইভেট বিমান ভাড়া দেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো ফিরতি ফ্লাইটের চার্জও নিয়েছে।

প্রাইভেট উড়োজাহাজ পেতে মানুষের আগ্রহ ‘পাগলামির পর্যায়ে’ পৌঁছানোর কথা জানান এয়ার চার্টার সার্ভিস ইন্ডিয়ার একজন মুখপাত্র। তিনি জানান, লোকজন নিজেরাই দল গুছিয়ে তাঁদের বিমান ভাড়া করেন। বিমানের একটা সিট পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন তাঁরা।

সানডে টাইমসের তথ্য অনুযায়ী, ২৪ এপ্রিল এক দিনেই ভারত থেকে আটটি প্রাইভেট বিমান যুক্তরাজ্যের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। ৯ ঘণ্টার এই যাত্রার জন্য বিমানপ্রতি ১ লাখ ৩৮ হাজার ডলারের বেশিও গুণতে হয়।

ধনকুবেরদের মধ্যে যাঁরা বিদেশে যাননি, তাঁরা দেশের মধ্যেই নিরাপদ আশ্রয় তৈরির চেষ্টা করছেন। ভারতের আইটি জায়ান্ট ইনফোসিস লিমিটেডের সহপ্রতিষ্ঠাতা বিলিয়নিয়ার ক্রিস গোপালাকৃষ্ণান বেঙ্গালুরুতে পরিবারের সদস্য ও স্টাফদের নিয়ে ঘরবন্দী হয়েছেন।

ইনফোসিস লিমিটেডের সহপ্রতিষ্ঠাতা ক্রিস গোপালাকৃষ্ণান
ছবি টুইটার থেকে নেওয়া

তাঁর বরাত দিয়ে এনডিটিভি জানিয়েছে, এই প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বাইরে গিয়ে যোগাযোগ পরিহার করা হচ্ছে। শুধু ঘরে তৈরি খাবারই তাঁরা খাচ্ছেন। ইনফোসিসের আরেক সহপ্রতিষ্ঠাতা নন্দন নিলেকানিও এই শহরে নিজের ঘরে বন্দী হয়ে আছেন।

ভারতের সবচেয়ে দামি স্টার্টআপ অনলাইন এডুকেশন প্রোভাইডার বিজু’সের প্রতিষ্ঠাতা বিজু রবীন্দ্রনও বেঙ্গালুরুর আশপাশে নিজেদের বাড়িতে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে থাকছেন।

এনডিটিভি প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারতের সবচেয়ে ধনী দুই ব্যক্তি আবাস পাল্টে দেশের কম ঘনবসতির এলাকায় আশ্রয় নিয়েছেন। এশিয়ার সবচেয়ে ধনী মুকেশ আম্বানি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ভারতের বাণিজ্যিক কেন্দ্র মুম্বাই থেকে গুজরাটের জামনগর শহরতলিতে ঠাঁই নিয়েছেন।

এশিয়ার শীর্ষ ধনী মুকেশ আম্বানি মুম্বাই ছেড়ে গুজরাটের একটি ঘনবসতির এলাকায় আশ্রয় নিয়েছেন
ছবি: রয়টার্স

সেখানে তাঁর মালিকানাধীন রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের বড় দুই তেল পরিশোধনাগার কমপ্লেক্স রয়েছে।

অপরজন ভারতের দ্বিতীয় শীর্ষ ধনী গৌতম আদানি ছেলে ও পরিবারের ঘনিষ্ঠজনদের নিয়ে গুজরাটের আহমেদাবাদের উপকণ্ঠে নিজেদের বাড়িতে উঠেছেন।

আদানি গ্রুপের মালিক গৌতম আদানি
ছবি ফেসবুক থেকে নেওয়া

তবে এই দুঃসময়ে দেশের মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করছেন ভারতীয় এই বিত্তবানেরা। আম্বানির রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ তাঁদের তেল পরিশোধনাগার কমপ্লেক্স থেকে অক্সিজেন দিচ্ছে করোনা রোগীদের চিকিৎসাসেবার জন্য। এই গ্রুপের দাতব্য শাখা রিলায়েন্স ফাউন্ডেশন করোনা রোগীদের চিকিৎসাসেবায় এক হাজার শয্যার একটি কেন্দ্র গড়ে তুলছে। সেখানে বিনা মূল্যে চিকিৎসা দেওয়া হবে।

আর ভারতের বৃহত্তম পোর্ট টার্মিনাল পরিচালনাকারী আদানি গ্রুপ সৌদি আরব, থাইল্যান্ড, দুবাই থেকে আসা অক্সিজেন সাপ্লাই ঠিকমতো বন্দোবস্ত করতে ভূমিকা রাখছে বলে বিবৃতিতে জানানো হয়েছে।

ডিক্সন টেকনোলজিসের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান সুনীল ভাসওয়ানি
ছবি ফেসবুক থেকে নেওয়া

ভারতের স্মার্টফোন প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ডিক্সন টেকনোলজিসের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান বিলিয়নিয়ার সুনীল ভাসওয়ানি দিল্লির বাড়িতে পরিবারের সঙ্গে আছেন। বাইরের কারও সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করছেন না তাঁরা। সহকর্মীদের সঙ্গে ভার্চ্যুয়ালি যোগাযোগ রাখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সুনীল ভাসওয়ানি।

তিনি জানিয়েছেন, ভারতে কোভিড টেস্ট বৃদ্ধির লক্ষ্যে গত বছর আরটি-পিসিআর মেশিন তৈরির একটি কারখানা গড়ে তোলা হয়েছিল। এবার সেটার কাজ আরও গতিশীল করার চেষ্টা করছেন। পাশাপাশি উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অক্সিজেন কনসেনট্রেটর আনার প্রক্রিয়া চলছে।